গারো পাহাড়ে ফি-বছর কোটি কোটি টাকার ফসল ও বাড়িঘর ভাংচুর

৩৫ বছরে হাতির পায়ে পৃষ্টে মারা গেছে ৬০ জন, আহত ৭ শতাধিক, হাতি মাড়া পড়েছে ৩৩ টি

Daily Inqilab ঝিনাইগাতী(শেরপুর) সংবাদদাতা

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম | আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:৪৬ পিএম

শেরপুর(উত্তর) গারো পাহাড়ে গত ৩৫ বছরে সরকারী হিসাবেই হাতির পায়ে পৃষ্টে মারা গেছে ৬০ জন। আহত ৭ শতাধিক। হাতি মাড়া পড়েছে ৩৩ টি। তবে বেসরকারী হিসেবে মৃত্যের সংখ্যা ও ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশী বলে জানান পাহাড়ি লোকজন। হাতি কবলিত ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি গ্রামগুলোতে গারো, হাজং, কোঁচ, বানাই, হিন্দু মুসলমানসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ হাজার লোকের বসবাস। বন বিভাগের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে হাতির ২টি খাদ্য ভাÐার গড়ে তোলার জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু ওই খাদ্য ভাÐার আজো আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এই অঞ্চলের মানুষের জন্য বন্যহাতি দীর্ঘ দিন যাবত জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রতি বছরই মানুষ ও হাতির মৃত্যু হচ্ছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। আতংকে দিশেহারা হাজার হাজার পাহাড়ী মানুষ। অপর দিকে মানুষ ও হাতি রক্ষায় বন বিভাগের সকল ব্যবস্থাই ভেস্তে গেছে। শেরপুর বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৫ সাল থেকে হাতির আক্রমণে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৭ শতাধিক। হাতি মারা পড়েছে ৩৩টি। ২০১৪ সালের পরই মানুষ-হাতি যুদ্ধে দু’পক্ষেরই মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই বড় হচ্ছে। উল্লেখিত ৩উপজেলায় বন্যহাতি ফি-বছর হাজার হাজার একর জমির ফসল, ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করছে। স্থানীয়দের দাবি, মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হবে। বন বিভাগ জানায়, পাহাড়ি অঞ্চলে হাতির সংখ্যা ১০০’র উপরে। পাহাড়িদের মতে ২শতাধিকের ও বেশী। সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতীতে ৮ হাজার ৩৭৬ একর বনভূমিজুড়েই হাতির আবাসস্থল। কেউ কেউ মনে করেন, ১৯৯৫ সালে ২০ থেকে ২৫টি হাতি ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে এ পাড়ে আসে। কাঁটাতারের বেড়া ও (বিএসএফ)’র বাঁধায় আর আবাসস্থলে ফিরতে পারেনি হাতির পাল। ধান ও কাঁঠালের মৌসুম ছাড়াও খাদ্যের সন্ধানে প্রায়শ:ই লোকালয়ে আসে হাতির পাল। কয়েক পালে বিভক্ত হয়ে ঝিনাইগাতী শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী থেকে শুরু করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে চষে বেড়ায়। ফসল ও বাড়িঘর রক্ষায় এলাকাবাসী জীবন বাজিরেখে মশাল জ্বালিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে হইহুল্লোড় করে তাড়ানোর চেষ্টা করেন। ঝিনাইগাতীর নওকুচি গ্রামের শ্রী. ধীরেন্দ্র কোঁচ, রাংটিয়া জাগেন্দ্র কোঁচ ও যুগল কিশোর কোঁচ জানান, হাতি দুই-তিন পালে বিভক্ত হয়ে খাবারের সন্ধানে গোটা পাহাড়ি অঞ্চল চষে বেড়ায়। লোকালয়ে তান্ডব চলায়। তাড়াতে গেলেই ঘটে দুর্ঘটনা। ২০১৪ সালে হাতি তাড়াতে সীমান্তে ১৩ কিলোমিটার সৌরবিদ্যুৎ সংযোগে বেড়া (বায়োলজিক্যাল ফেন্সিং) প্রকল্প করে বন বিভাগ। ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় হাতির বিচরণক্ষেত্রে বেড়া নির্মাণ করে। ২০১৫ সালে ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচা ও কর্নঝুড়ায় ১০০ হেক্টর বনভূমিতে হাতি জন্য খাদ্যের বাগান করে। তাওয়াকুচা, ছোট গজনী, বড় গজনী, হালচাটি ও মায়াঘাসিতে ১৩ কিলোমিটারজুড়ে লেবু ও বেত বাগান করে। হাতি পর্যবেক্ষণে সীমান্তে ১৬টি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করে। পাহাড়ি গ্রামে চার্জার লাইট, টর্চলাইট ও জেনারেটর বিতরণ করে কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে। অপরিকল্পিতভাবে করে বন বিভাগ ও ঠিকাদারদের বানিজ্য হলেও সকল পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। পাহাড়ীরা বলেন, হাতির আক্রমণে মানুষ মরলে ৩ লাখ, আহত হলে ১ লাখ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে ৫০ হাজার টাকা দেয় বন বিভাগ। এ টাকা একেবারেই কম। মারা গেলে ক্ষতিপূরণ ১০-২০ লাখ টাকা করা উচিৎ। নালিতাবাড়ীর পানিহাটা বিশপনগর গ্রামের কবির চিসিম (৬৫) বলেন, হাতি তাড়াতে মানুষের মৃত্যু অয়। হাতিও মারা পড়ে। হাতিইবা কী করবে? পাহাড়ে হাতির খাওন অইলে লোকালয়ে আইতনা। হাতি ও মানুষের উপকার অইত। তাড়াইবার গিয়া মরলে পরিবারের যে ক্ষতি হয়। এই অল্প টেহায় চলে না। ক্ষতিপূরণ বাড়ানো দরকার। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে হাতি হত্যায় সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ডের আইন রয়েছে। পুনরাবৃত্তিতে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদন্ড ও ১৫ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধানও আছে। প্রায় প্রতি বছর ফসলের মাঠ ও সবজিবাগানে সংযোগের বৈদ্যুতিক জিআই তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠে হাতি মারা যায়। বন বিভাগ আদালতে মামলা করে। হাতি মৃত্যুতে মামলা হয়েছে কমপক্ষে ৩ টি। এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, হাতি রক্ষায় ও সমতলে আসতে বাধা দেওয়ায় বন বিভাগ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সীমান্তবর্তী মানুষের সচেতনতায় প্রচারণা চালছে। হাতি বনে থাকবে। সেই বনে মানুষ বসতি গড়ে হাতিকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। ময়মনসিংহ বন বিভাগের, জামালপুর ও শেরপুরের দায়িত্বের সহকারী বন কর্মকর্তা ছাড়াও ঝিনাইগাতী উপজেলার রংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মকরুল ইসলাম আকন্দ ও শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরি রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, হাতিকবলিত এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া ও খাদ্য ভাÐার গড়ে তোলা হলে মানুষ-হাতি দ্ব›দ্ব কমিয়ে আনা যাবে। এছাড়া হাতির আক্রমণে নিহতদের পারিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ভূঁইয়া দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। বিষয়টি সরকারের সর্বচ্চ উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ অবহিত আছেন এবং ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আশাকরছি কার্য়করি দ্রæত ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শেরপুর জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতি-মানুষের দ্ব›দ্ব নিরসনে জনগণকে সচেতনতার লক্ষ্যে বন বিভাগের পক্ষ থেকে রেসপনস টিম কাজ করছে। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকায় সোলার ফ্যানসিং স্থাপন এবং অভয়ারণ্য গড়ে তোলাসহ টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়ে হাতিসহ প্রাণবৈচিত্র রক্ষায় চেষ্টাও করা হচ্ছে। এদিকে এই অঞ্চলের গরুতর এ সমস্যা নিয়ে মহান জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনে হাতি-মানুষের দন্দ নিরসণে বর্তমান সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল্লাহ অত্যন্ত জোড়ালো বক্তব্য ও রেখেছেন। অবিলম্বে তিনি এসব হতদরিদ্র মানুষ ও হাতির মুত্যুর মিছিল বন্ধ এবং গারো পাহাড়ি মানুষের জানমাল রক্ষার্থে প্রধানমন্ত্রীর দ্রæত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কিন্তু এর পর ও জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে আদৌ কি এই বিশাল অঞ্চলে হাতি- মানুষের দন্দ নিরসন হবে?


