ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৯ আশ্বিন ১৪৩১

লুটপাট-দুর্নীতিই নওফেলের ‘নীতি’ : বিশ্ববিদ্যালয় দখল, নিয়োগ বাণিজ্যে সম্পদ বেড়ে দশগুণ

Daily Inqilab চট্টগ্রাম ব্যুরো

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম | আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম

বেপরোয়া নওফেল। চরম ও বেপরোয়া ছিল তার দুর্নীতি-লুটপাট। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পলাতক সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের জন্য তাবৎ অনিয়ম-দুর্নীতিই ছিল তার ‘নীতি’। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাপট দেখিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয়, চট্টগ্রামসহ দুই দু’টি বিশ^বিদ্যালয় দখল ও যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা বিভাগের টপ টু বটম নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যসহ নানা উপায়ে সীমাহীন আর্থিক দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে নওফেলের বিরুদ্ধে বিস্তর। আর দুর্নীতি, লুটপাটের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন নওফেল।
তার অর্থ-সম্পদ বেড়ে হয়েছে কমপক্ষে দশগুণ। নওফেলের আঙুল ফুলে হয়েছে বটগাছ! নওফেলের এসব দুর্নীতি-অনিয়ম ও লুটপাটের তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং অন্যান্য গোয়েন্দা ও তদন্ত সংস্থা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে দুর্নীতি-হরিলুটে সাবেক মন্ত্রী নওফেলের সহযোগী ও বরকন্দাজদের অপককর্মেরও তদন্ত চলছে। এ কারণে ওরা এখন তটস্থ। নওফেল ও তার সহযোগী দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে দেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট মহল থেকে।
পতিত আওয়ামী স্বৈর শাসকের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটের মাধ্যমে তার পাহাড়সম অবৈধ অর্থ-সম্পদ অর্জনের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূত উপায়ে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ ও কব্জায় নেয়া, কাড়ি কাড়ি টাকার বিনিময়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও বদলির ঘটনা।
এদিকে নওফেলের দেয়া হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থী হওয়া পর্যন্ত সাবেক এই শিক্ষা উপমন্ত্রী ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নওফেলের আগের পাঁচ বছরে তার অর্থ-সম্পদ বেড়েছে সাত গুণ। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা মতে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী দুঃশাসনের পতন পর্যন্ত পরবর্তী সময়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও এমপি’র অর্থ-সম্পদের পাহাড় বেড়ে হয়েছে কমপক্ষে দশগুণ।
নওফেল দুর্নীতি-অনিয়ম, লুটপাটে পরদর্শী হলেও প্রথমে শিক্ষা উপমন্ত্রী, এমপি এবং পরের টার্মে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে ছিলেন পুরোপুরি ব্যর্থ প্রমাণিত। বরং তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটিয়ে গেছেন। যার রেশ এখনও শেষ হয়নি। মহিবুল হাসান চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অর্থায়ন ও নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়টি পাঁচ বছর আগেই কব্জায় নিয়ে হরিলুট চালান। তাছাড়া তিনি নিজের যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণে নেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)। সেখানে শিক্ষক নিয়োগও ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। আর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে নিজস্ব ক্যাডার ও চাঁদাবাজ বাহিনী দিয়ে যথেচ্ছ নিয়ন্ত্রণ, লুটপাট চালান। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন দুই ভিসি ছিলেন নওফেলের দুর্নীতি-লুটপাটের সহযোগী।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী ছিপাতলী মাদ্রসায়ও জনৈক বিতর্কিত অধ্যক্ষকে দিয়ে পরগাছা, বরকন্দাজ, দুর্নীতি ও লুটেরা সহযোগী গোষ্ঠি তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে শেষমেশ ফেল হন নওফেল। চট্টগ্রামে ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন নওফেল। অনেকগুলো অভিযোগ রয়েছে, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী থাকাকালে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের এই সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী হয়ে তার দুর্নীতি-লুটপাট আরও বহুদূর বিস্তার লাভ করে। তার অবৈধ সম্পদ ও দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে। গত ২০ আগস্ট বিএফআইইউ নওফেল এবং তার পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। তাদের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত এবং ব্যাংক হিসাবের তথ্যও তলব করেছে।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর হামলা এবং একাধিক হত্যাকা-ের নির্দেশদাতা হুকুমের আসামী হিসেবে কমপক্ষে এক ডজন মামলার আসামি হয়েছেন নওফেল। চট্টগ্রামে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণকারী সশস্ত্র আওয়ামী ক্যাডারদের বেশির ভাগই তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া-চকবাজার) আসনে টানা দুইবার বিনা ভোটের এমপি নওফেলের এখনও কোন খোঁজ মিলেনি। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের দিন থেকেই তিনি পলাতক। কেউ কেউ বলছে, নওফেল পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। কেউ বলছে দেশের ভেতরে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি তিনি এখন কোথায়। প্রসঙ্গত নওফেল ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশোনা করেছিলেন বলে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সগর্বে বলতেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রথমে উপমন্ত্রী এবং এরপর মন্ত্রী থাকাকালে ব্যাপক বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে নওফেলের বিরুদ্ধে। এর মাধ্যমে প্রতিটি নিয়োগ-বদলি সুপারিশের জন্য লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরেছেন। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণও নিজের কব্জায় নেন তিনি। বোর্ডের কেনাকাটার সব কাজ পেতেন তার সহযোগী ঠিকাদাররা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সিভাসুর শিক্ষক নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজের পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দিতেন তিনি। এ ছাড়া রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্যও সুপারিশ করেন নওফেল। এসবের মধ্যদিয়ে নওফেল কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। মহিবুল হাসান নওফেল নিজ ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজস্ব বলেয়ের লোকদের নিয়োগ দিতেন। মেধাবীরা ছিলেন বঞ্চিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয় ও সিভাসুকে দুর্নীতির হাটে পরিণত করেন তিনি।
কলেজ শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে নওফেল তার পিএস এবং নিজস্ব দালালদের মাধ্যমে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। এ ছাড়া লাখ লাখ টাকার লেনদেনে বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হতো। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ-পরিদর্শকসহ বিভিন্ন পদে নিজের লোকদের নিয়োগ দিতেন নওফেল। তারা ফলাফল জালিয়াতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকর্ম করলেও শিক্ষামন্ত্রী সব সময় নীরব ছিলেন। শিক্ষা বোর্ডর এসব কর্মকর্তা মন্ত্রীর জন্য খামে ভরে টাকা পাঠাতেন। ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে তার ছেলের পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ উঠলেও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দেননি নওফেল।


