ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ | ৩০ কার্তিক ১৪৩১

বিএনপি ঘরানার হওয়ায় আওয়ামী সরকারের অমানবিক নির্যাতনের শিকার একটি পরিবার: রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১০ পিএম

শুধুমাত্র বিএনপি ঘরানার পরিবার সদস্য। আর তাই এই পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্যই শিকার হয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলে। দিনের পর দিন এই পরিবারের ওপর নেমে এসেছে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এসব নির্যাতন, মামলা আর জেল জুলুমের মোকাবেলা করতে যেয়ে প্রায় নি:স্ব হয়েছেন পরিবারের অনেকেই। বেচতে হয়েছে একের পর পারিবারিক জমি।

 

নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি জন্মগত অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সদস্যও। নির্যাতনের সঙ্গে তাকে জেলেও আটকে রাখা হয় আড়াইটি বছর। কারাগারের শারীরিক মানসিক নির্যাতনে এই অসুস্থ যুবকটি এখন অতিরিক্ত ব্লাড পেসার ও ডায়বেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত। এই মানুষটিকেই আওয়ামী লীগ সরকার বানিয়েছিল জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বদানকারী।

 

ইয়ামীন খান তীর্থ নামের ঐ যুবকের বাড়ি ফরিদপুর শহরে। তার দাদা মরহুম আমজাদ হোসেন খান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে প্রচন্ড শারীরীক নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাক আর্মিদের ঐ নির্যাতনের যন্ত্রনা বয়ে বেড়িয়েছেন মরহুম আমজাদ হোসেন খান।

 

তারই মেঝো সন্তান তীর্থর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া আতাহার খান ফরিদপুর যশোর মাগুড়া ও রাজবাড়ী অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। বিখ্যাত ধোপাডাঙ্গা চাঁদপুর কানাইপুরের সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ কাজী সালাউদ্দিন ও শহীদ নওফেলের সঙ্গে একই ইউনিটে ছিলেন তিনি।
কাজী সালাউদ্দিন ও নওফেলসহ বেশ কয়েকজন শহীদ হলেও আতাহার খানের নেতৃত্বে প্রাণপন যুদ্ধে পাক আর্মিদের পরাজিত করে মুক্ত করেন ঐ অঞ্চলগুলো। এই যুদ্ধ জয়ের ফলেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফরিদপুর শহর দখলের পথ তৈরী হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আতাহার খান স্বনামধন্য সাংবাদিক, কলামিস্ট, সাহিত্যিক। কবি আতাহার খান নামেই সমধিক পরিচিত তিনি। সাপ্তাহিক রোববার ও পূর্ণিমার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ইত্তেফাক, ইনকিলাব ও দৈনিক আমার দেশে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ইনকিলাব ও দৈনিক আমারদেশে কাজ করার কারনে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে হয়েছেন আক্রোশের শিকার।

 

 

আতাহার খানের ভাই আফজাল হোসেন খান পলাশকে ঘিরেই চলতো ফরিদপুরের বিএনপি অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মকান্ড। তাকে আটকাতে পারলেই অচল হয়ে যাবে বিএনপির রাজনীতি। এছাড়া তার আত্বীস্বজনের অনেকেই বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ কারনে গত ১৬টি বছর এই পরিবারের সদস্যদের সইতে হয়েছে অসহণীয় যন্ত্রণা, নির্যাতন ও অত্যাচার। ফরিদপুর শহরে তাদের বাড়ীতে প্রায় প্রতিদিনই ২ থেকে ৩ দফা করে চলতো ব্যাব-পুলিশের অভিযান। তল্লাশীর নামে তছনচ করা হতো ঘরবাড়ী ও আসবাব পত্র।
একাধিকবার জেল খাটতে হয় বিএনপি নেতা আফজাল হোসেন খান পলাশ ও তার ভাতুষ্পুত্র ছাত্রদল নেতা আদনান খানকে। এদের অপরাধ একটিই আর তা হলো বিএনপি করা। দিনের পর দিন ব্যাব-পুলিশের তল্লাশী সন্তান নাতীদের জেল জুলুমের মত যন্ত্রণা সইতে দেখে অসুস্থ হয়ে মারা যান তীর্থর দাদী অথ্যাৎ আতাহার খান আর আফজাল হোসেন খান পলাশের মা।
বিএনপি করার কারণে ফরিদপুরের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই পরিবারকে রাজাকার বানানোরও চেষ্টা করা হয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কি ত্যাগই না স্বীকার করেছে এই পরিবাটি।