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মিথ্যা সংবাদ প্রচারের অভিযোগে জিডি করেছেন বুবলী

মিথ্যা সংবাদ প্রচারের অভিযোগে জিডি করেছেন বুবলী

গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জয়ী গায়কের বাড়িতে হামলা, একজন গুলিবিদ্ধ

গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জয়ী গায়কের বাড়িতে হামলা, একজন গুলিবিদ্ধ

সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা : ৩ জনের যাবজ্জীবন, ৬ জন খালাস

সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা : ৩ জনের যাবজ্জীবন, ৬ জন খালাস

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিমান হামলা রাশিয়ার, অন্ধকারে ইউক্রেন

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিমান হামলা রাশিয়ার, অন্ধকারে ইউক্রেন

দুবছর ধরেই ভারতে বন্ধ কোভিশিল্ড, বিতর্কের মধ্যে দাবি সিরামের

দুবছর ধরেই ভারতে বন্ধ কোভিশিল্ড, বিতর্কের মধ্যে দাবি সিরামের

ফের জেলেনস্কিকে খুনের ছক, ষড়যন্ত্রে শামিল ইউক্রেনেরই দুই কর্নেল!

ফের জেলেনস্কিকে খুনের ছক, ষড়যন্ত্রে শামিল ইউক্রেনেরই দুই কর্নেল!

‘গণছুটি’ নেয়া কেবিন ক্রুদের একসঙ্গে বরখাস্ত করল এয়ার ইন্ডিয়া

‘গণছুটি’ নেয়া কেবিন ক্রুদের একসঙ্গে বরখাস্ত করল এয়ার ইন্ডিয়া

রেফারিং নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে বায়ার্ন

রেফারিং নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে বায়ার্ন

হিজবুল্লাহর হামলায় উত্তর ইসরাইলে এক ইহুদিবাদী সেনা নিহত

হিজবুল্লাহর হামলায় উত্তর ইসরাইলে এক ইহুদিবাদী সেনা নিহত

বাইডেনের স্বীকারোক্তি, মার্কিন বোমায় মারা গেছেন ফিলিস্তিনিরা

বাইডেনের স্বীকারোক্তি, মার্কিন বোমায় মারা গেছেন ফিলিস্তিনিরা

কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান

কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান

ইসরাইলকে তথ্য দিতে গাজায় ব্রিটেনের ২০০ গোয়েন্দা ফ্লাইটের ১০০০ ঘণ্টা নজরদারি

ইসরাইলকে তথ্য দিতে গাজায় ব্রিটেনের ২০০ গোয়েন্দা ফ্লাইটের ১০০০ ঘণ্টা নজরদারি

এবার রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাচ্ছেন ৬৩ জন

এবার রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাচ্ছেন ৬৩ জন

রাজধানীতে জামায়াতের বিক্ষোভ

রাজধানীতে জামায়াতের বিক্ষোভ

ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে গেছে

ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে গেছে

একই গ্রাম থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত

একই গ্রাম থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত

ট্রাম্প নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন না : বাইডেন

ট্রাম্প নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন না : বাইডেন

ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী হলেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান

ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী হলেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান

“ইউক্রেনের কারাবন্দিরা যোগ দিতে পারবেন সেনাবাহিনীতে”

“ইউক্রেনের কারাবন্দিরা যোগ দিতে পারবেন সেনাবাহিনীতে”

গাজার আল-শিফা হাসপাতালে তৃতীয় গণকবরের সন্ধান, ৪৯ মৃতদেহ উদ্ধার

গাজার আল-শিফা হাসপাতালে তৃতীয় গণকবরের সন্ধান, ৪৯ মৃতদেহ উদ্ধার