সরকারি-বেসরকারি উড়ান সংস্থার রহস্যজনক কর্মকা- ও নানামুখি অপতৎপরতা দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র বিমান বন্দরটির যবনিকা কম্পমান। ফলে ইতোমধ্যে শতাধিক কোটি টাকা বিনিয়োগের বরিশাল বিমান বন্দরের ভবিষ্যত সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মুখে। অথচ নিকট অতীতেও রাষ্ট্রীয় বিমানের সাথে বেসরকারি দুটি উড়ান সংস্থার সুষ্ঠু প্রতিযোগিতায় বরিশাল বিমান বন্দর ছিল প্রাণবন্ত। প্রতিদিন ন্যূনতম ৫টি ফ্লাইটের যাত্রীদের পদচারণায় বরিশাল বিমান বন্দর থাকত মুখরিত। পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্টসহ এভিয়েশন সেক্টরে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকশ মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে গত কয়েক বছরে। পুরো বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বরিশাল চেম্বারের সভাপতি এবং প্রেসক্লাব ও আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

পদ্মা সেতু বরিশাল সেক্টরের আকাশপথে তেমন কেন বিরূপ প্রভাব না ফেললেও নানা খোড়া যুুক্তিতে সরকারি-বেসরকারি উড়ান সংস্থাগুলো বরিশালের সাথে ফ্লাইট হ্রাসের পরে এখন তা বন্ধের পায়তারা করছে। পদ্মা সেতু চালুর পরে গত বছর ৫ আগস্ট থেকে রাষ্ট্রীয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তার দৈনিক ফ্লাইট সপ্তাহে মাত্র ৩ দিন হ্রাস করে। ফলে ‘কবে বিমান ঢাকায় যায়’, তা খুঁজে সরকারি এ উড়ানে ভ্রমণে যাত্রীদের আগ্রহ অনেকটা হ্রাস পেলেও গত বছর বরিশাল সেক্টরে বিমানের যাত্রী চলাচল ছিল প্রায় ৭৫%। কিন্তু গত বছর ৫ আগস্ট ফ্লাইট সংখ্যা হ্রাসের ঠিক এক বছর পরে চলতি বছরের একই তারিখে বরিশাল সেক্টরে ফ্লাইটের সময়সূচি পরিবর্তন করে যাত্রীদের বিমানের প্রতি বিমুখ করার সব আয়োজন সম্পন্ন করে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন সময়সূচি মোটেই যাত্রীবান্ধব নয়। ফলে এ সেক্টরে রাষ্ট্রীয় বিমানে ভ্রমণে এখন সাধারণ যাত্রীদের আগ্রহ তলানীতে ঠেকেছে। অথচ বেসরকারি ইউএস বাংলা এয়ারওয়েজে শুধু বরিশাল-ঢাকা আকাশপথে ২ হাজার ৭৯৯ টাকার স্থলে ১১ হাজার ৬শ’ টাকায়ও টিকেট বিক্রি হচ্ছে প্রায়সই। কিন্তু ‘যাত্রীবান্ধব’ সময়সূচি ও নিয়মিত ফ্লাইটের অভাবে রাষ্ট্রীয় বিমানে ভ্রমণে আগ্রহ নেই যাত্রীদের।

তবে এরপরেও বিমানের বরিশাল সেলস অফিসে মাসে সাড়ে ৮ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গত মাসেও বিক্রির পরিমাণ ছিল প্রায় কোটি টাকা।

