মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প: বন, পাহাড় ও জীব বৈচিত্র্য ধ্বংসের আশংকা
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:০৬ পিএম | আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:০৬ পিএম
দৃষ্টিনন্দন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের পশ্চিম মুন্ডার ডেইল এলাকা তীব্র ঢেউর আঁছড়ে প্রচন্ডভাবে ক্ষতবিক্ষত ! কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারনে, 'সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়' এর ঘটনা ঘটতে পারে! গত মাসে মেরিন ড্রাইভ টেকনাফের সাবরাং অংশসহ প্রায় ১৫ টি অংশে তীব্র ভাঙ্গনের ফলে সড়ক যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সৈকতের বালি দিয়ে 'জিও ব্যাগ সিস্টেম' দ্বারা এরুপ ভাঙ্গন রোধ করার চেষ্টা করা হলেও তা কোনভাবেই স্থায়ী সমাধান নয়। এর টেকসই ও স্থায়ী সমাধান বের করা সময়ের সেরা দাবি।
তবে ইতিপুর্বেই ভাঙন রোধে মেরিন ড্রাইভ রোড আরো প্রশস্ত করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেতু ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। গত বছরের জুনে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। সড়কটি প্রশস্ত করা হলে প্রকল্প এলাকায় আরো গাছ ও পাহাড়ি বন কাটা পড়বে বলে জানিয়েছেন মেরিন ড্রাইভের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, মেরিন ড্রাইভ প্রশস্তকরণ এর ফলে হুমকির মুখে পড়বে সামুদ্রিক কাছিম ও লাল কাঁকড়ার আবাস। ব্যাহত হবে এ অঞ্চলের প্রাণজৈববৈচিত্র্য। সড়ক প্রশস্ত করে নয় বরং ভাঙন রোধে বিজ্ঞানসম্মত অবকাঠামো নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
কক্সবাজারে পর্যটন শিল্পের বিকাশে ২০০৮ সালে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ শুরু হয়। প্রথম পর্বে কলাতলী থেকে ইনানী পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হয়। দ্বিতীয় পর্বে ২০১৬ সালে ইনানী থেকে টেকনাফের শিলখালি পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার এবং তৃতীয় পর্বে শিলখালি থেকে টেকনাফ সাবরাং জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হয় ২০১৮ সালে। ইতিমধ্যেই সড়কটি ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
কিন্তু গত বছর হঠাৎ করেই সড়কটিতে ভাঙন শুরু হয়, চলতি বছরে যা তীব্র আকার ধারণ করে। মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন রোধে গত বছর ‘কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ’ প্রকল্প হাতে নেয় সড়ক বিভাগ। প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, প্রথম ধাপে ১ হাজার ৯২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে উখিয়া উপজেলার পাটুয়ারটেক পর্যন্ত ৩০ দশমিক ৪০ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করা হবে। এছাড়া রেজুখালের ওপর নির্মাণ করা হবে ৩০৫ মিটারের দুই লেনের সেতু। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পর্যটন শিল্পের প্রসার এবং প্রকল্প এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২৫ সালের জুন পর্যন্ত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) উখিয়া উপজেলা সভাপতি সাংবাদিক এম আর আয়াজ রবি বলেন, ' মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্ত করতে গেলে কক্সবাজার, রামু, উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্রের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ও প্রাণ প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের উভয় পাশে কয়েক লাখ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে, সাথে রয়েছে প্রাকৃতিক প্যারেকখ্যাত পাহাড়। অন্যদিকে মেরিন ড্রাইভের তীরঘেঁষেই রয়েছে সমুদ্রসৈকতের লাল কাঁকড়া, কচ্ছপ, ডলফিন ও সাগরলতাসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাঁচটি নির্ধারিত স্থান। সড়কটি প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের সার্বিক পরিবেশ ও প্রাণীদের আবাস ক্ষতির মুখে পড়বে। সড়ক প্রশস্ত করে নয় বরং ভাঙন রোধে বিজ্ঞানসম্মত অবকাঠামো নির্মাণের সম্ভাবনা যাচাই বাছাই করে টেকসই অবকাঠামো গঠনের যুক্তিকতা তুলে ধরেন তিনি।
