টানা বর্ষণে কক্সবাজারে বন্যা, পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ, নিহত ৫
০৮ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৪৩ এএম | আপডেট: ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১০:৫৪ এএম
টানা বৃষ্টি, জোয়ারের পানি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে বেশকিছু ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়েছে ৫ লাখ মানুষ। খাদ্য সংকট, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, আশ্রয় সংকটসহ নানা কারণে পানিবন্দি এসব মানুষের মধ্যে হাহাকার বিরাজ করছে।
অন্যদিকে চকরিয়ার বরইতলীতে বাড়ির মাটির দেয়াল ধসে দুই শিশু ও উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে মা-মেয়ে নিহত হয়েছে। এর আগে বিকেলে মাতামুহুরী নদীতে ঢলে ভেসে আসা কাঠ ধরতে গিয়ে ভেসে গিয়ে শাহ আলম নামে এক যুবক নিখোঁজ হয়েছে।
পানি পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সোমবার (৭ আগস্ট) বিকেল ৩ টা পর্যন্ত মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়েছে। ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে মঙ্গলবারও এই অবস্থা হতে পারে মাতামুহুরী নদীর। পেকুয়ায় বেড়ীবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, চকরিয়ায় ১৮ টি ইউনিয়নে পানিবন্দি হয়ে ৪৫ হাজার পরিবারের ১ লাখ ৮৫ জন মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পানিবন্দি হয়েছে পেকুয়া উপজেলায়। এখানে পানিবন্দি হয়েছে ৭ ইউনিয়নে ৮ হাজার পরিবারের ৩২ হাজার মানুষ।
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী জানিয়েছেন, পার্বত্য জেলা ও চকরিয়ার পাহাড়ী ঢল নেমে আসার মাধ্যম মাতামুহুরী নদী। পাহাড়ী ঢল, বৃষ্টি এবং জোয়ারের ঢেউয়ে বাঁধ ভেঙ্গে বিভিন্ন ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। চকরিয়ার বিপুল সংখ্যক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এর মধ্যে ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে কাকারা, লাক্ষ্যারচর, বুমুবিল ছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল ও কোনাখালী ইউনিয়ন।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান জানান, বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মাতামুহুরী নদীতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্লাবিত এলাকার লোকজনকে সরকারী সহায়তা প্রদান শুরু করা হয়েছে। প্লাবিত এলাকার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হচ্ছে।
লাক্ষ্যারচর এলাকার ছিদ্দিক আহমেদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘রোববার রাত ৩ টা থেকে বাড়িতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এখন পুরো ঘর পানির নিচে। আমরা কোনরকম বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। সব জিনিসপত্র পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।’
কোনাখালী এলাকার আব্দুস সাত্তার জানান, ‘পুরো এলাকা পানিতে ভাসছে। মাটির ঘরবাড়ি ভেঙে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। আমরা কোথায় যাবো ভেবে পাচ্ছিনা।’
এদিকে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আবহাওয়া অফিসও বলছে, বৃষ্টিপাত আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। ফলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানিয়েছেন, রোববার বিকাল ৩ টা থেকে সোমবার বিকাল ৩ টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার সকাল ৬ টা থেকে বিকাল ৩ টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৮১ মিলিমিটার। আগামি আরও ৩ দিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস রয়েছে।
অপরদিকে ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, জালালাবাদ ও পোকখালী ইউনিয়নের ৭০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে ঈদগাঁও নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিপদ সীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে।
জালালাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ জানান, বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এই তিনটি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়া অব্যাহত রয়েছে। দ্রুত সংস্কার করা না হলে এটি আরো বড় আকারে হতে পারে বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানভীর সাইফ আহমেদ বলেন, মাতামুহুরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানকার ইউনিয়নগুলো প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ বেশকিছু এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে। যেহেতু ভারী বৃষ্টিপাত এবং জোয়ারের পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে তাই এই মুহুর্তে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, গত কয়েকদিন ধরে প্রবল বর্ষণ ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ার অব্যাহত রয়েছে। এরইমধ্যে উচ্চ জোয়ারের কারণে পেকুয়ায় কিছু বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এখন পর্যন্ত কুতুবদিয়ায় ৬টি ইউনিয়নের ৭০ পরিবার, পেকুয়াতে ৮ হাজার পরিবার, মহেশখালীতে ১০০ পরিবার, টেকনাফে ২০০ পরিবার, চকরিয়ায় ৪৫ হাজার পরিবার, কক্সবাজার সদরে এক হাজার পরিবার, ঈদগাঁও উপজেলায় ১৫০ পরিবার ও উখিয়াতে ৫০ পরিবার পানিবন্দি রয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঠে রয়েছেন। তারা বোট নিয়ে পানিবন্দি মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছে এবং তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছে। এছাড়াও পাহাড় ধসের শঙ্কায় কক্সবাজার সদর ও পৌরসভায় বেশ কয়েকটি টিম করে দেয়া হয়েছে সবার সমন্বয়ে। তারা মাইকিং করছে এবং লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসার জন্য অনুরোধ করছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসছে তাদেরকে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রত্যেকে যাতে আশ্রয়কেন্দ্রের খাবার পান তা সুনিশ্চিত করা হচ্ছে।
ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট বন্যায় পানিবন্দি লোকজনের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তালিকা করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী রামু ছাড়া বাকি ৮ উপজেলায় ৬০ টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।
চকরিয়া: মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে চকরিয়া উপজেলা। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, চকরিয়ার ১৮ ইউনিয়নের ৪৫ হাজার পরিবারের ১ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।
সোমবার বিকেল পর্যন্ত ৭ হাজার পানিবন্দি মানুষকে ৯৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। তাদেরকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। পুরো উপজেলায় ১৮টি মেডিকেল টিম জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য কাজ করছে।
পেকুয়া: এই উপজেলায় ৭ ইউনিয়নে ৮ হাজার পরিবারের ৩২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে সেখানে ২০ হাজার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে দাবি করা হলেও মাঠের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। অল্প কিছু সংখ্যক লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হলেও বাকিদের খোঁজখবরই নিচ্ছে না প্রশাসন। সেখানেও ৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে এবং শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
কুতুবদিয়া: এই উপজেলায় ৬ টি ইউনিয়নে ৭০ টি পরিবারের ২৮০ জন পানিবন্দি হয়েছে। সেখান থেকে ইতোমধ্যে ৬০ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
মহেশখালী: এই উপজেলায় ৮ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভার ১০০ পরিবারের ৪৫০ জন লোক পানিবন্দি হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০০ জন লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
টেকনাফ: এই উপজেলায় ২০০ পরিবারের ৬০০ জন পানিবন্দি হয়েছে। ইতোমধ্যে ১১০ জন লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার সদর: এই উপজেলার ৫ ইউনিয়নের ৫৩০ পরিবারের ১৩৮০ জন পানিবন্দি হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৩০ জন লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
ঈদগাঁও: নবগঠিত এই উপজেলায় ৫ ইউনিয়নে ১০০ পরিবারের ৩০০ জন পানিবন্দি হয়েছে। ১০০ জন লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
উখিয়া: এই উপজেলায় ৫ ইউনিয়নের ৫০ পরিবারের ২৬০ জন লোক পানিবন্দি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে ৫০ জনকে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন উপজেলায় লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে দাবি করা হলেও অনেক তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তাদের দাবি, জেলা প্রশাসন আন্দাজ নির্ভর প্রতিবেদন তৈরী করেছে।
এদিকে সমুদ্রে জোয়ারের ঢেউয়ে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। মেরিন ড্রাইভের কিছু অংশে জিওব্যাগে বালির বাঁধ তৈরি করে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হলেও নতুন করে আরও কয়েকটি স্পটে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
পাঠ্যপুস্তক থেকে নোংরা শব্দ বাদ দিতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অধিকাংশ মানুষের চেতনার আলোকে সাজাতে হবে
নরসিংদীতে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত শ্রমিকদল নেতার ৬ দিন পর মৃত্যু
১০ মামলার আসামী সিলেট মহানগর আ‘লীগ নেতা বিজিত গ্রেপ্তার
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খুলনা অঞ্চলের বিজনেস রিভিউ মিটিং অনুষ্ঠিত
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
হিমেলের দুচোখ হারানো মামলা মির্জাপুরে আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার
আল্লাহর একাত্ববাদ কায়েম করতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কাজ করে যাচ্ছে
কুয়াকাটায় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ৬৭ হাজার জরিমানা
ভ্রমণকারীদের জন্য মেডিকেল ডেবিট কার্ড নিয়ে এল ভিসা ও ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি
সংস্কারবিহীন নির্বাচন দেশে নব্য ফ্যাসিবাদের জন্ম দেবে
নেত্রকোনার পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
আটঘরিয়ায় নারীর মৃতদেহ উদ্ধার
রামপালে ইউপি চেয়ারম্যান নাসির বরখাস্ত
রাজবাড়ীর কালুখালীতে এনআরবিসি ব্যাংকের ১০৮তম শাখার উদ্বোধন
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান শাখায় অপ্রীতিকর ঘটনা
খুলনা বারের সাবেক সম্পাদক কারাগারে
ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেল ‘রূপসী বাংলা’ ট্রেন, উৎফুল্ল যাত্রীরা
'মেসির সম্মান রক্ষার্থেই বার্সা ছাড়েন নেইমার'
সারাদেশে নৌযান শ্রমিকদের কর্মবিরতির আল্টিমেটাম মোংলায় প্রতিবাদ সভা এবং বিক্ষোভ
সংস্কার কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের সূচি: আসিফ মাহমুদ