তৌহিদের সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরের সদর উপজেলার ইটাল্লা গ্রামে। এই গ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন মোখলেছুর রহমান। তিনি স্থানীয় বামইল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক ছিলেন। ২০০৬ সালে অবসরে যান। গত রোববার প্রবীণ এই শিক্ষকের মৃত্যুতে ইটাল্লাসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ যেভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন, তেমনি গত শনিবার বিকেলে প্রয়াত ওই শিক্ষকের দ্বিতীয় সন্তান স্থানীয় যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের জানাযায় হাজারো মানুষ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কারণ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত যুবদল নেতা ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবী তৌহিদকে কথিত অস্ত্রের সন্ধান বের নামে যৌথবাহিনী তাদের হেফাজতে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের মতো এক জঘন্য ঘটনার অবতারণা করে। আর এই নিষ্ঠুরতম ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রতিবাদ জানায় দেশের সর্বস্তরের মানুষ। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও এই বর্বরতম ঘটনার নিন্দা ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেছেন।
কুমিল্লার ইটাল্লা গ্রামের সাধারণ মানুষ যৌথবাহিনীর হেফাজতে অমানবিক নির্যাতনে তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। যুবদল নেতা তৌহিদকে যৌথবাহিনীর হেফাজতে কী জঘন্যভাবে নির্যাতন করা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী ইটাল্লা গ্রামের লুৎফুর ও তার চাচী লিলুফা বেগম বর্ণনা শুনে আর নির্যাতনের শরীরের একটি অংশের ছবি দেখলে মানুষ আঁতকে ওঠবে। আইনের পোষাক পড়ে কতোটা নিষ্ঠুর ও বর্বর হলে সাধারণ মানুষের ওপর এভাবে নির্যাতন চালানো যায় এর জ¦লন্ত উদাহরণ তৌহিদের শরীরের নির্যাতনের চিহ্নগুলো।
শনিবার বিকেলে ইটাল্লা গ্রামে যৌথবাহিনীর হেফাজতে অমানবিক নির্যাতনে নিহত যুবদল নেতা তৌহিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার ভাই, বোন ও স্বজনরা বাড়ির বিরাটাকার উঠোনের এদিক-সেদিক জড়ো হয়ে বসে আছেন। কেউ এখনো কান্না সংবরণ করতে পারছেন না। প্রতিবেশিরা এস সান্তনা দিচ্ছেন। নিহত তৌহিদের ছোট ছোট তিন কন্যা নিশ্চুপ হয়ে চেয়ারে একসঙ্গে বসে আছে। আড়াই বছর বয়সী হুমায়ারা ঘরে তার মায়ের কাছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকালের ঘটনার বর্ণনা দিতে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
তৌহিদের বড় বোন সাহিনুর আক্তার মিনা। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ওনার ৪ ছেলে ও ৩ মেয়েকে নৈতিক শিক্ষায় বড় করে তুলেছেন। আমার ভাইদের নামে এলাকা বা কোথায় কোন খারাপ রেকর্ড নেই। একটি কথিত অস্ত্র উদ্ধারের নামে আমার ছোট ভাই তৌহিদকে তার ঘর তল্লাশির পরও কোন অস্ত্র না পেয়ে সকালে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু সকালে আমার ভাইয়ের লাশ ফেরত পেয়েছি। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সেনাবাহিনী ও সিভিল পোষাকে মুখোশধারি চারজন আমার ভাইকে তুলে নেওয়ার সময় যে আলামত করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। পরদিন সকালে আবারও তারা এসে গ্রামের মানুষ যাকেই সামনে পেয়েছে তাকেই লাঠিপেটা করেছে। সেনাবাহিনী আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাস ও নিরাপত্তার প্রতীক। তাহলে তারা কেন এই নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটালো। আমার ভাইকে মেরেই ফেলতে হবে কেনো। কী অপরাধ ছিল আমার ভাইয়ের। আজকে একটি পরিবারকে পথে বসিয়েছে। চারটি অবুঝ কন্যা সন্তান আর তার স্ত্যরি ভবিষ্যত অনিশ্চিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে কথিত অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানে আসা সেনাবাহিনীর লোকগুলো। মনে রাখবেন, ওই চারটি নিষ্পাপ বাচ্চার দীর্ঘশ্বাসে তারাও ধ্বংস হবে। আল্লাহ ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না।’
