সামাজিকতা শিক্ষাই অটিজমের মূল সোপান
০১ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:০২ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২২ পিএম
সৃষ্টিকর্তার সকল সৃষ্ট জীবের মধ্যে মানুষই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। কারণ, একমাত্র মানুষের মধ্যেই বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান, মনুষ্যত্ব ও সামাজিকতা আছে। মানুষই সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে বাঁচার তাগিদে একে অপরের উপর নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে সমাজ গঠন করে। যে কোন সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় সুখে-দুঃখে পরম দায়িত্ববোধ থেকে একে অপরের সাথে একত্রিত হয়। যুগ যুগ ধরে সামাজিক এই ধারা অব্যাহত আছে ও থাকবে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ সামাজিকতা।
অটিজমের ক্ষেত্রে সামাজিকতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করে। একটি অটিস্টিক শিশু পৃথিবীর বুকে আসার পর যেই দেশ বা যে পরিবারের হোক না কেন পরিবারটি হোঁচট খায়, শিশুটির অটিজম আছে জেনে। প্রথমত, মেনে নেওয়ার ধাক্কা সামলানোর পর পরই যে সমস্যাটি নিয়ে সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়, তা হলো শিশুর যোগাযোগ ও আচরণগত প্রবল সমস্যা। তার অস্বাভাবিক আচরণ শুধু সমাজ থেকেই নয়, নিকটজনের কাছ থেকেও শিশুকে দূরে সরিয়ে পরিবারকে কোণঠাসা করে দেয়। তবে বিশ্বায়নের যুগে, উন্নত দেশগুলোতে উন্নত মনমানসিকতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতার প্রভাবমুক্ত হওয়ার সুবাদে অটিজম নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো সামাজিকভাবে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং সমাজের প্রতিকূলতার চেয়ে সহযোগিতা বেশি পায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে এখনও সচেতনতার অভাবে এবং কিছু শ্রেণীর মানুষের হীনম্মন্যতার কারণে পরিবারগুলো বিশ্বায়নের যুগেও খুবই বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন যাপন করছে।
অনেক অটিজম পরিবারের সদস্যরা তাই ভাবেন, আমাদের সন্তানটি যদি উন্নত কোনো রাষ্ট্রে জন্ম নিত অথবা সন্তানটিকে নিয়ে অটিজমের পক্ষে সুব্যবস্থা আছে, সেরকম দেশে পাড়ি জমাতে পারতাম। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, কেন এমন হলো? এখন কী হবে? শিশুটি কেন এই দেশে জন্মালো এরকম ভাবাভাবিতে সময় নষ্ট না করে কবির ভাষায় বলুন, ‘জন্ম হোক যথা তথা/ কর্ম হোক ভাল’।
অটিজম শিশুর প্রতিপালন, স্বাভাবিক শিশুর প্রতিপালনের চেয়ে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি ধৈর্য্যরে, কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজ। তাই মা-বাবাকে হতে হবে চড়বিৎ চধৎবহঃং. অটিস্টিক শিশুদের বৈশিষ্ট্যের মিল থাকলেও তারা ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতায় পারদর্শী। তাই মূলত পরিবার থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রশিক্ষক ও শিশুটির নিকটজনদের প্রত্যকেরই উচিত নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ প্রতিভার বা দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করা। তা না হলে সে দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ বা অদক্ষতার প্রকাশ নিজ থেকে ঘটাতে পারবে না।