 

তীর্থর ছোট চাচা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করা বর্তমানে বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজীব খানকে জামাত শিবিরকর্মী তকমা দিয়ে একাধিকবার নিয়ে যাওয়া হয় ডিজিএফআই হেডকোয়ার্টারে। আওয়ামী লীগ বা ঐ সরকার বিরোধী সংবাদ করলে ভয় দেখানো হয় আয়নাঘরে আটকে রাখার।
এবার আসা যাক তীর্থের ওপর নির্যাতনের কথায়। জন্মগত অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলেটিকে জঙ্গী নেতা হিসেবে আটক করা হয়।
যে ছেলেটিকে ২০ বছর বয়সে স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভর্তি করা হয় স্কুলে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন হওয়ায় ধীরে ধীরে আয়ত্ব করেন লেখাপড়া। স্কুল শেষ করে কলেজেও শুরু করেন পড়াশুনা। অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কোটায় ইউনিয়ন পরিষদে একটি ছোট চাকরিও পান তিনি। অথচ, সেই ছেলেটিকে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকরী ও নেতা হিসেবে ভরে দেয়া হয় কারাগারে।

 

পুরোপুরি দৃশ্যমান অসুস্থ মানুষটিকে সার্টিভিকেট দেয়া হয় সুস্থ হিসেবে। অথচ যে কিনা ঠিক মত হাটতে পারেন না, ঠিক মত মুখে ভাত তুলে খেতে পারেন না, বাথরুম ব্যবহার করতে পারেন না, এমনকি শরীরের পোষাকও পড়তে পারেন না ঠিক মত। শারীরীক ভাবে পুরোপুরি সচল নয়, নিজেস্ব কোন চিন্তাশক্তি নেই, এমন একটি মানুষকে বানানো হলো জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী ও জঙ্গী নেতা।
মা হারা ছেলেটির কষ্ট দেখে একসময় বাবা আতাহার খানও হয়ে পড়েন অসুস্থ। বর্তমানে বাবা আতাহার খান মড়ণঘাতী ক্যান্সারে আক্রান্ত।
ক্ষমতার পালাবদলের পর সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন তীর্থ।

 

প্রথমে বিএনপি নেতা আফজাল হোসেন খান ও ছাত্রদল নেতা চাচাতো ভাই আদনান খানকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় তাদের বাসায়। তাদের না পেয়ে ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল কর্মস্থল থেকে গ্রেফতার হন তীর্থ। এন্টি টেরোরিজম ইউনিট নামধারী ৬ পুলিশ তাকে আকস্মিকভাবে ঘিরে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে হাতকড়া পড়িয়ে মাইক্রোবাসে তোলা হয়। আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে তীর্থকে রাষ্ট্রবিরোধী উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্য ও জঙ্গী নেতা বলে দাবি করে পুলিশ।

 

পরিবারের লোকজন যোগাযোগ করলে ১৫ লাখ টাকা দাবি করেন পুলিশ সদস্যরা। দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় মিথ্যা মামলা দিয়ে ফরিদপুরের মধুখালী থানায় আটক রেখে মিথ্যা জবানবন্দি দেয়ানোর চেষ্টা করে পুলিশ। পরের দিন ১৩ এপ্রিল কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় আড়াই বছরের কারাবাস কালে তীর্থকে কথায় কথায় মারধর করা হতো।

 

গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর তীর্থকে জামিন দেয় হাইকোর্ট। ৬ দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর জামিনে বের হন তীর্থ।

 

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে কি করে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হতে পারে? অসুস্থ মানসিক ভারসাম্যহীন একটি সন্তান কারাগারে থাকায় তার বাবা দু:চিন্তায় দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে মিথ্যা জঙ্গি ও রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় কীভাবে অভিযুক্ত করলো, সেই প্রশ্ন এখন ভুক্তভোগী এই পরিবারের।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মাধ্যমে এই পরিবারটি যে ভাবে অপমানিত, ক্ষতিগ্রস্ত হলো তার দায় কে নেবে?
অপমান অত্যাচার সইতে না পেরে দাদী অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। চাচা-চাচাতো ভাইরা জেল খেটেছেন, আরেক চাচাকে ধরে নিয়ে আয়না ঘরের ভয় দেখানো হয়েছে, কারাগারবাসী সন্তানের দুরস্থা দেখে চিন্তায় চিন্তায় ক্যানসারের রোগি হয়েছেন, জেল খাটাকালে তীর্থর ব্লাড পেসার এবং ডায়বেটিসেও আক্রান্ত হয়েছেন, এসবের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

 

বাড়ীতে দিনের পর দিন পুলিশি তল্লাশীর নামে আশবাব পত্র তছনচ, পরিবারের সদস্যদের পালিয়ে বেড়ানো, রোগে আক্রান্ত, জেলের খরচ, মুক্ত করার প্রক্রিয়া, সব মিলিয়ে অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এই পরিবারটি। পুরো ক্ষতি হয়তোবা কেউই শুধরাতে পারবে না। তারপরও রাষ্ট্রের উচিত কিছুটা ক্ষতিপূরণ দিয়ে পরিবারটির পাশে থাকা। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বলিয়ান হয়ে পরিবারটির এই ক্ষতি করেছে বিগত সরকারই।
রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপুরণ চাই ।


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেসে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ !

ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেসে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ !

গাজায় ইসরায়েলের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত যুদ্ধাপরাধের সমান: এইচআরডব্লিউ

গাজায় ইসরায়েলের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত যুদ্ধাপরাধের সমান: এইচআরডব্লিউ

আহতদের খোঁজ নিতে পঙ্গু হাসপাতালে বিএনপি, ৫ লাখ টাকা অনুদান প্রদান

আহতদের খোঁজ নিতে পঙ্গু হাসপাতালে বিএনপি, ৫ লাখ টাকা অনুদান প্রদান

মিজানুর রহমান ভূঁঞা শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান

মিজানুর রহমান ভূঁঞা শেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান

গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপের পরিচালকের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ

গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপের পরিচালকের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের চায়ের আমন্ত্রণে ফখরুলসহ বিএনপি নেতারা

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের চায়ের আমন্ত্রণে ফখরুলসহ বিএনপি নেতারা

উগ্রতা সৃষ্টিকারী ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে হবে, নেটদুনিয়ায় ভাইরাল

উগ্রতা সৃষ্টিকারী ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে হবে, নেটদুনিয়ায় ভাইরাল

শ্রীলঙ্কার সংসদ নির্বাচন, নতুন চ্যালেঞ্জ!

শ্রীলঙ্কার সংসদ নির্বাচন, নতুন চ্যালেঞ্জ!

আবার ফিরছে শফিক রেহমানের ‘লাল গোলাপ’

আবার ফিরছে শফিক রেহমানের ‘লাল গোলাপ’

৭০ বছর পর নিখোঁজ ৩ ব্রিটিশ সেনার দেহাবশেষ শনাক্ত

৭০ বছর পর নিখোঁজ ৩ ব্রিটিশ সেনার দেহাবশেষ শনাক্ত

আন্দোলনে আহত চিকিৎসাধীন আব্দুল্লাহর ইন্তেকাল

আন্দোলনে আহত চিকিৎসাধীন আব্দুল্লাহর ইন্তেকাল

শিবালয়ে যমুনার তীরে অগ্নিকাণ্ডে পুড়লো ড্রেজারের প্লাস্টিক ফ্লোটার

শিবালয়ে যমুনার তীরে অগ্নিকাণ্ডে পুড়লো ড্রেজারের প্লাস্টিক ফ্লোটার

জকিগঞ্জে পুলিশের অভিযানে সাজাপ্রাপ্ত আসামী গ্রেফতার

জকিগঞ্জে পুলিশের অভিযানে সাজাপ্রাপ্ত আসামী গ্রেফতার

বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল আবিস্কার হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে

বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল আবিস্কার হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে

১৩ শতাধিক সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়

১৩ শতাধিক সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়

হাজি সেলিমের ছেলে সোলায়মান গ্রেপ্তার

হাজি সেলিমের ছেলে সোলায়মান গ্রেপ্তার

সিলেট বিমানবন্দর সড়কে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হলো এক কলেজ ছাত্রের !

সিলেট বিমানবন্দর সড়কে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু হলো এক কলেজ ছাত্রের !

ঝালকাঠিতে ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু

ঝালকাঠিতে ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু

ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট ভবনের বাইরে বিস্ফোরণ,নিহত ১

ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট ভবনের বাইরে বিস্ফোরণ,নিহত ১

পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা : অ্যাটর্নি জেনারেল

পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা : অ্যাটর্নি জেনারেল