তৌহিদের ওপর কী বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, এরকম ছবি মোবাইলফোনে দেখিয়ে তৌহিদের বড় ভাই ঢাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ি সাদেকুর রহমান টিপু বলেন, ‘এমন পৈশাচিক ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। আমার ভাইয়ের কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত বর্বর নির্যাতনের কালো ফোলা জখমের চিহ্ন। পেট, বুক, পিঠ, পা, গলাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে শুধুই নির্যাতনের চিহ্ন। ছবিতে তো শরীরের এক অংশ দেখালাম। আমরা যারা তৌহিদের পুরো শরীর দেখেছি, স্থির থাকতে পারিনি। গতকাল (শনিবার) রাত পৌনে আটার দিকে আমি, তৌহিদের স্ত্রী, আমার দুই ভাগ্নি ও তাদের পিতা কুমিল্লা সদর সেনা ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। সেখানে ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার এনাম, লে. কর্ণেল মাহমুদুল হাসানসহ ৪জন সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের এ ঘটনার বিষয়ে কথা বলেছি, আমরা মোবাইলফোনে ছবিগুলো দেখিয়েছি। আমরা বলেছি, সেনা সদস্যদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর অভিযানে মুখোশপরা চারজন সাদা পোষাক পরিহিত লোক ছিলেন। তারাও আমার ভাইকে পিটিয়েছে। তখন উপস্থিত সেনা কর্মকর্তারা বলেন, তারা আমাদের কাছ থেকে এখনই মুখোশপরা সাদা পোষাক পরিহিত লোকের বিষয়টি জানতে পেরেছেন এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। সেনা কর্মকর্তারা আমাদের মামলার বিষয়ে বলেছেন, আমরা যেখানেই মামলা করি তারা আমাদের সবধরণের সহযোগিতা করবেন। রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে সেনা কর্মকর্তারা কথা বলেছেন।’
তৌহিদের পার্শ্ববর্তী বাড়ির ৭০ বছর বয়সী লিলুফা বেগম জানান, বৃহস্পতিবার রাতে সেনাবহিনীর লোকজন ও সাদা পোষাকের লোকজন আমার বাড়িতে এসে ছেলে কাউসারকে খোঁজ করে। সে বাড়িতে ছিল না। তখন আমার ভাসুরের ঘরের দরজা ধাক্কা দিলে ভাসুরের ছেলে লুৎফুর বের হয়। তখন তাকে হাবিব নামে একজনের কতঅ জিজ্ঞেস করলে সে বলে আমি চিনি না। তখন লুৎফুরকে বলে তুই হাবিব, চল বলেই পিটিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। শুক্রবার সকালে তারা আবার আসে। তখন আমার ছেলে ও ছেলের বউকে না পেয়ে আমার ঘরের ভেতর তননছ করে। বাড়ির সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই মেরেছে। আমার বাড়ির উঠানে তৌহিদকেও পিটিয়ে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়।’
এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লুৎফুর রহমান জানান, ‘তাকে বৃহস্পতিবার রাতে হাবিব নামেই আটক করে পিটিয়ে গাড়িতে তুলে চানপুর থেকে আরেকজনকে আটক করে। এসময় তৌহিদ গাড়িতেই ছিল। আমাদেরকে ঝাকুনিপাড়া গোমতী বেরিবাধের কাছে বন্ধ হয়ে যাওয়া গোমতী বিলাস রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায় সেখানে আমাদের তিনজকেই সেনাবাহিনীর লোকেরা পিটায়। তখন আমার চোখ খুলে দেয়। রাতভর ও সকাল পর্যন্ত একধরণের পাইপ দিয়ে পিটিয়েছে তৌহিদকে। পিটায় আর জিজ্ঞেস করে অস্ত্র কই। শুক্রবার ফজরের আজানের পর আমাদেরকে নদীতে নামিয়ে পিটিয়ে বলে ওজু করতাম। তখন আমরা ওজু করি। এরপর বলে তোরা তিনজন নামাজ পর, তৌহিদ ইমামতি কর। তখন তো তৌহিদ দাঁড়াইতেই পারতেছিল না। তখন ধমক দিয়ে কয়, নামাজ পড়। নামাজ শেষ হলে আমাকে আর চানপুরের ছেলেটাকে আর পিটায়নি। তখন কেবল একটু পর পর তৌহিদকে পুরো শরীরে পিটাতে থাকে, পেটে কী যেন দিয়ে খোঁচা মারতে থাকে। ওনি চিৎকার দিতে লাগলে মুখ চেপে ধরে রাখে সিভিল পোষাকের লোকেরা। এরপর সকাল আটটার দিকে আমাকে আর তৌহিদকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যায়। এরআগে চানপুরের ছেলেটাকে ছেড়ে দেয়। আমাদের বাড়িতে গিয়ে কাউসারকে না পেয়ে তার মাকে অকথ্য গালাগালি করে, এলাকার লোকজন যারাই দেখতে এসেছে তাদেরকেই দৌড়ে দৌড়ে পিটিয়েছে। এখানেও তৌহিদকে পিটাইতে পিটাইতে আমাদের বাড়ির উঠান থেকে সিভিল পোষাকের লোকেরা ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। আমাকে ছেড়ে দেয়। এরপর তো ১২টার দিকে খবরই আসে তৌহিদ মারা গেছে।’
ইটাল্লা গ্রামের অনেকেই জানান, গ্রামের ভদ্র ও নম্রস্বভাবের তৌহিদুল ইসলামকে যারা নির্যাতন চালিয়ে মেরেছে, এটির সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় এবং একই সঙ্গে তৌহিদের পরিবারকে ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এই পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে নির্মম. নিষ্ঠুরভাবে যৌথবাহিনী অস্ত্র উদ্ধারের নামে ধরে নিয়ে মেরে ফেলার মাধ্যমে একটি পরিবারের স্বপ্ন্ শেষ করে দিল। তৌহিদের আড়াই বছর বয়সী মেয়ে এখনও জানে না তার বাবা বেঁচে নেই। সে তার বাবাকে খুঁজে। তার অন্য তিন মেয়ে যারা কাছ থেকে ঘটনাটি দেখেছে তারা নির্বাক, আতঙ্কিত। একদিন আড়াই বছরের শিশু হুমায়ারা বড় হয়ে যখন জানতে পারবে তার নিরাপরাধ বাবাকে সেনাবাহিনীর লোকজন অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে মেরে ফেলেছিল, সেদিন থেকে এই শিশুটির মনে এই বাহিনী সম্পর্কে ঘৃণা জন্মে ওঠবে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