অটিস্টিকদের যোগাযোগ, আচরণগত ও সামাজিক পরিবেশে মেধার অক্ষমতার পাশাপাশি মূল আরেকটি বড় সমস্যা হলো, তারা প্রায় সময়ই নিজস্ব জগতে মনোনিবেশে পুলকিত বোধ করে। এই জগৎ থেকে বের করে আনা প্রশিক্ষণের সফলতার মূল মন্ত্র হবে। অটিস্টিক শিশুকে শনাক্তের পরপরই ঊধৎষু ওহঃবৎাবহঃরড়হ এর মাধ্যমে জবপড়াবৎ করার প্রয়াস এখন বিশ্বায়নের স্লোগান। তাই ঊধৎষু ওহঃবৎাবহঃরড়হ এর ক্ষেত্রে পরিবার ও প্রশিক্ষকদের মানসিকতা থাকতে হবে এরকম, আজ যে শিশু, সে ধীরে ধীরে বড় হয়ে যেন, অনেকটা অটিজম কাটিয়ে সামাজিক পরিবেশে চলার উপযুক্ত হয়। কর্মদক্ষতা অর্জন করে, সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়। প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াকে সাজাতে হবে সামাজিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে। কারণ, বন্ধ ঘরে অটিস্টিক মানুষ যতই লেখাপড়া বা আনুষাঙ্গিক কাজে দক্ষতার অধিকারী হোক না কেন, সে অসামাজিক জীব হিসেবেই প্রাধান্য পাবে।
আমরা আমাদের স্বাভাবিক শিশুগুলোর জ্ঞান অর্জন থেকে শুরু করে, বিভিন্ন সামাজিক, আনুষ্ঠানিক কর্মকান্ডে সফলতার প্রাপ্তি ও বাহ্যিক পরিবেশের থেকে মেধার বিকাশ ঘটানোর জন্য কিনা করি? মানসিক, শারীরিক, আর্থিক ক্ষমতার শক্তি সবই ব্যয় করি খুবই উদারভাবে। সাথে সাথে স্বপ্ন লালন করি, একদিন আমার সন্তান অনেক বড় হবে, মানুষ হবে। অন্যদিকে বলি, অটিস্টিক সন্তানটির পিছনেও মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যরা প্রচুর শ্রম বা আর্থিক শক্তি ব্যয় করে, তথাপি কথা থেকে যায়। সামাজিকতা শিক্ষা দেওয়ার পিছনে, অটিস্টিক শিশুকে সব পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর কাজটি কি আমরা ঠিকভাবে পালন করি? সমাজ সচেতন হোক অটিজমের স্বপক্ষে, সমাজ মেনে নিক আমার অটিস্টিক সন্তানটিকে, কিন্তু আমরা নিজেরা কতটা সচেতন সামাজিকতা শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে।
তাই অটিজম পরিবারগুলোর প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করে বলছি, পারিবারিক সচেতনতাই আনতে পারে সামাজিক সচেতনতা। আপনার শিশুর নাগরিক অধিকার, সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে ও ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মূল চাবিটি আপনার হাতে। সমাজের বিভিন্ন পরিবেশে চলার উপযুক্ততা তাকে এনে দেবে, তার নাগরিক অধিকার। আচরণগত অস্বাভাবিকতা যোগাযোগ সমস্যা ইত্যাদি স্বল্প সময়ে সমাধান সম্ভব হয় না। কিন্তু সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে এই যুদ্ধে পিছপা হলে চলবে না। কারণ, শিশুটি সামাজিক হলে, পরিবার ও সমাজ দুটোই উপকৃত হবে। সমাজের সব পরিবেশে শিশুকে চলার উপযুক্ততার কিছু ভালো ফলাফলের নমুনা হল: ১. অস্বাভাবিক আচরণ কমে আসবে। ২. অস্থিরতা ও আক্রমণাত্মক আচরণ কমবে। ৩. অটিস্টিক শিশুটি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে। ৪. মেধার বিকাশ ঘটবে। ৫. নিজস্ব কর্মদক্ষতা বা পারদর্শিতা প্রমাণের সুযোগ পাবে। ৬. পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের বা কথার সুযোগ কম পাবে। ৭. কথা বলা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পারিবারিক ভূমিকা রাখবে। ৮. সামাজিক মানুষের আনুষ্ঠানিকতার আনন্দ লাভ করবে, উৎফুল্ল থাকবে, বিষণœতা কেটে যাবে। ৯. পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তার মস্তিষ্কে নতুন উপাদান যোগ হবে। ১০. বিভিন্ন পরিবেশে যাতায়াতের ফলে ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি পেলে, যে কোন পরিবেশ যেমন স্টেশন, এয়ারপোর্ট, যানবাহনের জন্য, ডাক্তারের চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা ইত্যাদি কর্মে শিশুটির কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাবে। ১১. সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো অটিজম জগতে ঢুকার সময়টা কম পাবে। আমাদের জগতে মিশে থাকবে। ১২. সমাজের নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের কর্মকান্ড, আচার-অনুষ্ঠানের রীতিনীতি তার মস্তিষ্কে ধারণ করে, অটিজম কাটিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করতে শিখবে। উপরে উল্লেখিত সুবিধাগুলো অটিস্টিক শিশুর কাছ থেকে প্রাপ্ত হলে প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া চালানো তাদের সাথে সহজ হবে। যদিও এই সামাজিককরণ প্রক্রিয়াটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জিং, তবুও অটিজম পরিবারগুলোকে বলব, একবার না পারলে দেখ শতবার, এই প্রবাদ বাক্যটি বুকে লালন করে পথ চলতে হবে। আজ বিশ্বায়নের যুগে অটিস্টিকদের সাফল্যমন্ডিত কর্মকান্ডের দৃষ্টান্ত অটিজমাক্রান্ত পরিবারগুলোকে আশা জাগাতে বা স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করবে আশা রাখি।
আজ দৃঢতার সাথে বলতে পারি, একজন অটিস্টিক মানুষ যখন সমাজের সর্বস্তরের সকল পরিবেশে মিশতে পারে ও কর্মদক্ষতা দেখাতে পারে, তা স্বাভাবিক মানুষদের অনেক উচ্চ শিক্ষা অর্জন বা কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই অটিজম পরিবারগুলোকে বলছি, কেন আপনারা শিশুকে অসামাজিক অদ্ভুত জীব হিসেবে রেখে দেবেন চার দেয়ালের ভিতরে? কেন তাকে সামাজিক, মৌলিক, রাষ্ট্রীয় নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন? কেন সমাজ বলবে এ আবার কেমন মানুষ? দেখতে মানুষের মতো কিন্তু আচরণ অদ্ভুত। তাই আজই নেমে পড়–ন যুদ্ধে, সমাজের সব পরিবেশে শিশুকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করুন এবং অব্যাহত রাখুন। জোর গলায় বলতে পারি, আপনার প্রচেষ্টা কখনোই ব্যর্থ হবে না। আপনার অটিস্টিক শিশুটি নিঃস্বার্থভাবে আপনার কষ্টের প্রতিদান দেবে। কারণ অটিস্টিকরা দিতে জানে, বিনিময়ে কিছুই নিতে জানে না। এই শিশুগুলোর মধ্যে লুকায়িত আছে অসীম, অজানা দক্ষতা এবং পারদর্শিতা, যা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বের করে কাজে লাগাতে পারলে, অবশ্যই সমাজ, সর্বোপরি রাষ্ট্র তাদের ভালো কর্মের কাছে একদিন ঋণী হয়ে থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের কাছে ক্ষমা না চাইলে ভিপি নুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
বগুড়ায় মেয়েকে হত্যা করে মায়ের আত্মহত্যা, চিরকুট উদ্ধার
বিবাহ বিভ্রাটে তৌহিদ আফ্রিদি, স্যোশ্যাল মিডিয়ায় শালিকা নিয়েছে বউয়ের অবস্থান
বিদেশি হস্তক্ষেপে বিগত সরকার ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিলো : আসিফ নজরুল
মাদক নির্মূলে কঠোর অবস্থানের ঘোষনা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
নারায়ণ চন্দ্রকে আদালত চত্বরে ডিম নিক্ষেপ
সেই কবি এবার ৬৯ বছর বয়সে এইচএসসি পাস করলেন
ফিলিপাইনে টাইফুন উসাগির আঘাত
যশোরে ছুরিকাঘাত করে নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মামলা
চুয়াডাঙ্গার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হলেন যশোরের বিচারক শিমুল
জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবে ছাত্র-জনতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন : ভূমি উপদেষ্টা
২০ হাজার ওমরাযাত্রী অনিশ্চয়তায়, ওমরাহ টিকিটে এক লাফেই ১৭ হাজার টাকা বৃদ্ধি
সংষ্কার কাজ দ্রুত শেষ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন -মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করীম
কটিয়াদীতে যুবকের লাশ উদ্ধার, স্ত্রী আটক
বেনাপোল বন্দরে কার্গো ভেহিকেল টার্মিনাল উদ্বোধন করলেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, কমবে ভোগান্তি, বাড়বে বাণিজ্য
যশোর বোর্ডে এইচএসসিতে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন ৬৬ হাজার, পরিবর্তন ৭১ জনের
আইএইচএফ ট্রফির বাছাইপর্বে অংশ নিবে ইয়ুথ ও জুনিয়র হ্যান্ডবল দল
ফের কমলো সোনার দাম
সাফজয়ী দলকে আর্থিক পুরস্কার দিল সাউথ ইস্ট ব্যাংক
২৪২ সদস্যবিশিষ্ট ঢাবি ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