বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক (এসডি) বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। রাজস্ব আদায় বাড়াতে গত ৯ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফল, জুস, পানীয় এবং সিগারেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুল্ক-কর বাড়িয়েছে। কিন্তু এর ফলে ভোক্তাদের ওপর বেড়ে গেছে খরচের বোঝা। এতে আসছে দিনগুলোতে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের কারণে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ার প্রতি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চির ধরবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
নতুন কর বৃদ্ধির প্রভাব ইতোমধ্যে খাদ্য, পানীয়, মোবাইল সেবা এবং রেস্তোরাঁসহ অতি প্রয়োজনীয় বা কম অপ্রয়োজনীয় উভয় ধরনের পণ্য-সেবায় পড়েছে। ব্যবসায়ী নেতারা এই সিদ্ধান্তকে "আত্মঘাতী" বলে অভিহিত করেছেন। এটি দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকেই বাধাগ্রস্ত করবে বলে সতর্ক করেছেন তারা। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেছেন, ভ্যাট-এসডি বাড়ার ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে, যা বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও তীব্রতর করবে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বাড়তি এই শুল্ক-কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেছে, এটি স্বল্প ও সীমিত আয়ের পরিবারের বাজেটকে আরও চাপে ফেলবে। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) বলেছে, সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ না করেই শুল্ক-কর বাড়ানোর এমন সিন্ধান্তের কারণে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে। এর ফলে ভোগব্যয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও ব্যাহত হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা রাজস্ব আদায় বাড়াতে পরোক্ষ করের ওপর সরকারের অতিমাত্রায় এই নির্ভরশীলতার সমালোচনা করেছেন। তারা বলেছেন, এ ধরনের উদ্যোগ সাধারণ মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান ভ্যাট বৃদ্ধির উদ্যোগকে "অদূরদর্শী" বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীর করে দিতে পারে। এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মূল্যায়নের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়নি। এমনিতেই দেশের কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৯.৯ শতাংশ। এই সমস্যাটি এখনও রয়ে গেছে।
সরকার প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়িয়েছে, যার মধ্যে রং এবং সিগারেট উল্লেখযোগ্য। মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত রং শিল্পের কাঁচামালের ওপর ৩০ শতাংশ এসডি আরোপ করা হয়েছে। যার ফলে এর দাম ৮-১৫ শতাংশ বেড়েছে। রাজস্ব আয়ের অন্যতম বৃহৎ খাত তামাক খাতে শুল্ক-কর ৭৬ থেকে ৮৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর প্রভাবে খুচরা বাজারে সিগারেটের দাম ইতোমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বাজারের ৮০ শতাংশ দখল করে রাখা নিম্নস্তরের সিগারেটের দামও বেড়েছে। শুল্ক-কর বাড়ানোর অন্যতম একটি উদ্দেশ্য সিগারেটের ভোগ কমানো। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে ফলে সিগারেটের অবৈধ বিক্রি বাড়তে পারে, যা শেষ পর্যন্ত রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সমালোচনার মুখে সরকার কিছু খাতে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে, যার মধ্যে আইসিটি খাত উল্লেখযোগ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মোবাইল সেবা, রেস্তোরাঁ, ওষুধসহ কয়েকটি পণ্য ও সেবার ওপরও শুল্ক-কর কমিয়েছে। কিছু পণ্যে শুল্ক-কর কমানোর সিদ্ধান্তকে কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব বলেছে, সাবান ও টিস্যু পেপারের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য এখনও অতিরিক্ত করের আওতায় রয়েছে, যা সাধারণ পরিবারের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।
রমজান মাস সামনে রেখে দৈনন্দিন পণ্যের ওপর বাড়তি ভ্যাট পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ক্যাব। ড. সেলিম রায়হানসহ অর্থনীতিবিদরা এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন। আয়করের ভিত্তি সম্প্রসারণ এবং রাজস্ব আয় বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রভাবিত স্বল্পমেয়াদি নীতিগুলো থেকে নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।