সিকদার গ্রুপের ১৪ সদস্যের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা

সাগর-রুনী হত্যা মামলয় সাংবাদিক ফারজানা রুপাকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি

যারা টিউশনি করতো তারা হঠাৎ এতো টাকার মালিক হয়ে গেলেন ! বরকত উল্লাহ বুলু

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ‘জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ’ করতে বললেন তামিল মুখ্যমন্ত্রী

ধূমপান করা নিয়ে দুই তরুণীকে লাঞ্ছিত করা সেই রিংকু কারাগারে

মোংলা বন্দরের উন্নয়নসহ ক্রয় কমিটিতে ৬ প্রস্তাব অনুমোদন

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেন হাইজ্যাক

মস্কোয় ব্যাপক হামলা ইউক্রেনের

নারায়ণগঞ্জে ইটভাটা মালিক-শ্রমিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান

নারায়ণগঞ্জে সিএনজিচালক হত্যার দায়ে ৪ জনের যাবজ্জীবন

উপাধ্যক্ষ সাইফুর হত্যায় তরুণ-তরুণীকে সন্দেহ

নারায়ণগঞ্জে নিহত ছাত্রদল কর্মী অপূর্ব’র মা-বাবাকে তারেক রহমানের ফোন

প্রশাসনে ৩ কর্মকর্তার রদবদল

মাদক মামলায় খালাস পেলেন আলোচিত সেই মডেল পিয়াসা

হাসিনা-রেহানার-পুতুলের ১২৪ অ্যাকাউন্টে ৬৫৫ কোটি টাকা

চড়া সুদে দাদন ব্যবসা বন্ধে রুল

মাহে রমজানের শিক্ষা না নেয়ায় মানুষ ক্রমেই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে

শেখ হাসিনা বিদেশ থাকা সত্ত্বেও কেন দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা?

সিদ্ধিরগঞ্জের গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃত্যু বেড়ে ৪

প্রেসিডেন্টকে স্পিকারের শপথ পড়ানো প্রশ্নে রুল