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নোবিপ্রবি উপাচার্যের সাথে নোবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির নতুন কমিটির সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়

নোবিপ্রবি উপাচার্যের সাথে নোবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতির নতুন কমিটির সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়

চাঁদপুরে বেড়েছে ইলিশের দাম

চাঁদপুরে বেড়েছে ইলিশের দাম

হবিগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত অর্ধশতাধিক

হবিগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত অর্ধশতাধিক

ঝিনাইদহে সড়ক দুর্ঘটনায় দুইজন নিহত

ঝিনাইদহে সড়ক দুর্ঘটনায় দুইজন নিহত

মাজার রক্ষা করতে হাইকোর্টের নির্দেশ

মাজার রক্ষা করতে হাইকোর্টের নির্দেশ

দুই মামলায় খালাস পেলেন জামায়াত সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ৪৯ জন

দুই মামলায় খালাস পেলেন জামায়াত সেক্রেটারি মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ৪৯ জন

নিউইয়র্কে মোদি-ইউনূস বৈঠক না হওয়ার যে কারণ জানাল নয়াদিল্লি

নিউইয়র্কে মোদি-ইউনূস বৈঠক না হওয়ার যে কারণ জানাল নয়াদিল্লি

জয়পুরহাটে রেলক্রসিংয়ে থেমে যাওয়া ট্রাকে ট্রেনের ধাক্কা

জয়পুরহাটে রেলক্রসিংয়ে থেমে যাওয়া ট্রাকে ট্রেনের ধাক্কা

জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের দুই ভাইয়ের এনআইডি বাতিল

জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজের দুই ভাইয়ের এনআইডি বাতিল

পশুর চর্বির পর এবার প্রসাদে তামাক! ফের বিতর্কে তিরুপতি মন্দির

পশুর চর্বির পর এবার প্রসাদে তামাক! ফের বিতর্কে তিরুপতি মন্দির

হাছান মাহমুদ, সাঈদ খোকন ও প্রলয়ের দুর্নীতি অনুসন্ধানে লিগ্যাল নোটিশ

হাছান মাহমুদ, সাঈদ খোকন ও প্রলয়ের দুর্নীতি অনুসন্ধানে লিগ্যাল নোটিশ

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধনে খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধনে খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন

শহিদ শিশু রাতুল বগুড়ার নামাজ গড় গোরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত

শহিদ শিশু রাতুল বগুড়ার নামাজ গড় গোরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন কারখানায় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগে গ্রেপ্তার ৮

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন কারখানায় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগে গ্রেপ্তার ৮

সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা

সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা

জয়ের খোঁজে নারী দলের বিশ্বকাপ যাত্রা

জয়ের খোঁজে নারী দলের বিশ্বকাপ যাত্রা

গ্রিসের কাছে নৌকা ডুবে চার অভিবাসীর মৃত্যু

গ্রিসের কাছে নৌকা ডুবে চার অভিবাসীর মৃত্যু

যুক্তরাষ্ট্রে জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক মোদীর

যুক্তরাষ্ট্রে জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক মোদীর

সাজেক ভ্যালিতে ভ্রমণে তিনদিনের নিষেধাজ্ঞা

সাজেক ভ্যালিতে ভ্রমণে তিনদিনের নিষেধাজ্ঞা

যশোরের সাবেক এসপি ও ওসির বিরুদ্ধে থানায় মামলা রেকর্ড

যশোরের সাবেক এসপি ও ওসির বিরুদ্ধে থানায় মামলা রেকর্ড