দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২ নদ-নদী সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ অনুপস্থিত
২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৭ পিএম

বিগত মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির ব্যাপক ঘটতির পরে অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’য় ভর করে অকাল বর্ষণে আউশ ও আমনের ক্ষতির পরে নভেম্বর থেকে বৃষ্টির দেখা নেই। গত ফেব্রুয়ারী ও মার্চেও বরিশালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিকের যথাক্রমে ৯৫ ও ৯০ ভাগ কম। সাথে সীমান্তের ওপারে অভিন্ন নদ-নদী সমূহের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ সহ জলবায়ু পরিবর্তনে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের ছোট বড় ১৩২টি নদ-নদীতে নাব্যতা সংকটের সাথে লবণাক্তটার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাথে
ভূগর্ভস্থ পানিরস্তরও ক্রমশ নামছে। বরিশাল মহানগরীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিএডিসি কমপ্লেক্সে ভ’গর্ভস্থ পানি স্তর এখন ৮-৯ ফুট নিচে নেমে গেছে।
উজানে নিয়ন্ত্রণ সহ বৃষ্টির অভাবে প্রবাহ হ্রাসের ফলে সাগরের নোনা পানি বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলায় মেঘনার মূল প্রবাহ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে লবণাক্তটার মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। স্বাভাবিক ৫শ পিপিএম-এর স্থালে সাগর পাড়ের কুয়াকাটা থেকে ১১০ কিলোমিটার উজানে বরিশাল মহানগরীর পাশে প্রবাহমান কির্তনখোলা নদীতে এবার ৭শ অতিক্রম করেছে। পিরোজপুরের বলেশ^রে ১২শ এবং বরগুনার পাথরঘাটায় তা প্রায় আড়াই হাজারের ওপরে চলে যাচ্ছে। সাথে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামায় চলতি রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদকৃত প্রায় ৪ লাখ হেক্টরে বোরো ধানের কাঙ্খিত উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত নভেম্বর থেকে অনাবৃষ্টিতে বোরোধানে অব্যাহত সেচের ফলে উৎপাদনব্যায় বাড়ছে। সাথে ইতোমধ্যে শুরু হওয়ায় মাঝারী তাপ প্রবাহে বোরো ধানে বøাষ্টের সংক্রমনের শংকা বাড়ছে। পরিস্থিতি এড়াতে বোরো ধানের জমিতে অন্তত ৩ ইঞ্চি উচ্চতায় পানি রাখার তাগিদ দিয়েছেন কৃষিবীদগন। ফলে সেচ ব্যায়ের সাথে উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে।
অপরদিকে বৃষ্টির অভাবের সাথে সীমান্তের ওপারে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের ফলে নাব্যতা সংকট প্রকটাকার ধারন করায় নদ-নদীসমুহে প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হয়ে বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধিরও আশংকা করছেন নদী বিশেষজ্ঞগন।
ফলে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় কোটি মানুষের জন্য অতীতের আশির্বাদ এসব নদ-নদী যথাযথ সংরক্ষন ও উন্নয়ন সহ ভাঙন রোধে সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবের সাথে প্রকৃতির বিরূপ আচরনে ক্রমশ অভিশাপ হয়ে উঠছে। প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এসব নদ-নদী পরিবেশ সংকটে ক্রমশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুাখিন। একইসাথে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদীর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের প্রায় ৫শ কিলোমিটারে নাব্যতা সংকট ভয়াবহ। ফলে নদ-নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ সার্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব বাড়ছে।
অথচ সীমন্তের ওপারের অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর প্রবাহের ৭৮ভাগই উত্তরবঙ্গ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌছে দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ছোট বড় ১৩২টি নদ-নদী।
এমনকি নাব্যতা সংকটে প্রায় আড়াইলাখ টন উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও ক্রমশ বিপদগ্রস্থ করে তুলছে। সারা দেশের আহরিত ইলিশের ৭০ ভাগই যোগান দিয়ে থাকে দক্ষিণাঞ্চল। কিন্তু ক্রমাগত নব্যতা সংকটের রেশ ধরে প্রবাহ হ্রাস সহ দুষনে নদী-নদী থেকে ইলিশ উপক’ল ছাড়িয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যাবার প্রবনতা মৎস্য বিজ্ঞানীদের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
নদী বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেস করে। আর উজানের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যেতে দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা, তেতুলিয়া, বলেশ্বও, বিষখালী, বুড়িশ^র, আগুনমুখা সহ বিভিন্ন নদ-নদী যেমনি বর্ষা মৌসুমে দু কুল ছপিয়ে প্রবাহিত হয়, তেমনি নদী ভাঙনও তীব্র আকার ধারন করে। কিন্তু একই নদীতে শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ হ্রাসে নাব্যতা সংকট নৌ যোগাযোগ সহ মৎস্য ও কৃষি ব্যাবস্থাকে বিপন্ন করছে।
দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দর এবং সাদেশের সাথে নৌ যোগাযোগও দক্ষিণাঞ্চলে প্রবাহিত মেঘনা, তেতুলিয়া, কির্তনখোলা, বলেশ্বর, কঁচা, পায়রা ও গাবখান চ্যানেল সহ বিভিন্ন নদ-নদীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু মেঘনা সহ মাঝারী ও বড় নদ-নদীগুলোতেও নাব্যতা সংকটে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা সহ উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ যোগাযোগ ক্রমশ ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষ্ণীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রসস্ত ভাটি মেঘনায়ও ডুবো চরে ফেরি সহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে।
তবে প্রতি বছরই শুষ্ক মৌসুমে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের সিমিত কিছু নৌপথের নব্যতা ধরে রাখতে পলি অপসারন হলেও পুরো নদী ও তার প্রবাহকে সচল রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। অথচ এসব নদ-নদী পরিবশে, প্রতিবেশ এবং কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নের চাবিকাঠি হলেও তার সংরক্ষন ও উন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা এখনো নিশ্চিত হয়নি।
অথচ সারা দেশের নদ-নদীর প্রবাহ সচল রাখতে সর্বাধিক কার্যকরি ভ’মিকা রাখছে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদ-নদী। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষনের অভাবেই এসব নদ-নদীগুলোর অনেকগুলোই এখন অস্তিÍত্ব সংকটে। অথচ নৌপথে পন্য ও যাত্রী পরিবহন ব্যায় যেমনি অন্য যেকোন ক্ষেত্রের তুলনায় সাশ্রয়ী, তেমনি নিরাপদ।
২০২০ সালে ‘সেন্টার ফর এনভায়রমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস-সিইজিআইএস’ দক্ষিনাঞ্চলের ৩১টি নৌপথের ১ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার এলাকায় এক সমিক্ষায় নদীসমুহের নব্যতা বৃদ্ধি, প্রধান নৌপথের সাথে ঘাটসমুহের সংযোগ স্থাপন, সেচ ও পানি নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলজ সম্পদ বৃদ্ধি এবং নদী ভাঙন রোধের বিষয়ে প্রতিবেদন পেস করে । সমিক্ষাকৃত ৩১টি নৌপথের মধ্যে ৪৭০ কিলোমিটারে ৪২ মিলিয়ন ঘন মিটার পলি অপসারনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পাশাপাশি পরবর্তি ৭ বছরে সংরক্ষন ড্রেজিং-এর মাধ্যমেও আরো ১৭০ মিলিয়ান ঘন মিটার পলি অপসারনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কিন্তু পরবর্তিতে এ লক্ষ্যে কোন ‘উন্নয়ন প্রকল্প-প্রস্তাব,ডিপিপি’ অনুমোদিত হয়নি। তবে সিইজিআইএস-এর প্রস্তাবনার আলোকে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিপিপিতে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথের নদ-নদী সমুহের নাব্যতা উন্নয়ন এবং সংরক্ষন সহ লঞ্চঘাট সমুহের উন্নয়নে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশী প্রয়োজন হবে বলে জানা গেছে। তবে আরো বেশ কিছু বিষয় প্রকল্পটিতে অন্তভর্’ক্তির কথা বলা হলেও সে আলোকে এখনো বড় ধরনের অগ্রগতি নেই।
অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রের মতে ২০০৬ সালের জানুয়ারীতে বরিশালের কির্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০-৬৩০ পার্সেন্ট পার মিলিয়ন-পিপিএম। সেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে তা ৯১০ পিপিএম-এ পৌছে। ২০১৮ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ’১৯ সালে একই নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা আবার ৯শ পিপিএম-এ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু একই বছর ডিসেম্বরের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা বাড়তে শুরু করে। ২০২১-এর মার্চ থেকে পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে শুরু করে। এপ্রিলের শুরু থেকে বরিশালে কির্তনখেলায় লবনাক্ততার মাত্রা ১ হাজার পিপিএম অতিক্রম করে বলেও একাধীক সূত্র জানিয়েছে। এমনকি সাগরের লবনাক্ত পানি বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উজানে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা পর্যন্ত পৌছে যাচ্ছ। অপরদিকে গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে ২০২১-এর শুষ্ক মৌসুমে সর্বকালের সর্বোচ্চ ২১শ পিপিএম লবনাক্ততা সনাক্ত হয়েছিল। যা ২০১৬ সালে ছিল ১২শ পিপিএম। শুষ্কমৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলে অনেক নদ-নদীতেই লবনাক্ততার মাত্রা ক্রমশ সহনীয় মাত্রার বাইরে চলে যাচ্ছে। যা সুস্থ পরিবেশ সহ প্রতিবেশের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। উল্লেখ্য, মানব দেহের জন্য সহনীয় লবনাক্ততার মাত্রা ৬শ পিপিএম।
এমনকি নদ-নদীর প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হবার সাথে শুষ্ক মৌসুমে বরিশালে পানির স্তরও ক্রমশ নিচে নামছে। খোদ বরিশাল মহানগরীর দুই-তৃতীয়াংশ গভীর নলকুপেই শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকে পানি মিলছে না। অনেক নলকুপে লবনাক্ত পানি উঠে আসছে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক আমাদের কৃষি ও মৎস্য সম্পদ সহ সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির জন্য নদ-নদীর যথাযথ প্রবাহ অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পাশাপাশি সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় নদী বাঁচাতে অবিলম্বে যথাযথ সমিক্ষার মাধ্যমে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহনেরও তাগিদে দিয়েছেন শিক্ষক মন্ডলী।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও






আরও পড়ুন

গজারিয়ায় বোমা নিস্ক্রিয় করতে গিয়ে শতাধিক বাড়ি-ঘর ক্ষতিগ্রস্ত

ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সাহসী পদক্ষেপের আহ্বান জানালেন মির্জা ফখরুল

ভারতের ট্রানজিট সুবিধা বাতিলের পর পুনরায় প্রাণচাঞ্চাল্য ফিরে পাচ্ছে আশুগঞ্জ নদী বন্দর

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে যা বললেন অর্থ উপদেষ্টা

মহিপুরে সাবেক চেয়ারম্যানের বসতবাড়িতে ডাকাতি, স্বর্নালংকার ও টাকা পয়সা লুট

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে: প্রধান উপদেষ্টা

খুলনায় বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী গ্রপ্তার

চট্টগ্রামে পিপিপি ডিভিশনাল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত

ছোট ফেনী নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হচ্ছে তিনটি উপজেলার বিস্তৃর্ণ অঞ্চল

‘মানবিক করিডরের মাধ্যমে দেশের জনগণকে নিরাপত্তাহীন করবেন না’

মুকসুদপুরে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের মাঝে উপকরণ বিতরণ

গাজায় ভয়াবহ মানবিক সংকট, কচ্ছপের মাংস খাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন

ঢাকায় হেফাজতের মহা সমাবেশ সফল করতে লাকসামে প্রস্তুতি সভা

অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে কাজ করছে সরকার: বাণিজ্য উপদেষ্টা

হত্যাচেষ্টা মামলায় অভিনেতা সিদ্দিক ৭ দিনের রিমান্ডে

কুড়িগ্রামে শিয়াল মারা ফাঁদে বৃদ্ধের মৃত্যু

সিলেটে ঘর এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

এক ঠিকানায় সব নাগরিক সেবা দিতে শুরু হচ্ছে ‘নাগরিক সেবা’

ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে মন্দিরের প্রাচীর ভেঙে ৮ জন নিহত