মৃত্যু আর ধ্বংসলীলার বিভীষিকাময় ‘সিডর’এর রাত আজ
১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১০:১৩ এএম | আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১০:১৩ এএম
ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মৃত্যু আর ধ্বংসলীলার ‘সিডর’ এর কালরাত্রি আজ। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে বঙ্গোপসাগর থেকে ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার বেগে ধেঁয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের ১০টি জেলার ওপর আছড়ে পড়েছিল। উত্তর ভারত মহাসাগরের আন্দামান-নিকোবরের কাছে সৃষ্ট সে ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা প্রচার সহ প্রাক-প্রস্তুতির কারণে প্রানহানীর সংখ্যা যথেষ্ঠ হ্রাস করা সম্ভব হলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসেবে যা ১৬ হাজার কোটি বলে সেনা সমর্থিত তৎকালীন কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্বীকার করেছিল। সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩ সহস্রাধিক বলা হলেও আরো সহস্রাধিক নিখোজ ছিলেন। পরবর্তীকালে যাদের বেশীরভাগেরই আর কোন খোঁজ মেলেনি।
সেদিনের ঐ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপক‚লীয় ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশী আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ’ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ’ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারি হিসেবেই ক্ষতিগস্থ পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও বাস্তবে তা ছিল ২০ লাখেরও বেশী। আর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় ১ কোটি। সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জনের নিঁখোজের কথা বলা হলেও এ সংখ্যাও আরো অনেক বেশী ছিল বলে তখন অনেকেই দাবী করেছিলেন। বেশীরভাগ নিখোঁজদের আর কোন সন্ধান না মেলায় তাদের সকলকেই সিডরের বয়ে আনা ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ¡াস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে এসব নিখোঁজদের লাশটিও আর দেখতে পারেননি স্বজনেরা।
২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর সিডরের রাতের সে ভয়াল তান্ডবে দক্ষিণ উপক‚লের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। একই সাথে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ফসল সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টরের ধান আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে উপক‚লীয় জেলাগুলোর প্রায় ৬ লাখ টন ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সিডরের রাতে প্রকৃতির রুদ্র রোষে প্রায় ৫০ লাখ গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে । তবে সিডরের তান্ডবের আরো বড় ক্ষতি রুখে দিয়েছিল বিশাল উপক‚লীয় সবুজ বেষ্টনীর পরিকল্পিত বনভ‚মি। প্রকৃতির ঐ তান্ডব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিহত করেছিল প্রকৃতিই। প্রকৃতির ঐ তান্ডব প্রতিহত করতে সেরাতে উপক‚লীয় বনায়ন কর্মসূচী ও সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের লক্ষ লক্ষ গাছ ছাড়াও সাধারণ মানুষের প্রায় ১ কোটি গাছ মাটিতে মিশে গিয়েছিল ।
আবহাওয়া অধিদফতর ২০০৭-এর ১১ নভম্বর দুপুর ১২টায় দক্ষিন বঙ্গোপসাগরের অদূর উত্তর ভারত মহাসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ’ কিলোমিটার ভাটিতে একটি লঘুচাপ শনাক্ত করে। যা ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আন্দামান-নিকোবরকে ডানে রেখে এগুতে থাকে। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় লঘুচাপটি আন্দামান থেকে প্রায় ৫শ’ কিলোমিটার পূর্ব দিক দিয়ে সোজা উত্তরে এগুতে থাকে। এরপর লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত উপক‚ল বরাবর এগুতে থাকে। ঝড়টির নামকরণ করা হয় ‘সিডর’।
১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশ উপক‚লের ৫শ’ কিলোমিটার দক্ষিণ দিয়ে ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গল-হাড়িয়াভাঙ্গা উপক‚লে অগ্রসর হচ্ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপক‚লীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও ১৫ নভেম্বর বিকেলেই আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ সোজা উত্তরমুখি থেকে উত্তর-পূর্বমুখি হতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার পরেই ঝড়টি আরো দ্রæত গতিতে উত্তর-পূর্বমুখি হয়ে ভারত-বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তী হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে প্রায় ৩শ’ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখন্ডে আছড়ে পড়ে।
ঝড়টির ব্যাস মাত্র দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ্য ছিল অনেক দীর্ঘ। সাগরপাড়ের হরিণঘাটা-পাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দূরে বরিশাল পর্যন্ত একই সাথে প্রায় সমান বেগে সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতেও ঘূর্ণিঝড়-সিডর প্রায় সোয়া ২শ’ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের ধ্বংসলীলা অব্যাহত ছিল। পৌনে ৩শ’ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সাথে প্রায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ¡াসে উপক‚লের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদ সহ ফসলী জমিকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
