শেরপুরে আড়াই শ’ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ- “মাইসাহেবা মসজিদ”
২০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১১ পিএম | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১১ পিএম

ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ শেরপুরের মাইসাহেবা মসজিদ। মসজিদটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসেন দেশী-বিদেশি অনেক পর্যটক। নামাজ পড়ে তৃপ্ত হন মুসল্লিগণ। মসজিদের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দা সাংবাদিক আবু হানিফ জানান, আনুমানিক আড়াইশো বছর আগে নির্মিত হয় মাইসাহেবা মসজিদ। দিনে দিনে মসজিদটিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বক্রাকারে খিলানের ব্যবহার ও স্থাপত্যকলার আধুনিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় মসজিদে। মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন এ মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। মাইসাহেবা মসজিদ শেরপুর জেলা সদরে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ। তৎকালীন সুসঙ্গ মহারাজার কাছ থেকে এ মসজিদের জমিটুকু দান হিসেবে পেয়েছিলেন মুসলিম সাধক মীর আব্দুল বাকি। জনশ্রুতি রয়েছে, মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ’র নিয়োগ প্রাপ্ত সুবেদার ছিলেন মীর আব্দুল বাকি। গড়জড়িপা কেল্লার দায়িত্ব নিয়ে তিনি সস্ত্রীক এখানে আ
আল্লাহর নৈকট্য লাভের কামনায় তিনি এতই ব্যাকুল হন যে, দিল্লীর সম্রাটের কাছে তার পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে বেরিয়ে পড়েন সুফি সাধকদের সহচার্যের আশায়। আর নিজেকে সমর্পিত করেন আল্লাহর ধ্যানে। এদিকে স্বামীর ইন্তেকালের পর ১৮৬১ সালে সালেমুন নেছা তার ভাগনে সৈয়দ আব্দুল আলীসহ স্থানীয় মুসলমানদের সহযোগিতায় দানের ওই জমিতে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। দুই কাতার বিশিষ্ট এ মসজিদে ৩৬ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারতেন। মসজিদ প্রতিষ্ঠার পর এ পূণ্যময়ী নারীর কৃতিত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন।
দিন দিন মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকায় মসজিদটি সম্প্রসারণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ১৯০৩ সালে আরও তিন কাতারের স্থান সংকুলান উপযোগী করে মসজিদ ভবন সম্প্রসারণ করা হয়। তার জীবদ্দশায় এ মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের সার্বিক দায়ত্বি তিনি নিজেই পালন করেন। সনালেমুন নেছা ছিলেন ইমাম হাসান (রা.) বংশধর। এ বংশের নারীদের মাইসাহেবা এবং পুরুষদের মিয়া সাহেব বলে ডাকা হতো। তার উপাধি অনুসারে মসজিদটির নাম হয় মাইসাহেবা মসজিদ। পরবর্তীতে মাইসাহেবা জামে মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন শক্তিধর সুসঙ্গ মহারাজাকে শেরপুর পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানান শেরপুরের নয় আনী জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী, তিন আনী জমিদার রাধাবল্লভ চৌধুরীসহ অন্যান্য জমিদারগণ। মহারাজা তাদের জানিয়ে দেন অন্যের জমিতে তিনি আহার ও রাত্রিযাপন করেন না।
এ সময় শেরপুরের জমিদারগণ তিন আনী বাড়ির পশ্চিমাংশের ২৭ একর লাখোরাজ সম্পত্তি মহারাজার নামে লিখে দিলে তিনি শেরপুরে আসেন। শেরপুর ছাড়ার সময় মহারাজা ওই সম্পত্তি তাম্র দলিলের মাধ্যমে মুসলিম সাধক মীর আব্দুল বাকিকে দান করেন। পরে দানকৃত এ জমিটি তিন আনী জমিদার রাধাবল্লভ চৌধুরী মসজিদ স্থানের ৮ শতাংশ জমি ছাড়া সমুদয় নিজ নামে সিএস রেকর্ডভূক্ত করে নেন। পরে তা নিজ দখলে নেন। এ সময়ে তিন আনী জমিদার দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। তার পাওয়ার অব এটর্নিমূলে ওই ৬৫ শতাংশ জমির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মরহুম ফরিদ উদ্দিন। তিনি পরে মসজিদের কাছে ওই জমিটি বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করেন। প্রায় আটাশ হাজার বর্গফুট জায়গার পশ্চিম দক্ষিণ বরাবর আদি মসজিদ ভবনটির অবস্থান ছিল। আদি কাঠামোটি মূলত ৪০ ইঞ্চি পুরুতের ইট, সুরকি ও চুনের মিশ্রণে গাঁথুনির দেওয়াল ছিল। মসজিদটির প্রস্থ ২০ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট। যার ছাদ তিনটি পাশাপাশি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। এ আদি রূপের মসজিদটির পাঁচটি প্রবেশ পথ ছিল। মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় শেরপুরের সৃজনশীল স্থপতি আব্দুল্লাহ ইবনে সাদিক (শাহীন) অনেকটা স্থাপত্যের সংমিশ্রণে আধুনিক রূপে বর্তমান মসজিদ স্থাপনাটির নকশা তৈরি করেন। শুভ্রতার প্রতীক সাদা রঙের প্রলোপনে তিনতলা বিশিষ্ট এ মসজিদ যা দুটি মিনার ও আটটি গম্বুজ দ্বারা অলংকৃত করা হয়েছে। যা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ইবাদতের প্রাণকেন্দ্র ও মুসলিম ঐতিহ্যের বাহক। বর্তমানে এ মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ ভবন কাঠামোর পূর্ব পাশে ৬টি পাশাপাশি দরজা বিশিষ্ট প্রধান প্রবেশ পথ রয়েছে। দক্ষিণ পূরবের সিঁড়ি এবং উত্তর পূরবের সিঁড়ির ঠিক পূর্ব পাশে প্রথম তলা ছাদের ওপর যে দুটি গম্বুজ রয়েছে তার নিচ বরাবর আরও দুটি প্রবেশ পথ রয়েছে। সরবপূরবে প্রধান প্রবেশ পথের ওপর উত্তর ও দক্ষিণ পাশে সু-উচ্চ দুটি মিনারের অবস্থান। এ মিনার দুটি একটি অন্যটির চেয়ে একটু ছোট। অপর দুটি গম্বুজের একটির অবস্থান প্রধান ফটকের দ্বিতীয় ছাদ বরাবর এবং অন্যটি সর্বশেষ ছাদের ওপর স্থাপন করা হয়েছে। মূল মসজিদ ভবনের ভিতরে নিচতলায় মাঝ বরাবর রয়েছে একটি কবরস্থান।
এখানে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সালেমুন নেছা, তার স্বামী মীর আব্দুল বাকি, ভাগনে সৈয়দ আব্দুল আলী, মসজিদের খতিব ও মসজিদ কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. মোহছেন, তার স্ত্রী উম্মে রেজা মরিয়ম, মসজিদের মোয়াজ্জিন আব্দুল জব্বারসহ আরও কয়েকজনকে দাফন করা হয়েছে। ২০০১ সালে মসজিদের মূল নকশার প্রথম অংশ অর্থাৎ দক্ষিণ-পশ্চিম কোন বরাবর প্রায় ৫ হাজার বর্গফুট বিশিষ্ট অংশটি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে উত্তর বরাবর প্রথম কাঠামোর স্থাপত্য রূপকে ঠিক রেখে প্রথম কাঠামোর প্রায় সমপরিমাণ জায়গা নিয়ে মসজিদটি বর্ধিত করা হয়। এ বর্ধিত অংশের পূর্বদিক বরাবর নিচতলার প্রায় অর্ধেক অংশে জ্যামিতিক আকৃতির ফোয়ারা সম্বলিত অজুখানা এবং এর সরব উত্তরে সৌচাগারের অবস্থান। বাকি পশ্চিম বরাবর সম্পূর্ণ অংশ মূল মসজিদের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। এছাড়া বর্ধিত অংশের পূর্বাংশের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি ইসলামিক সেমিনার কক্ষ ও একটি আধুনিক পাঠাগার। বিশাল এ মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে অনেক জায়গা। এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। একজন করে খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও তিনজন খাদেম মসজিদের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
মাইসাহেবা মসজিদে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ দান করে তৃপ্তিবোধ করেন। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও এখানে নিয়মিত দান করেন। মাইসাহেবা মসজিদে বয়স্কদের বিনামূল্যে কোরআন শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। অসংখ্য বয়স্ক মানুষ প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর শুদ্ধভাবে কোরআন ও তাজভিদ শেখেন। মসজিদটি পাহারা দেওয়ার জন্য দুজন পাহারাদার রয়েছেন। একজন মসজিদ কর্তৃপক্ষের অন্যজন পৌর কর্তৃপক্ষের। মসজিদসহ মসজিদ সংলগ্ন এলাকা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এ মসজিদ ভবন কাঠামোটি বর্ধিতসহ পূর্ব ও উত্তর দিকে আধুনিক ইমারত গড়ে তোলায় স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন এ মসজিদ ভবনটি একটি ইসলামিক কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও






আরও পড়ুন

ইবিতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাংবাদিককে বাধা দিলো সহ-সমন্বয়করা

মানিকগঞ্জে আ.লীগ নেতা ও সাবেক পৌর কাউন্সিলর উজ্জ্বল হোসেনে গ্রেফতার

পেকুয়ায় একদিনে কুকুরের কামড়ে শিশুসহ আহত- ২০

ছয় গোলের রোমাঞ্চ শেষে বার্সা-ইন্টার

চেন্নাইয়কে বিদায় করে শীর্ষ দুইয়ে পাঞ্জাব

সেমিফাইনালে হেরে আল নাসেরের বিদায়

দুদকের মামলা : আমানউল্লাহ আমান ও তার স্ত্রীর দন্ডাদেশ বাতিল

অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে অর্থনীতি আরো সঙ্কটে পড়েছে : রিজভী

বাংলাদেশ-মিয়ানমার একমত হলে করিডোর চালু করতে পারে জাতিসংঘ

কলকাতায় হোটেলে আগুন নিহত ১৪

ইউক্রেন খুব শিগগিরই ‘ধ্বংস’ হবে: ট্রাম্প

টঙ্গীতে বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়কে অবরোধ

প্রশ্ন : ঈদের বাজারে জীনদের বাজার করা প্রসঙ্গে।

ভ্যান চালক হত্যাচেষ্টা: অভিনেতা সিদ্দিকের ৭ দিনের রিমান্ডে

রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা ছাড়া রাখাইনে মানবিক করিডোর দেয়া থেকে বিরত থাকুন

প্রোটন বাজারে আনল দেশীয় অ্যাসেম্বল এক্স৭০ এসইউভি গাড়ি

হজযাত্রীদের জন্য বাংলাদেশি টাকায় রবির রোমিং প্যাকেজ

উত্তরপ্রদেশে মুসলিম ছাত্রের উপর অমানবিক অত্যাচার

দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি: কাজী শিপন

ফেনীতে প্রধান উপদেষ্টার আবাসন পেল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ পরিবার