সরেজমিন দেখা যায়, মেরিন ড্রাইভ সড়কের দরিয়ানগর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত রাস্তার গা ঘেঁষেই দুই পাশে রয়েছে ছোট-বড় পাহাড় ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এ সড়ক প্রশস্ত করতে গেলে কক্সবাজার থেকে ইনানী পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গাছ কেটে ফেলতে হবে। এখানকার বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে লাল কাঁকড়া ও সামুদ্রিক কাছিমের অবাধ বিচরণস্থল। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব প্রাণের আবাস।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামুদ্রিক ঢেউয়ে সড়কের ভাঙন ঠেকানোর জন্য রাস্তা প্রশস্ত করা কোনো সমাধান নয়, বরং সড়কের ডিজাইন এমনভাবে করা উচিত যাতে ঢেউয়ের কারণে সড়ক না ভাঙে। সড়ক নির্মাণে কোনোভাবেই পাহাড়ি বন বা পাহাড় কাটা সমর্থনযোগ্য নয় বলে জানান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘প্রশস্ত করে মেরিন ড্রাইভ সড়কের ভাঙন ঠেকানো সম্ভব নয়। সেখানে সামুদ্রিক ঢেউয়ের পাশাপাশি পাহাড়ি স্রোতও আসে। তাই সড়ক বড় করে সেখানে বিপর্যয় আরো বাড়ানো হবে।’
তিনি বলেন, ‘৩০ বছর আগেও এ অঞ্চলে ছিল প্রাকৃতিক দ্বীপ। সমুদ্রঘেঁষে পাহাড় থাকার ফলে পাহাড়ের পাদদেশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে সেখানে তৈরি হয়ে পাহাড়ি ক্লিপ। পৃথিবীর যেখানেই সমুদ্রের পাশে পাহাড় আছে সেখানেই এ ধরনের ন্যাচারাল ক্লিপের দেখা মেলে। সমুদ্র ও পাহাড়ের মেলবন্ধনে এটি একটি চমৎকার ইকোসিস্টেম। পাহাড় ও সমুদ্রের মাঝে ইকোসিস্টেমের লিংক রয়েছে। এ লিংক কোস্টাল এরিয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেরিন ড্রাইভ করার ফলে ওই লিংকেজ বা সংযোগ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন নতুন করে যদি আবার সড়কটি প্রশস্ত করা হয় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। এতে একদিকে পাহাড় কাটা পড়বে, অন্যদিকে সমুদ্রপাড় ভরাট হবে। কাছিমসহ সামুদ্রিক প্রাণীর আবাস হুমকিতে পড়বে। ব্যাহত হবে সামুদ্রিক কাছিমের প্রজননও।’
তাই মেরিন ড্রাইভ সড়কটির ভাঙ্গনরোধে বনভুমি, পাহাড় ও জৈব বৈচিত্র্য ধ্বংস করে প্রশস্তকরণ করে নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে টেকসই অবকাঠামো নির্মানের মাধ্যমে ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের পছন্দের রোডটিকে ঢেলে সাজানোর কথা উচ্চারিত হচ্ছে সবার মুখে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: সিলেটে এড. এমরান আহমদ চৌধুরী
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তরুণদের প্রস্তুতি নিতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা
২০২৫ সালে নিম্নমাধ্যমিক-মাধ্যমিকে ৭৬ দিনের ছুটির তালিকা প্রকাশ
খুলনা থেকে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকার পথে যুক্ত হচ্ছে ট্রেন জাহানাবাদ
প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত গ্রহনযোগ্য নির্বাচন দিন
আশুলিয়ায় কিশোর গ্যাং এর হামলায় আহত ৩
মাদারীপুরে পরকীয়ার জেরে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব হলেন সরওয়ার আলম
তোমাদের হাতে উড়তে থাকবে সমৃদ্ধ স্বনির্ভর বাংলাদেশের বিজয় কেতন - সাভার এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মোঃ মঈন খান
দৌলতপুরে পুলিশের মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান : গ্রেফতার-২
ব্রাহ্মণপাড়ায় বোরো ধানের বীজতলা পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষকেরা
পাকিস্তানে সামরিক আদালতে ২৫ বেসামরিক ব্যক্তির সাজায় উদ্বিগ্ন ইইউ
ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দেশে এনে সকল অপকর্মের বিচার করতে হবে : কাইয়ুম চৌধুরী
ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি মহাসচিব এর জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত
ভারতের সাথে চুক্তি সার্বভৌমত্বের জন্য ক্ষতিকর
খুনি হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ড বিচার নিশ্চিত করতে হবে-বাংলাদেশ ইসলামী দল
উগ্রবাদী সাদপন্থীদের বিচার নিশ্চিতকরণ এবং কার্যক্রম বন্ধের দাবিতে সিলেট জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি