ঢাকা   সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ | ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আজ কিশোরগঞ্জের দানবীর, শিক্ষানুরাগী ওয়ালী নেওয়াজ খান এর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী

Daily Inqilab কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি

২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ এএম | আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১২ এএম

 

ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজ ও আরজত আতরজান উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালী নেওয়াজ খানের ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে “ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজ”, “আরজত আতরজান উচ্চ বিদ্যালয়” নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ওয়ালী নেওয়াজ খান সাহেবের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা তার মাজার জিয়ারত করবেন বলে জানা গেছে।
ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজ সূত্রে জানা গেছে, সকাল ৯টায় মরহুমের কবর জিয়ারত করে বেলা ১১ টায় কলেজ মিলনায়তনে এক আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করছে।

 

ওয়ালী নেওয়াজ খান এর সংগ্রামী ও আদর্শিক জীবনী: মানুষের মুক্তি, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাদর্শ, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষণ-মুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন ও সংগ্রাম ওয়ালী নেওয়াজ খানের জীবনের অন্যতম প্রধান দিক ছিল। ওই দিকটির সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে মানব ও শিক্ষার কল্যাণে আত্মনিবেদনের ব্রত। উত্তাল বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ইতিহাসে কিশোরগঞ্জের প্রেক্ষাপটে তিনি একজন স্বতন্ত্র ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সংগ্রামী গণরাজনীতি দিয়ে তাঁর জীবনের সূচনা আর সমাজ কল্যাণের ক্ষেত্রে আদর্শ স্থাপনকারী অবদানের মাধ্যমে তার সমাপ্তি। কিন্তু তার নশ্বর জীবনের ইতি হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কর্মের স্মৃতিতে তার ইতিহাসের সমাপ্তি হয়নি; এখনো অক্ষয় রয়েছেন তিনি।

 

রাজনৈতিক সংগ্রামে যারা আত্মত্যাগ ও জীবনবাজি রেখে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন তাদেরই একজন ছিলেন ওয়ালী নেওয়াজ খান। কৃষক, মজদুর ও নির্যাতিত সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আপসহীন এই সাহসী মানুষটি জীবনসায়াহ্নে এসে সর্বস্ব দান করে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য এক অনন্য প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়ে জনসাধারণের প্রতি তার ভালোবাসার নিদর্শন রেখে গেছেন।

 

ওয়ালী নেওয়াজ খান মানুষের অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শোষণ-মুক্ত সমাজেই কেবল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ফলে তিনি শোষণ-বঞ্চনা আর অনাচারের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। ছাত্রজীবনেই তিনি বিপ্লবী হয়ে উঠেছিলেন। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এজন্য তাকে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে এবং কারাবন্দিত্ব সহ্য করেও তিনি মানুষের কথাই বলে গেছেন। যতদূর জানা গেছে, তিনি প্রথম গ্রেফতার হন ১৯২৮ সালে এবং জীবনে সর্বমোট প্রায় ২৪ বছর কারাভোগ করেন।

 

বাল্যকালেই তিনি বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ময়মনসিংহ শহরে ওই সময় একটি ঘটনা থেকেই তার বিপ্লবী চেতনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। ছাত্ররা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছিল। আন্দোলনের অংশ হিসেবে একদিন ছাত্ররা স্কুলের ফটকে শুয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। ওই সময়ের ময়মনসিংহ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রাহাম ফটকে শুয়ে থাকা ছাত্রদের মাড়িয়ে স্কুলে প্রবেশ করছিলেন। এ অবস্থায় বালক ওয়ালী নেওয়াজের রক্তে স্ফুলিঙ্গ বয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেটের এমন অমানবিক আচরণ তিনি সহ্য করতে পারেননি। আচমকা উঠেই তিনি মি.গ্রাহামের গায়ে ঘুষি মারেন এবং কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড়ে পালিয়ে যান। পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। তিনি চলে আসেন কিশোরগঞ্জ।

 

এ দেশের মানুষের প্রতি ব্রিটিশের ঘৃণ্য আচরণ বাল্যকাল থেকেই তাকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য তাকে পীড়া দিত ও বিক্ষুব্ধ করে তুলত। এ কারণেই তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নগেন সরকারের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ধীরে ধীরে কুলিয়ারচরের স্বদেশী-বিপ্লবী এবং পরবর্তী সময়ে ভারতখ্যাত সংগ্রামী নেতা মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনুশীলন সমিতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং মুক্তির জন্য বিপ্লবী পথকেই বেছে নেন।

 

ওয়ালী নেওয়াজ খান বিদেশি শাসক ও তাদের ঔপনিবেশিক শোষণের তীব্র বিরোধী ছিলেন। এ কারণে তিনি বৈপ্লবিক-বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং শোষণবিরোধী একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বদেশী আন্দোলন, ’৪২-এর আগস্ট আন্দোলন, ’৪৬ সালের দাঙ্গা প্রতিরোধ, তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, ১৯৪৮ সালে ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো মানুষ ভুখা হ্যায়’ ইত্যাদি আন্দোলনে কিশোরগঞ্জের পুরোধা ছিলেন কমরেড নগেন সরকার আর ওয়ালী নেওয়াজ খান।

 

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ওয়ালী নেওয়াজ খানকে সক্রিয় রাজনীতিতে আর দেখা যায়নি। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যতেই অবশিষ্ট সময় অতিবাহিত করেন। তবে তিনি স্থানীয় নির্বাচন ও অন্যান্য কয়েকটি নির্বাচনে নিজের পছন্দের ব্যক্তির পক্ষে বিশেষ করে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুল আউয়াল খানের জন্য কাজ করেছেন বলে জানা যায়। অনেকের মতে, আবদুল আউয়াল খান ওয়ালী নেওয়াজ খানের কারণেই পাকিস্তান আমলে এমপি এবং পরবর্তীকালে কিশোরগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা পরিষদেরও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

 

কিশোরগঞ্জ শহরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার প্রতি তার অনুরাগের বিষয়টি স্পষ্ট হলেও এর আগেই তিনি তার পিতা-মাতার নামে শহরের তারাপাশা এলাকায় আরজত-আতরজান হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে তিনি ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজ প্রতিষ্ঠা কওে কিশোরগঞ্জ জেলায় উচ্চশিক্ষা প্রসারে সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

 

কিশোরগঞ্জের মুদ্রণশিল্পেও খান সাহেবের অবদান ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ‘জুবিলি প্রেস’ নামে তার একটি ছাপাখানা ছিল। এটি শহরের একরামপুরে অবস্থিত ছিল। কিশোরগঞ্জে বিভিন্ন সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে এ প্রেসটির নাম বিশেষভাবে জড়িয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এ প্রেসটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

 

ওয়ালী নেওয়াজ খান সাহেব বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করেন ১৯৫০ সালে। তাঁর শশুর বাড়ী জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। স্ত্রী মিসেস আমেনা খানম। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। ওয়ালী নেওয়াজ খানের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তার স্ত্রী আমেনা খানমেরও অনুপ্রেরণা ছিল। স্বামীর প্রতিটি কাজে ও কঠিন সময়ে তিনি তাকে সাহস যুগিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক, সংস্কৃতিবান, শিক্ষানুরাগী ও স্বাধীনচেতা এ মানুষটি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের আজকের দিনে এই ২৫ নভেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান। এ উপলক্ষে ওয়ালী নেওয়াজ খান কলেজ পরিবার বছর বছর ২৫ নভেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে আসছেন।

 

 


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

কৃষি ব্যাংক ‘নবান্ন উৎসব’এ বরিশালে ৬৫ কোটি টাকার কৃষি ঋণ আদায় ও ৮৭ কোটি টাকা বিতরন করেছে
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
আরও

আরও পড়ুন

উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ইয়ামান্দু অর্সি

উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ইয়ামান্দু অর্সি

‘শেখ হাসিনা একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মহিলা’

‘শেখ হাসিনা একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মহিলা’

আমিরাতে ইহুদি ধর্মগুরু খুন, তিন সন্দেহভাজন গ্রেফতার

আমিরাতে ইহুদি ধর্মগুরু খুন, তিন সন্দেহভাজন গ্রেফতার

সিটি করপোরেশনকে জিম্মি করেছিলেন ফ্যাসিস্ট তাপস

সিটি করপোরেশনকে জিম্মি করেছিলেন ফ্যাসিস্ট তাপস

কৃষি ব্যাংক ‘নবান্ন উৎসব’এ বরিশালে ৬৫ কোটি টাকার কৃষি ঋণ আদায় ও ৮৭ কোটি টাকা বিতরন করেছে

কৃষি ব্যাংক ‘নবান্ন উৎসব’এ বরিশালে ৬৫ কোটি টাকার কৃষি ঋণ আদায় ও ৮৭ কোটি টাকা বিতরন করেছে

সমাবেশে যোগ দিতে আসা ১০টি যাত্রীবাহী বাস আটক

সমাবেশে যোগ দিতে আসা ১০টি যাত্রীবাহী বাস আটক

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন রাষ্ট্রপক্ষের

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন রাষ্ট্রপক্ষের

নিজ্জর-হত্যায় : ৪ ভারতীয়ের বিচার শুরু

নিজ্জর-হত্যায় : ৪ ভারতীয়ের বিচার শুরু

ম্যানিলার বন্দর এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড,শতাধিক বাড়ি পুড়ে ছাই

ম্যানিলার বন্দর এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড,শতাধিক বাড়ি পুড়ে ছাই

ঢাকায় পণ্যবাহী ট্রেনের ৩ বগি লাইনচ্যুত

ঢাকায় পণ্যবাহী ট্রেনের ৩ বগি লাইনচ্যুত

১৯ দিন পরও ঘোষণা হয়নি ক্যালিফোর্নিয়ার ফলাফল

১৯ দিন পরও ঘোষণা হয়নি ক্যালিফোর্নিয়ার ফলাফল

ভারতে ‘যৌন ব্যবসায়’ বাধ্য করা হচ্ছে বাংলাদেশি তরুণীদের

ভারতে ‘যৌন ব্যবসায়’ বাধ্য করা হচ্ছে বাংলাদেশি তরুণীদের

মসজিদ ঘিরে উত্তেজনা : ভারতে গুলি করে ৩ মুসলিমকে হত্যা

মসজিদ ঘিরে উত্তেজনা : ভারতে গুলি করে ৩ মুসলিমকে হত্যা

ব্রাজিলে যাত্রীবাহী বাস খাদে, ২৩ জনের প্রাণহানী

ব্রাজিলে যাত্রীবাহী বাস খাদে, ২৩ জনের প্রাণহানী

৭ রানে অলআউট হয়ে বিশ্বরেকর্ড

৭ রানে অলআউট হয়ে বিশ্বরেকর্ড

পিটিআইয়ের বিক্ষোভ : ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

পিটিআইয়ের বিক্ষোভ : ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা: শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা: শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

আদানির বিরুদ্ধে এবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা

আদানির বিরুদ্ধে এবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেন যে ৩ বিচারক

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেন যে ৩ বিচারক

ইসরায়েলে হামলা চালানোর সব প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান

ইসরায়েলে হামলা চালানোর সব প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান