কলাপাড়ায় পৌর জলাধার এখন আবর্জনার ভাগাড়, শুধু ময়লা-আবর্জনা ও পরিত্যক্ত পলিখিনের স্তপের পাহাড়
০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪২ পিএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪২ পিএম
নাগরিক সচেতনতার অভাবসহ সংশ্লিষ্টদের অপরিণামদর্শিতা-উদাসীনতার কারণে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভা জলাধারগুলো।
সেই সঙ্গে জলাধার নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ আইন উপেক্ষা করে চলছে বিক্রি ও ভরাটের মহোৎসব। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ও অপকৌশলের খেসারত দিচ্ছে নগরের গুরুত্বপূর্ণ সব জলাধার। এ পরিস্থিতিতে দিন দিন পরিবেশ হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। নগরে বাড়ছে অগ্নিনির্বাপণ ঝুঁকির আশঙ্কা। শুধু ময়লা-আবর্জনা ও পরিত্যক্ত পলিখিনের স্তপের পাহাড় করে ভরাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছে।
গত দেড় যুগে এখানে অন্তত চার হাজার পুকুর ভরাট করা হয়েছে। অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়ার স্বার্থে ব্যক্তি মালিকানা পুকুর ভরাট চলছে। আর এর ভয়াবহ বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে গোসল, রান্নাসহ নিত্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারন করেছে। নিরাপদ পানির সঙ্কটে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে ডায়রিয়াসহ পেটের পীড়াজনিত নানান রোগ বালাইয়ে।
পৌরসভা সুত্রে জানা গেছে, কলাপাড়া পৌরসভার যাত্রা শুরু ১ লা মার্চ ১৯৯৭ সালে। ৯টি ওর্য়াড নিয়ে গঠিত পৌরসভার আয়তন ৩.৭৫ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমান জনসংখ্যা ১৯৭৮২.০০জন (২০১১সালের আদম শুমারী অনুযায়ী পুরুষ-৯৯৪৪.০০জন ও মহিলা ৯৮৩৮.০০জন। ভোটার ১২ হাজার আটশত একানব্বই জন। ২০১৫ সালে পৌরসভাটি প্রথম শ্রেনির মর্যদা লাভ করে।
সরেজমিনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, কী ভাবে পুকুর ভরাট করা হয়েছে। যে যেভাবে পারছে পুকুর ভরাট করছে। ভরাট করে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তোলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পুকুর ভরাট হয়েছে কলাপাড়া পৌর শহরে। এখানে অন্তত চার শ’ পুকুর ভরাট করা হয়েছে। ড্রেজার লাগিয়ে বালু দিয়ে ভরাট করে সেখানে তোলা হয়েছে স্থাপনা। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এসব পুকুরের পানি মালিকসহ আশপাশের পড়শিরা গোসল, রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করত। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে পৌরশহরে পৌরসভার পানির সরবরাহ এক দিন বন্ধ থাকলে জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। মানুষ চরম বিপাকে পড়ছেন। ব্যক্তি মালিকরা পুকুর ভরাট করা ছাড়াও সরকারি বেসরকারি সংস্থাও পুকুর ভরাট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন পৌর শহরের এতিমখানা পুকুরটি ভরাট করে সেখানে পৌর ভবন তোলা হয়েছে। ওই পুকুরটির পানি প্রতিদিন অন্তত হাজারো মানুষ গোসল রান্নাসহ নিত্যকাজে ব্যবহার করত। এভাবে শহরের পুকুর ভরাট চলছে দেদারছে। পুকুর ভরাট করে এই অঞ্চলে মানুষ বসবাসের চিরচেনা বাড়িঘরের আদল বদলে ফেলছে। পুকুর ভরাটের কারনে ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার আশঙ্কা জনকহারে কমে যাচ্ছে। বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার। চাপ পড়ছে গভীর নলকূপের ওপরে। গোসলের সময় ভিড় লেগে যায়। ইতোমধ্যে শতাধিক গভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। পানির স্তর অঞ্চল ভেদে তিন থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে গেছে। পুকুর ভরাটের কারনে ব্যবহারের পানির সঙ্কটে গ্রামাঞ্চলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে।
পটুয়াখালী বরগুনা মৎস চাষ সম্প¯্রারণ প্রকল্প পরিচালিত ১৯৯৮ সালের এক জরিপের তথ্যমতে কলাপাড়ায় মোট পুকুর সংখ্যা ১৭ হাজার এক শ’ ৩৪ টি। এর মধ্যে বড় পুকুর (এক হাজার বর্গ মিটারের বেশি) ছিল ১৫৬৪টি। মাঝারি পুকুর ১০ হাজার ৫৪ টি। ছোট পুকুর ছিল পাঁচ হাজার দুই শ’ ৭৮টি এবং ডোবা ছিল ২৩৮টি। এছাড়া খাস পুকুর ছিল ১০৮টি। কিন্তু বর্তমানে অর্ধেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ওই তথ্যমতে কলাপাড়া পৌর শহরের পুকুর সংখ্যা ছিল ৬৪০টি। সেখানে এখন ব্যবহারের পানি তো দুরের কথা। মানুষ বসবাস করাও দুরুহ হয়ে গেছে। সেখানকার হাজারো লোকজন এসবের প্রতিবাদে কয়েক বছর আগে মানবন্ধন পর্যন্ত করেছে। কলাপাড়া পৌরসভায় সরকারি হিসাবে ২৪টি খাস পুকুর রয়েছে। তার অর্ধেক এখন ভরাট হয়ে গেছে। নাচনাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় একটি খাস পুকুর ভরাট করে সেখানে এখন ফ্রিÑস্টাইলে তোলা হয়েছে স্থাপনা। মানুষ বর্জ্য ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করেছে। বর্তমানে ফ্রি-স্টাইলে তাৎক্ষণিক লাভের আশায় পুকুর ভরাট করে নিরাপদ পানির ব্যবহারে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রাকৃতিক জলাধার আইনানুসারে কোন ধরনের পুকুর ভরাট করার সুযোগ নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আইনের প্রয়োগ নেই। পৌরপরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ পরিবেশ অধিদফতর রয়েছে। কিন্তু মানুষের সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন নিরাপদ পানির উৎসগুলো পুকুর দেদার নষ্ট হয়ে গেলেও তারা রয়েছেন নির্বিকার। কোথাও কোন আইনের প্রয়োগ নেই। সামাজিক কোন দায়বদ্ধতা পর্যন্ত নেই।
পরিবেশ বিশেষঞ্জের মতে পৌর এলাকায় ব্যক্তিগত ভাবে পুকুর খনন কিংবা ভরাটের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া কত সংখ্যক মানুষের ব্যবহারের জন্য কতটি পুকুর দরকার তা সংরক্ষণের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের। ইতিপূর্বে পরিকল্পিতভাবে যেসব পুকুর জনস্বার্থে সংরক্ষণ করা দরকার তা রক্ষার্থে কয়েকটি পুকুর পুনর্খনন করার উদ্যোগ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর ধারবাহিকতা বজায় থাকেনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রের দাবি, জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোনো পুকুর বা জলাধার ভরাট করার সুযোগ নেই। কিন্তু শহরের বেশির ভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলো রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে অগ্নিনির্বাপণ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। কিন্তু দিনে-রাতে ময়লা-আবর্জনা ও মাটি ফেলে এসব জলাধারের অধিকাংশ ভরাট করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বড় ধরনের অগ্নিকান্ড হলে পর্যাপ্ত পানির অভাবে অগ্নিনির্বাপণ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
মোজহার উদ্দিন বিশ্বাস সরকারি কলেজের উওর পাশের খাল ও পুর্ব পাশের খালটি আবর্জনা ও মাটি ফেলে ভরাট করা হচ্ছে একের পর এক জলাধার। মোজহার উদ্দিন বিশ্বাস সরকারি কলেজ, হাজী আবদুস সোবাহান শিকদার মডেল একাডেমি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীরা ময়লা-আবর্জনার কারনে নাক ছেফে ধরে যেতে হয়।
এ দিকে পৌরসভার ভিতর দিয়ে একটি খাল প্রবাহিত হয়েছে "চিংগরিয়া খাল" নামে পরিচিত। খালটি খেপুপাড়া মৌজায় আন্ধারমানিক নদী হতে উৎপন্ন হয়ে পৌরসভার ১ থেকে ৭ নং ওয়ার্ডের অংশ বিশেষের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে প্রায় ৪ কিলোমিটার পথ অতিক্রম শেষে একই মৌজার চাকামইয়া-নিশানবাড়িয়া নদীর (দোন) সাথে মিশেছে। ভূমি অফিসের তথ্যানুযায়ী খালটির মূল ¯্রােতধারা খেপুপাড়া মৌজার ৪৪৩, ৫২৬ ও ৮৪২ নং দাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত। খালটি পৌরসভার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র খাল। ৫০০০ পৌর বাসীর কাছে এ খালের গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষিকাজ, পানি নিষ্কাশন, জলাবদ্ধতা নিরসনসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার্য পানির একমাত্র উৎস এ খালটি। পৌরসভাটি উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় প্রতিবছর বর্ষাকালে ও জলোচ্ছাসের সময় সমুদ্রের লোনা পানিতে এখানকার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ডুবে যায়। লবণাক্ত এ পানি এ খাল দিয়েই দ্রæত নিষ্কাশিত হয়ে থাকে। জনগুরুত্বপূর্ণ এ খালটি উপজেলা ভূমি অফিস খাল হিসেবে চিহ্নিত ভূমির শ্রেনী নাল হিসেবে পরিবর্তন করে। বন্দোবস্ত গ্রহীতাগণ খালের অংশে বার্ধ দিয়ে মাছ চাষ করার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় খাল ভরাট করে নির্মাণ করেছে বিভিন্ন স্থাপনা। জলাবদ্ধতায় ফসল ফলাতে পারছে না শত শত একর জমির মালিকগণ। খালের ভূমি রেকর্ড সংশোধন ও শ্রেনী পরিবর্তন এবং বেআইনিভাবে প্রদানকৃত বন্দোবস্ত বাতিলসহ খালটি যথাযথ সংরক্ষণে বেলা একটি মামলা দায়ের করে।
কলাপাড়া হাসনপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: জেএইচ খান লেলিন প্রতিবেদককে জানান, পুকুর ভরাটে নিরাপদ পানির সঙ্কট রয়েছে। এর ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগব্যধি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি জীবন যাপনে ভয়াবহ বিপর্যস্ত পরিবেশের শঙ্কা রয়েছে।
কলাপাড়া ফায়ার সার্ভিস স্টোন অফিসার মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, পৌর শহরে পুকুর, খাল যাতে কেউ ভরাট ও ময়লা আবর্জনা ফেলে পানিকে দুষিত করতে না পারে এ জন্য নির্বাহী কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসনসহ আমাদেরকে নিয়ে কাজ করতে চাই। কারন এক সময় নগরে বাড়ছে অগ্নিনির্বাপণ ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। পৌরসভা জলাধারগুলো আইন উপেক্ষা করে চলছে বিক্রি ও ভরাটের মহোৎসব। এজন্য পানির দরকার আছে। কিন্তু পানি পাবে কোথায়।
কলাপাড়া পৌরসভার প্রশাসক ও নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, পৌরসভা খাল গুলো যাতে দখল না হয় ময়লা আবর্জনা না ফেলতে পারে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি প্রতিবেদকে জানান।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪
মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫
সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই
ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের
গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের
শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা
বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা
এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা
দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম
বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের
ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?
আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু
বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ
রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী
ধূমপানকে না বলুন
জালিমের পরিণতি ভালো হয় না
অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি
মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়
১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত