রমজান, কোরআন ও আরবি ভাষা
২৯ মার্চ ২০২৩, ০৭:১২ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৩৫ এএম
নুযূলে কোরআনের মহিমান্বিত মাস রমজান। আরবের মক্কা নগরীতে আল্লাহর সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.) জন্ম গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি নাযেল করেন সর্বশেষ কিতাব আল কোরআন আরবি ভাষায়। সিয়াম সাধনা অর্থাৎ মাসব্যাপী রোজা পালন এ মাসকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য দান করেছে। আরবি ভাষায় রমজান মাসে কোরআন নাযিল হওয়ায় এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহুগুণে বেড়ে গেছে। তাই এমাসের ধর্মীয় গুরুত্বের দিক বিবেচনা করে এবাদত বন্দেগীর মধ্যে কোরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব সর্বাধিক। তারাবীহর নামাজ ছাড়াও রমজানে কোরআন তেলাওয়াতের মর্যদা সর্বাধিক।
রমজানে কোরআন নাযেল হওয়ায় একদিকে এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যেমন বেড়েছে, তেমনি কোরআনের নানামুখী বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে খোদ মহানবী (সা.) গর্বের সাথে যে উক্তি করেছেন তা প্রণিধানযোগ্য, তিনি বলেছেন: আমি আরব এবং কোরআন আরবি ভাষায় এবং জান্নাতবাসীদের সেখানে বুলি হবে আরবি ভাষা।
হুজুর (সা.)’র এউক্তিতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: ১. তার প্রতি অবতীর্ণ সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ আল-কোরআন আরবি ভাষায়। ২. বেহেস্তে সকলের কথা বলার ভাষা হবে আরবি এবং সকল বেহেশতীকে আরবিতে কথা বলার শক্তি দেওয়া হবে।
বিশ^ময় হাজার হাজার ভাষা প্রচলিত। প্রত্যেক জাতি-সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে কিন্তু যারা মুসলমান, তাদের ইসলামী আচার অনুষ্ঠানাদি তথা এবাদত বন্দেগী রসুল (সা.) ও কোরআনের এ আরবি ভাষায় করার বিধান আসায় আরবি ভাষা সকল ভাষার সেরা হিসেবে দুনিয়াতেও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
যে কোন ভাষা-ভাষী মুসলমান মৃত্যুর পর তাকে ফেরেস্তারা প্রশ্ন করবেন আরবি ভাষায় এবং মৃত ব্যক্তিকে আরবি ভাষায় জবাব দেওয়ার ক্ষমতা দান করা হবে। যে ব্যক্তি জবাব দিতে না পারবে, আরবিতে বলবে ‘হা, হা, লা আদরি’Ñ আফসোস, আফসোস আমি জানি না। কোরআনের বিখ্যাত ভাষ্যকার ইবনে কাসীর এ মহাগ্রন্থের মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে শ্রেষ্ঠ মাস রমজানের বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন, তার ভাষায়: মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ কিতাব (কোরআন), নাযেল করা হয়েছে মর্যাদাময় শ্রেষ্ঠ ভাষায় (আরবি), মর্যাদাময় শ্রেষ্ঠ রাসুলের প্রতি (মোহাম্মাদ সা.), মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ফেরেস্তার (জিবরাইল আ.), মাধ্যমে সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ ভূখন্ড (মক্কায়) এবং ওটা অবতরণের সূচনা হয় বছরের শ্রেষ্ঠ মাসে, আর তা হচ্ছে রমজান। অতঃপর ওটা সব দিক দিয়ে পূর্ণতা লাভ করে। (তাফসিরে ইবনে কাসীর)
উক্ত উদ্ধৃতাংশে আরবি ভাষায় কোরআন নাযেল হওয়ায় কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে, তাতে রমজান মাসের বৈশিষ্ট্যও রয়েছে।
