কুমিল্লার অন্তত ১০ উপজেলায় গভীর নলকূপের মাত্রাতিরিক্ত আয়রনযুক্ত পানি ব্যবহারে একেকটি ইউনিয়নের প্রায় ৮০ ভাগ বাসিন্দা নানা সমস্যায় ভুগছেন। রোগবালাই থেকে শুরু করে শারীরিক ক্ষতি, গৃহাস্থলির মূল্যবান সামগ্রী নষ্ট এবং জনজীবনে দুর্ভোগ-ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। উদ্বেগজনক এই বিষয়টি নিরসনে কুমিল্লায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে জনদুর্ভোগ যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনি বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুমিল্লায় ‘সমগ্র বাংলাদেশে পানি সরবরাহ’ প্রকল্প হতে ৩০ হাজার এবং ‘আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ প্রকল্প হতে ২০ হাজার গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কুমিল্লা অফিস। পাঁচ বছর আগে শুরু হওয়া এই প্রকল্প এখনও চলমান রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬শ’ থেকে ৮শ’ ফুট গভীরে এসব নলকূপগুলো স্থাপনের পর বিশুদ্ধ সুপেয় পানি পাচ্ছিলেন ওইসব এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে বেশ কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার গভীর নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতি মিলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়রনের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে মুরাদনগর উপজেলায়। এছাড়াও দেবিদ্বার, হোমনা, দাউদকান্দি, তিতাস, চান্দিনা, বরুড়া, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় গভীর নলকূপের পানিতে আয়রনের মারাত্মক প্রকোপ রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, আয়রনযুক্ত পানি ব্যবহার করে শরীরে চুলকানি, পেটের পীড়া, মাথার চুল ঝরে পড়ছে। এছাড়াও এ পানিতে কাপড় ধোয়ায় রং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গোসলখানা, বেসিন, গৃহাস্থলি সামগ্রীতেও আয়রন জমে লালচে দাগ পড়ছে। এ পানি ব্যবহারে রান্নায় খাবারের স্বাদ ও রং পরিবর্তন হচ্ছে এবং দাঁতে ও ত্বকে বাদামি বা লালচে দাগ পড়া শুরু করেছে।
ভুক্তভোগীরা আরও জানান, দীর্ঘদিন ধরে পানিতে আয়রনের প্রকোপ চললেও এব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কুমিল্লার কর্মকর্তারা উদাসীন। আয়রন দুরীকরণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ না করলে এ দুর্ভোগ আরও বাড়বে। গভীর নলকূপ স্থাপনের সরকারি যে দুইটি প্রকল্প চলমান রয়েছে এটির সুবিধা যেমন নষ্ট হবে তেমনি আর্থিক অপচয়ও ঘটবে। ভুক্তভোগীরা এবিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন।
এবিষয়ে মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তৃপ্তীশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, 'আয়রনযুক্ত পানি ব্যবহার করাটা একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত ক্ষতির কারণ, তেমনি লম্বা সময়ের জন্য এরকম পানির ব্যবহার ত্বক ও চুলের ক্ষতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মানবদেহে ভিটামিন, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন প্রভৃতি সব উপাদানেরই প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যখন এই সমস্ত উপাদান শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত হয়ে যায়, তখনই বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এরমধ্যে শরীরে আয়রনের পরিমান বেড়ে গেলে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং কোষ নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে থাকে।'
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুল্লাহ বলেন, ‘কুমিল্লার বিপুলসংখ্যক মানুষের বিশুদ্ধ পানির জন্য ভরসা নিজস্ব বা সরকারি পর্যায়ের গভীর নলকূপ। কুমিল্লার ১৭ উপজেলার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিক না থাকলেও গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি আয়রন রয়েছে বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। ফলে এসব এলাকার মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে পারছেন না, এটি একটি বড় সমস্যা। আয়রন দুরীকরণে দেশে যেসব প্রযুক্তি চলমান রয়েছে, এটি ব্যবহারের মাধ্যমে এ সমস্যা নিরসন সম্ভব বলে আমি মনে করি। পানিতে আয়রন সংস্ক্রান্ত এই উদ্বেগজনক বিষয়টির সমাধান নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবো।’