অপরদিকে ‘এয়ারক্রাফট সঙ্কটে’ বেসকারি ‘নভো এয়ার’ বরিশাল সেক্টরে চলতি বছর দুদফায় তাদের ফ্লাইট চলাচল স্থগিত করেছে। বিমান ও নভো এয়ার-এর ব্যর্থতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ‘অনেকটা একচেটিয়া বাজার দখল করে’ বেসরকারি ইউএস বাংলা। প্রতিষ্ঠানটি বরিশাল সেক্টরে রমরমা বাণিজ্য করে আসছিল। এমনকি বেশিরভাগ বৃহস্পতিবার এ উড়ান সংস্থাটির উড়জাহাজে ২ হাজার ৭৯৯ টাকায় কয়েকটি টিকেট বিক্রির পরে অবশিষ্ট টিকেট ১১ হাজার ৬শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ বেসরকারি এ আকাশ পরিবহন সংস্থাটি এখনো বরিশাল-ঢাকার ৮ গুন দুরত্বের ঢাকা-কোলকাতা-ঢাকা রুটে ১৬ হাজার ৫৫৮ টাকায় যাত্রী পরিবহন করছে। এমনকি গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ইউএস-বাংলা এয়ারের উড়জাহাজে বরিশাল-ঢাকা রুটে গড় যাত্রী ভ্রমণের হার ছিল ৮৪% এবং ঢাকা-বরিশাল রুটে ৭৫%। এরমধ্যে গত জুলাই মাসেই বরিশাল-ঢাকা আকাশ পথে ফ্লাইট প্রতি গড় যাত্রী ভ্রমণের হার ছিল ৯২%। যা গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ৯৬% করে। আগস্ট জুুড়ে মাঝে মাঝেই প্রবল বর্ষণসহ মাসের বেশিরভাগ সময়ই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে গড় যাত্রী ভ্রমণের হার প্রায় ৬০%-এ হ্রাস পাওয়ার পরই বেসরকারি উড়ান সংস্থাটি আগামী ৬ সেপ্টেম্বর থেকে বরিশাল সেক্টরে ফ্লাইট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির জিএম জনসংযোগ কামরুল ইসলামের সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পরে যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমলেও গত এক বছরে আমরা সে পরিস্থিতি উত্তরণে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু যাত্রী সঙ্কট না থাকলেও ক্রমাগত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ গত জুলাই থেকে অভ্যন্তরীণ সেক্টরে নতুন করে যাত্রী প্রতি ২শ’ টাকা কর বৃদ্ধির ফলে লোকসানের বোঝায় আর সমতা আনা সম্ভব হচ্ছে না। তবুও আমরা বরিশাল সেক্টরে ফ্লাইট পরিচালন-এর বিষয়টি ভবিষ্যত পরিকল্পনা রেখেছি’ বলেও জানান এ গনসংযোগ কর্মকর্তা।

এদিকে ইউএস-বাংলা বন্ধের ফলে ফলে ৭ সেপ্টেম্বর থেকে বরিশাল বিমান বন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর সপ্তাহে মাত্র ৩টি ফ্লাইটই অবশিষ্ট থাকছে। তাও যাত্রীবান্ধব না হওয়ায় কতদিন টিকে থাকবে তা বলতে পারছেন না এভিয়েশন বিশেষজ্ঞগণ। অথচ বরিশাল সেক্টরে এখন দৈনিক দুটি ফ্লাইট পরিচালনের মতো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রীয় বিমান প্রতিষ্ঠানটির। কিন্ত ‘বিমান কবে আবার বরিশাল সেক্টরে যাত্রী চাহিদা অনুযায়ী ফ্লাইট পরিচালনা করবে, তা বলতে পারছেন না প্রতিষ্ঠানটির কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও।

এসব বিষয়ে বরিশাল চেম্বারের সভাপতি সাঈদুর রহমান রিন্টু’র দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারের পদ্মা সেতুর সাফল্য মøান করতেই সরকারি-বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো অযৌক্তিকভাবে বরিশাল সেক্টরে ফ্লাইট সংকোচন করছে কিনা তা তদন্ত করা উচিত। তিনি ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন। বরিশাল প্রেসক্লাব ও বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র বটব্যাল’ও অনরূপ মন্তব্য করে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের বহুমুখি যোগাযোগ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার স্বার্থে আকাশ পরিবহন সচল রাখার কোনো বিকল্প নেই। তিনিও বিষয়টি নিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বরিশাল প্রেসক্লাব ও বরিশাল বারের সাবেক সভাপতি মু. ইসমাইল হোসেন নেগাবানও বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে সুষ্ঠু এবং বহুমুখি ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষায় সরকারের গণদায়বদ্ধতার স্থান থেকে বরিশাল সেক্টরে নিয়মিত সরকারি-বেসরকাবি উড়ান অব্যাহত রাখার দাবি জানান।