রমজান মহিমন্বিত মাস। এর মাহাত্ম্য কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আল-কোরআনকে এ মাসে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করে রমজানের মর্যাদা-শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি কোরআনকে মহিমান্বিত করেছেন এবং উভয়ের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। তাছাড়া কোরআনের ভাষা আরবিকে দুনিয়ার সকল ভাষার শীর্ষ মর্যাদা দান করেছেন। বস্তুত বিশুদ্ধতার দিক থেকে এটি সব ভাষারই সেরা, অর্থের ব্যাপকতা, সুবিন্যাস, গভীরতা, বাকরীতি প্রভৃতি অলংকার সূচক শব্দ কোরআনকে আকর্ষণীয়-মোহীয় করে তুলেছে। কোরআনের বাহক (মোহাম্মাদ সা.) আরব হওয়ায় আরবদেরকেই প্রথম উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অতঃপর তাদের মাধ্যমে চতুর্দিকে কোরআনের আলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কোরআন ও রমজানের মর্যাদা-মাহাত্ম্যের অন্ত নেই। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) এর একটি হাদীস উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: রোজা ও কোরআন শরীফ উভয়ই বান্দার জন্য শাফাআত-সুপারিশ করবে। রোজা আরজ করবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিবসে পানাহার হতে বিরত রেখেছি, আমার সুপারিশ কবুল কর এবং কোরআন বলবে, হে আল্লাহ! আমি রাতে তাকে শয়ন হতে বিরত রেখেছি, আমার সুপারিশ কবুল কর। অতঃপর উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। (আহমদ, তাবরানী, হাকেম প্রভৃতি)।
কোন কোন বর্ণনানুযায়ী, কোরআন মাজীদ যুবকের আকার ধারণ করে আসবে এবং বলবে, আমি তোমারই কোরআন, যে তোমাকে রাতগুলোতে জাগ্রত রেখেছে এবং দিবসগুলোতে অভুক্ত রেখেছে। তাছাড়া এ হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কালামুল্লাহ শরীফ হেফাজ বা মুখস্ত করার আবেদন হচ্ছে, রাতে তার তেলাওয়াত করা।
কোরআন শরীফ সম্পর্কে বেপরোওয়া থাকা কিংবা কোরআনকে উপেক্ষা-অবহেলা করে চলার পরিণতি সম্পর্কেও বিভিন্ন হদীসে সতর্কবাণী এসেছে। বোখারী শরীফের একটি দীর্ঘ হাদীসে এক ব্যক্তির পরিণতির বর্ণনা রয়েছে, যা রসুলুল্লাহ (সা.) কে মেরাজ সফরে প্রদর্শন করানো হয়। দৃশ্যটি হচ্ছে, লোকটির মাথায় সজোরে পাথর মারা হচ্ছিল, যাতে তার মাথা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। হুযুর (সা.) জিজ্ঞাসা করলে বলা হয়, লোকটিকে আল্লাহ তাআলা কালামে পাক শিক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু সে রাতে তা তেলাওয়াত করেনি, একদিনও তার উপর আমল করেনি। সুতরাং কেয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এঘটনা ঘটতে থাকবে। অর্থাৎ কোরআনের শিক্ষা লাভের পরও যে ব্যক্তি অবজ্ঞা, অবহেলা করে তা তেলাওয়াত করেনি এবং তার শিক্ষা অনুযায়ী আমল করেনি, তার যে কঠোর শাস্তি হবে, তার উদহরণ উপরোক্ত ব্যক্তি। যে ব্যক্তি নূযুলে কোরআনের মাস রমজানে কোরআন তেলাওয়াত ও তার শিক্ষা অনুসরণের সুবর্ণ সুযোগ অবহেলা-উদাসীনতায় হারিয়ে ফেলে, তার মত দুর্ভাগা আর কে আছে?
রোজাদারের জন্য খোদ কোরআন ও রমজান উভয়ের সুপারিশ আল্লাহ কবুল করবেন বলে রসুলুল্লাহ (সা.) যে সুসংবাদ, দিয়েছেন তা সাহবায়ে কেরামের জন্য ছিল পরম আনন্দদায়ক ও উৎসাহজনক। তাই তাদের পূত-পবিত্র জীবনে তারা বিশেষভাবে রমজান মাসে বিভিন্ন এবাদত বন্দেগীর পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াতে অধিক অত্মনিয়োগ করতেন এবং তাদের পরবর্তী ইমাম, ফকীহ-উলামা, আউলিয়া-মাশায়েখ, তথা বুযুর্গানেদ্বীন রমজানে কোরআন তেলাওয়াতে অধিক সময় ব্যয় করতেন। ‘ফাযায়েলে কোরআনে’ হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.) তদের একটা তালিকা প্রদান করেছেন যে, রমজানে কে কতবার কোরআন খতম করতেন। তাদের কয়েকজনের নাম নি¤œরূপ:
হযরত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) কোন কোন সময় কোরআন তেলাওয়াত করার সময় সারারাত শেষ হয়ে যেত। হযরত উসমান (রা.) হতে বর্ণিত, কোন কোন বিতর নামাযের এক রাকাতেই তিনি সমগ্র কোরআন পাঠ করতেন। অনুরূপভাবে হযরত অব্দুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রা.)ও একরাতে সমস্ত কোরআন শরিফ পূর্ণ খতম করতেন। (তাবেঈদের মধ্যে) সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রহ.) খানা-ই-কাবায় দুই রাকাতে পূর্ণ কোরআন পড়তেন। আবু র্হারা (রহ.)ও অনুরূপ পড়তেন। আবু হুনায়ী (রহ.) বলেন, আমি এক রাতে দুই কোরআন পূর্ণ এবং তৃতীয় হতে দশ পারা এবং ইচ্ছা করলে তৃতীয় খতমও পূর্ণ করতে পারতাম। ছালেহ ইবনে কায়সান (রহ.) যখন হজে গমন করেন, তখন পথেই অধিকাংশ একরাতে দুই খতম কোরআন পড়তেন।
মাওলানা যাকারিয়া (রহ.) এর বর্ণনা হতে আরো জানা যায় যে, হযরত ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর নিয়ম ছিল রমজানে তিনি রোজ এক খতম কোরআন পড়তেন। বিশিষ্ট তাবেঈ সুলায়ম ইবনে আন্জ (রহ.) এর নিয়ম ছিল তিনি প্রতি রাতে তিন খতম কোরআন পড়তেন। ইমাম নবভী (রহ.) অধিক তেলাওয়াতকারীদের সম্পর্কে লিখেছেন, ইবনুল কাইয়্যুমের নিয়ম ছিল, তিনি দিবা-রজনীতে আট খতম পড়তেন। হযরত ইমাম আজম আবুহানিফা (রহ.) রমজানে ৬১ খতম করতেন: এক খতম দিনে, এক খতম রাতে এবং তারাবীহ এর নামাজে একবার খতম করতেন।
বর্ণিত বিবরণে মাশায়েখ ও বুযুর্গানেদ্বীনের ব্যক্তি জীবনে কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি তাদের গভীর আসক্তি ও ভক্তি ভালবাসার প্রমাণ রয়েছে। তবে সাধারণ মুসলমানদের জন্য ইমামে আজম বলেছেন, বছরে সর্বনি¤œ দুইবার কোরআন খতম করা কোরআনের হক। (‘ফাযায়েলে কোরআন’ এ এসম্পর্কে আরো মতামত রয়েছে।)
কোরআনের হক রমজান মাসে আদায় করা অধিক উত্তম। হযরত আলী (রা.) বলেন, তিনটি জিনিস স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি করে, ‘মিসওয়াক, রোজা এবং কোরআন তেলাওয়াত’। আল্লাহ সকল সক্ষম মুসলমানকে নামাজ আদায় করার, রমজান মাসের রোজা রাখার এবং রমজানসহ সারা বছর অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াতের তাওফিক দান করুন।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের কাছে ক্ষমা না চাইলে ভিপি নুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
বগুড়ায় মেয়েকে হত্যা করে মায়ের আত্মহত্যা, চিরকুট উদ্ধার
বিবাহ বিভ্রাটে তৌহিদ আফ্রিদি, স্যোশ্যাল মিডিয়ায় শালিকা নিয়েছে বউয়ের অবস্থান
বিদেশি হস্তক্ষেপে বিগত সরকার ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিলো : আসিফ নজরুল
মাদক নির্মূলে কঠোর অবস্থানের ঘোষনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
নারায়ণ চন্দ্রকে আদালত চত্বরে ডিম নিক্ষেপ
সেই কবি এবার ৬৯ বছর বয়সে এইচএসসি পাস করলেন
ফিলিপাইনে টাইফুন উসাগির আঘাত
যশোরে ছুরিকাঘাত করে নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মামলা
চুয়াডাঙ্গার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হলেন যশোরের বিচারক শিমুল
জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবে ছাত্র-জনতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন : ভূমি উপদেষ্টা
২০ হাজার ওমরাযাত্রী অনিশ্চয়তায়, ওমরাহ টিকিটে এক লাফেই ১৭ হাজার টাকা বৃদ্ধি
সংষ্কার কাজ দ্রুত শেষ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন -মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম
কটিয়াদীতে যুবকের লাশ উদ্ধার, স্ত্রী আটক
বেনাপোল বন্দরে কার্গো ভেহিকেল টার্মিনাল উদ্বোধন করলেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, কমবে ভোগান্তি, বাড়বে বাণিজ্য
যশোর বোর্ডে এইচএসসিতে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন ৬৬ হাজার, পরিবর্তন ৭১ জনের
আইএইচএফ ট্রফির বাছাইপর্বে অংশ নিবে ইয়ুথ ও জুনিয়র হ্যান্ডবল দল
ফের কমলো সোনার দাম
সাফজয়ী দলকে আর্থিক পুরস্কার দিল সাউথ ইস্ট ব্যাংক
২৪২ সদস্যবিশিষ্ট ঢাবি ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