হঠাৎ বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, ভারতের উদ্দেশ্য কী ছিল?

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

১১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৬ এএম | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪১ এএম

ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা হঠাৎ করেই বাতিল করার সিদ্ধান্তটি অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকদের কাছে ‘অস্বাভাবিক’ ও কিছুটা রাজনৈতিক বলে মনে হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করছিল। ভারতের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে— কেন এই মুহূর্তে এমন সিদ্ধান্ত, এবং এর মাধ্যমে ভারত কী বার্তা দিতে চাইছে?

 

ট্রান্সশিপমেন্ট হলো একটি বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে এক দেশ তার পণ্য সরাসরি গন্তব্যে না পাঠিয়ে মাঝপথে অন্য একটি দেশের বন্দর বা ভূখণ্ড ব্যবহার করে তা রপ্তানি করে। একইভাবে আমদানির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। ২০২০ সালের ২৯শে জুন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ ভারতের সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর বা স্থলবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠাতে পারবে। তবে চলতি বছরের ৮ই এপ্রিল ভারতের কেন্দ্রীয় পরোক্ষ কর ও শুল্ক বোর্ড (CBIC) হঠাৎ করে এই সুবিধা বাতিল করে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মনে করা হচ্ছিল, বাংলাদেশ বড় বাণিজ্যিক সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি বাংলাদেশকে তেমন প্রভাবিত করবে না।

 

বিনিয়োগ সম্মেলনের সময়েই এই সিদ্ধান্ত আসায় অনেকেই মনে করছেন, এর পেছনে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেছেন, “ভারত দেখেছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে নিজের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে এবং এটি ভারত রাজনৈতিকভাবে পছন্দ করছে না।” তিনি মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত এমন একটি বার্তা বহন করে— “বাংলাদেশ যেন ভারতের প্রভাব বলয়ের বাইরে না যায়।” অর্থাৎ, একটি কৌশলগত অবস্থান থেকে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বনির্ভরতার পথে খুব বেশি এগোতে না পারে।

 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়স্বাল অবশ্য বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক নয়, বরং নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “২০২০ সালে বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে আমাদের বন্দর ও বিমানবন্দরে দীর্ঘদিন ধরে জট তৈরি হচ্ছিল। এতে সময় ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই এই সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে।” যদিও এই বক্তব্য বাস্তবতার কতটা প্রতিফলন তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।

 

যদিও বাংলাদেশ এখনো নেপাল ও ভুটানে পণ্য পাঠাতে পারবে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে, ইউরোপ বা পশ্চিমের দেশগুলোতে দ্রুত পণ্য পাঠাতে ভারতীয় বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগ আর থাকছে না। তৈরি পোশাক খাতসহ বেশ কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এই সুবিধার উপর নির্ভর করত। অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, “আমরা খুব বেশি পরিমাণে এই সুবিধা ব্যবহার করতাম না, তাই তেমন বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।” তবে গার্মেন্টস পণ্যের যে ‘সামান্য কিছু অংশ’ ইউরোপ বা আমেরিকায় যেত ভারতের মাধ্যমে, তা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এই রপ্তানিকারকদের বাংলাদেশ থেকেই বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

এদিকে দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এই সিদ্ধান্তকে ‘অপ্রত্যাশিত’ উল্লেখ করে বলেন, “আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে না, তবে সংকেতটা গুরুত্বপূর্ণ।” অর্থাৎ, ভবিষ্যতে ভারত যে যে কোনো সময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে বিষয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে বাংলাদেশকে। আর যেহেতু সিদ্ধান্তটি আগে থেকে জানানো হয়নি, তাই এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারেও প্রশ্ন তোলে।

 

তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমরা সংকট কাটাতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাজ করছি। আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঘাটতি যেন না থাকে, সে বিষয়েও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।” তিনি জানিয়েছেন, সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন ও খরচ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করছে এবং পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। এই বক্তব্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি আত্মবিশ্বাসী অবস্থান প্রতিফলিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আশাবাদের বার্তা দেয়।

 

অন্যদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে নেওয়া হয়েছে। দিল্লির সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলেছেন, “যেহেতু এখন হাসিনা সরকার নেই এবং বর্তমান সরকারের সাথে ভারতের সমন্বয় গড়ে ওঠেনি, তাই এখনই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।” এমনকি ভারতের পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা এই সুবিধা বন্ধের জন্য আগে থেকেই চাপ দিচ্ছিলেন বলে জানান তিনি। অর্থাৎ, একটি কৌশলগত অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং রাজনৈতিক সমন্বয়ের অভাবের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।

 