সিডরের তান্ডবে প্রায় পৌনে ৭শ’ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্ল¬ী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ’ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের দেড় সহশ্রাধিক সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯শ’ টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
রেড ক্রিসেন্ট-এর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী-‘সিপিপি’র তৎকালীন সময়ের ৪০ সহ¯্রাধিক সেচ্ছাসেবক সিডরের দিন সকাল থেকে উপক‚লের লক্ষাধিক মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানান্তর করে। ফলে প্রকৃতির ভয়াল ঐ ধ্বংসলীলায় প্রাণহানীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়েছিল। দূর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায়ও অংশগ্রহণ করেছিল সিপিপি’র স্বেচ্ছাসেবক গণ। এমনকি ঝড়ের রাতে উদ্ধার তৎপরতায় গিয়ে সিপিপি’র ৫ জন স্বেচ্ছাসেবকও নিহত হন সিডরের রাতে । ঘূর্ণিঝড় সিডরের তান্ডবের পরদিন সকালেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন প্রথমে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করলেও পরবর্তীতে দেশী বিদেশী বিভিন্ন পর্যায় থেকেও ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
তবে সিডর উত্তরকালে প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগীতার আশ্বাস দিলেও পরবর্তিতে ৩২টি দেশ কোন সহায়তা দেয়নি। এমনকি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীও বরিশাল বিমান বন্দর হয়ে শরনখোলার ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সফর করে সেখানের কয়েকটি গ্রামের দূর্গতদের ঘরবাড়ী নির্মাণের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। তবে ২০০৮ পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণেরও প্রায় দেড় বছর পরে সেসব ঘরবাড়ী তৈরী সম্পন্ন হয়। পাকিস্তান সরকার সেদিন বাংলাদেশের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় তার বিমান বাহিনী ও সেনা বাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করছিল। পাক বিমান বাহিনীর ৪টি ‘সি-১১০’ পরিবহন বিমান দুদিনে বরিশাল বিমান বন্দরে ত্রান ও উদ্ধারকারী দল নিয়ে অবতরন করে। একই সাথে মার্কিন মেরিন সেনারাও ঘূর্ণি উপদ্রুত উপক‚লীয় এলাকাতে পানি সরবারহ ও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল।
বরিশাল বিমান বন্দরে ত্রান সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করে সেদিন ঘূর্ণি উপদ্রুত উপক‚লীয় এলাকায় ত্রান ও উদ্ধার তৎপরতা পরিচালিত হয়েছিল। তৎকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবঃ) এম এ মতিন-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর যশোর এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম সামরিক বাহিনীর পুরো ত্রাণ কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে সার্বিক তদরকি করেছিলেন।
সিডরের কালো রাত্রির ভয়াল দুর্যোগ গোটা উপক‚লবাসীকে আজও তাড়া করে ফিরছে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
মুকসুদপুরে ক্যালেন্ডার বিতরনকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ আহত ২০ জন
১০ জেলায় শৈত্যপ্রবাহসহ সারাদেশে তীব্র শীত
আ.লীগ ক্রীড়াঙ্গনেও ব্যাপক দলীয়করণ করেছিল : মির্জা ফখরুল
নালিতাবাড়ীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযানে ড্রেজার মেশিন ও পাম্প জব্দ
ছাগলনাইয়ায় এসএসসি ব্যাচ-২০০০’র বন্ধুদের মেজবান ও মিলনমেলা
রাতের আধারে দুস্থ রোগীদের শীতবস্ত্র দিলেন ইউএনও
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা স্থিতিশীল : চিকিৎসক
ঝগড়ার সময় স্ত্রীকে বাপের বাড়ী চলে যেতে বা মন ইচ্ছামতো চলতে বলা প্রসঙ্গে।
ফারুক হাসানের উপর হামলা ও আসামিদের জামিন পাওয়া অত্যন্ত নিন্দনীয় : খসরু
মানিকগঞ্জে ওয়ারেন্টের ৫ আসামী গ্রেফতার
আশুলিয়ায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পিঠা উৎসব
সন্ধান মিললো ফ্যাসিস্ট গণহত্যার শিকার আরও ৬ শহীদের লাশ!
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক লাভলু হত্যার বিচারের দাবীতে বিক্ষোভ
ছাগলনাইয়ায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির জনসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ
কেরানীগঞ্জে তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিপক্ষের হাতে নিহত ১
ত্রিশাল সরকারি নজরুল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহন
বিএআরএফ'র ইজিএম ও ফ্যামিলি ডে অনুষ্ঠিত
‘আলেমদের নেতৃত্বে চলবে দাওয়াতে তাবলিগ খুনীদের নেতৃত্বে নয়’
কলাপাড়া গ্রাজুয়েট ক্লাবের উদ্যোগে ৫০০ শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ
সদস্য সংগ্রহ কর্মসূচিতে টাঙ্গাইলে মানুষের ভালো সারা পাওয়া যাচ্ছে- শাকিল উজ্জামান