পরিশেষে বলা যায়, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সামনে এক নতুন বাস্তবতা হাজির করেছে। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়বে না বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। বাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন— বিকল্প বাণিজ্য রুট ও নিজস্ব অবকাঠামো শক্তিশালী করা। অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন যথার্থই বলেছেন, “এয়ার ট্রেড আরও সক্রিয় করতে হবে, যাতে ভারতের প্রতি নির্ভরতা কমে।” একইসঙ্গে, যোগাযোগ ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি এবং অর্থনীতি এখনো আন্তঃনির্ভরশীলতার একটি সূক্ষ্ম জালে আবদ্ধ। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা


বিভাগ : অর্থনীতি


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ভারত-নেপাল-ভুটান থেকে বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা
বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়ন ও বিনিয়োগ পরিবেশ সুরক্ষায় ন্যায্য জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের আহ্বান ইউরোচ্যামের
ট্যাপট্যাপ সেন্ড’ থেকে বিকাশ-এ রেমিটেন্স গ্রহণ করে বিজয়ীরা পেলেন মোটরবাইক ও ইকেক্ট্রনিক পণ্যের কুপন
বিনিয়োগ ও শিল্পে সুষম প্রতিযোগিতা নিশ্চিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের আহ্বান ফিকি’র
সোনালী ব্যাংকের নতুন ডিএমডি হলেন নূরুন নবী
আরও
X

আরও পড়ুন

মহিপুরে স্ত্রী হত্যা মামলার আসামীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে

মহিপুরে স্ত্রী হত্যা মামলার আসামীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধের প্রস্তাব

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধের প্রস্তাব

মারা গেছেন হিরো আলমের বাবা

মারা গেছেন হিরো আলমের বাবা

গাজায় ফের উত্তেজনা: ইসরাইলি-মার্কিন জিম্মির সঙ্গে ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন’, জানাল হামাস

গাজায় ফের উত্তেজনা: ইসরাইলি-মার্কিন জিম্মির সঙ্গে ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন’, জানাল হামাস

ভারতীয় ধারাবাহিকে ইসলাম অবমাননা, নেটিজেনদের ক্ষোভ প্রকাশ

ভারতীয় ধারাবাহিকে ইসলাম অবমাননা, নেটিজেনদের ক্ষোভ প্রকাশ

সিরিয়ায় সেনা উপস্থিতি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

সিরিয়ায় সেনা উপস্থিতি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র

দিনাজপুরে পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ

দিনাজপুরে পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের সড়ক ও রেলপথ অবরোধ

তাজউদ্দিন ও আইভি রহমানের নামে থাকা ২ জলযানের নাম পরিবর্তন

তাজউদ্দিন ও আইভি রহমানের নামে থাকা ২ জলযানের নাম পরিবর্তন

ধেয়ে আসছে দুর্বার সৌরঝড়! বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে সতর্কতা

ধেয়ে আসছে দুর্বার সৌরঝড়! বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বিশ্বজুড়ে সতর্কতা

সাভার ও আশুলিয়ায় ভিজিটিং কার্ডে চলছে গেস্ট হাউজের প্রচার!

সাভার ও আশুলিয়ায় ভিজিটিং কার্ডে চলছে গেস্ট হাউজের প্রচার!

দৌলতপুর উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বন করায় এক পরীক্ষার্থী বহিষ্কার

দৌলতপুর উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বন করায় এক পরীক্ষার্থী বহিষ্কার

আবারও শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ অঞ্চল

আবারও শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ অঞ্চল

কুয়েট ভিসির অপসারণ দাবিতে চবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

কুয়েট ভিসির অপসারণ দাবিতে চবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে দেশটির জনগণ : যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে দেশটির জনগণ : যুক্তরাষ্ট্র

ধানমন্ডিতে গাড়ি থেকে চাঁদাবাজী, সেই মাস্তান আটক

ধানমন্ডিতে গাড়ি থেকে চাঁদাবাজী, সেই মাস্তান আটক

ইউরোপে ১১ বছরের সর্বোচ্চ বন্যা-তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৪ সাল

ইউরোপে ১১ বছরের সর্বোচ্চ বন্যা-তাপপ্রবাহের রেকর্ড ভেঙেছে ২০২৪ সাল

মোরেলগঞ্জে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে ৯ শিক্ষক বহিষ্কার

মোরেলগঞ্জে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে ৯ শিক্ষক বহিষ্কার

কাতারে শেখ তামিম ও আল-শারার বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা

কাতারে শেখ তামিম ও আল-শারার বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা

ওটিটি কবে আসছে 'ব্যাচেলর পয়েন্ট–৫?'

ওটিটি কবে আসছে 'ব্যাচেলর পয়েন্ট–৫?'

ব্রিটেনের ওয়াটফোর্ডে মুসলিম কবরস্থানে  ৮৫টি কবর ভাঙচুর, তদন্তে পুলিশ

ব্রিটেনের ওয়াটফোর্ডে মুসলিম কবরস্থানে ৮৫টি কবর ভাঙচুর, তদন্তে পুলিশ