ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ক্রমবিকাশ

Daily Inqilab তৈমূর আলম খন্দকা

১৩ মে ২০২৩, ০৮:১৭ পিএম | আপডেট: ১৪ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম

উপমহাদেশে পাকিস্তান ও নেপাল সাংবিধানিকভাবে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। অপরদিকে বাংলাদেশ ও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যদিও বাস্তবতায় ভারতের চিত্র ভিন্ন রূপ। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু কিন্তু অসাম্প্রদায়িক এবং এ দেশের পরিবেশ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬৪-৬৫ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে একবারই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, যা বাঙালি মুসলিম দ্বারা সংঘটিত হয়নি। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আদমজী, বাওয়ানী, করিম প্রভৃতি জুট মিলসহ বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরিতে কর্মরত উর্দুভাষী শ্রমিকরা। কিছু স্বার্থান্বেষী ছাড়া পূর্বপাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানরা তখন হিন্দুদের নিরাপত্তা দিয়েছে, এমনকি কোনো কোনো এলাকায় হিন্দুদের নিরাপত্তার জন্য মসজিদ খুলে দিয়েছে। পক্ষান্তরে পার্শ্ববর্তী ভারত একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সেখানে বার্মার মতো রাষ্ট্রীয় মদদে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, যার শিকার মুসলিমরা। ২৬ নভেম্বর ১৯৪৯ ভারতীয় পার্লামেন্ট ঞযব The Constitution of India, ১৯৫০ অনুমোদন করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভারতের সংবিধান ১০৩ বার সংশোধন হয়েছে। ভারত একটি টহরড়হ ড়ভ ঝঃধঃবং ভিত্তিক রাষ্ট্র। তার সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে: ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথমাংশে ‘প্রস্তাবনা’ উল্লেখ রয়েছে: ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যেসব মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেসব আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে’।

ভারতের সংবিধানের সাথে আমাদের মিল রয়েছে। উভয় রাষ্ট্রের সংবিধানে ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার’ ওপর গুরুত্বারোপ করা হলেও কার্যত: ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার ন্যূনতম কোনো অনুশীলন বা বাস্তবায়ন নেই। পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে থাকে ১. ধর্ম ও ২. বর্ণভিত্তিক। ধর্ম ও বর্ণ উভয়ভিত্তিক দাঙ্গা সবচেয়ে বেশি হয়েছে ভারতে। ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দু নেতাদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার আইনগত আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। উক্ত আইন পাসের ৯ বছর পর ব্রিটিশ পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। এই ৯ বছরে বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হয়। সেই সময়ে ভারতে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের ব্রিটিশের দাসত্ব, ব্রিটিশ ও অভিজাত হিন্দু উভয়ে যৌথভাবে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ প্রভৃতি কারণেই মুসলমানদের জন্য আলাদা স্বাধীন আবাস ভূমির প্রয়োজনীয়তা মুসলমানরা উপলব্ধি করে। ব্রিটিশ ভারত দখলের পর সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বিভিন্ন লেখকের মন্তব্য নি¤েœ উল্লেখ করা হলো।

ইংরেজ ও এ দেশীয় জনশক্রদের সৃষ্ট ছিয়াত্তরের ভয়াবহ মন্বন্তর বাংলা ও বিহারের প্রাচীন স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমাজের শেষ চিহ্ন মুছে দিয়েছিল। ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞের এই পটভূমির ওপর দাঁড়িয়েই ইংরেজ বণিক-শাসকরা তাদের কৃষক-শোষণের ব্যবস্থা পাকাপাকি করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যাস্ত আইনের দ্বারা মুসলমানদের হাত থেকে সব ইজারা, জমিদারি, তালুকদারি একে একে খসিয়ে ফেলে নতুন হিন্দু জমিদার ও তালুকদার-শ্রেণীর আমদানি করা হয়। যেসব হিন্দু কর আদায়কারী ওই সময় পর্যন্ত নি¤œ পদের চাকরিতে নিযুক্ত ছিল, নয়া ব্যবস্থার বদৌলতে তারা জমিদার শ্রেণীতে উন্নীত হয় (সূত্র : ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার: দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস; এম, আনিসুজ্জামান অনূদিত, পৃষ্ঠা-১৪১)। ফলে অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলো একেবারে উৎখাত হয়।

 

হেস্টিংস এর চুক্তি (১৭৭২-৯৩) ও লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯৩) ফলে এ দেশের বুনিয়াদি ও পুরনো জমিদারদের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভাগ্যজনক পরিবর্তন। নিলামের ডাকে যারা প্রচুর অর্থ দিতে পারত, তাদেরই জমিদারি ইজারা দেয়া হতো। পুরনো জমিদারদের পক্ষে ইংরেজদের চাহিদা মাফিক অর্থ দেয়া সম্ভব ছিল না। প্রচুর জমানো টাকা নিয়ে এগিয়ে এলো বেনিয়ান, গোমস্তা, মহাজন আর ব্যাংকের মালিকরা। লুণ্ঠন-শোষণের মাধ্যমে অর্জিত নগদ টাকার জোরে রাতারাতি তারা জমিদার হয়ে বসল। তাদের সবারই ধর্মীয় পরিচয় হিন্দু। তাদের গোত্রীয় পরিচয় দেব, মিত্র, বসাক, সিংহ, শেঠ, মল্লিক, শীল, তিলি অথবা সাহা। তাদের অনেকেরই পূর্বপরিচয় তারা পুরাতন জমিদারদের নায়েব কিংবা গোমস্তা। আর তাদের অভিন্ন পরিচয় তারা বাংলার নব্য-প্রভু বণিক-শাসকদের দালালরূপী লুটেরা-শোষক (সূত্র : শত বর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস)।

মুসলমান জমিদারদের জমিদারি দখল এবং মুসলমানদের লাখেরাজ সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার জন্য ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যরা খ্রিষ্টান পাদ্রিদের সাথে ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়। পাদ্রীদের পরামর্শে কোম্পানি সরকার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আয়মা লাখেরাজ ও তৌজি লাখেরাজের দলিল-দস্তাবেজ ও সনদ-পাঞ্জা কোম্পানি সরকারে দাখিল করার জন্য এক আকস্মিক নির্দেশ জারি করে। মুসলমানদের অনেকেই এসব দলিলপত্র মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাখিল করতে পারেনি। তাদের সমুদয় লাখেরাজ সম্পত্তি দখল করা হয়। এ ছাড়া মুসলমানদের অধিকাংশ জমিদারি পাদ্রিদের সুপারিশে কোম্পানি সরকার খাস করে নেয় এবং পরে তা ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের বন্দোবস্ত দেয় (সূত্র : আবদুল গফুর সিদ্দিকি: শহীদ তিতুমীর, পৃষ্ঠা-৪৫)।

সুপ্রাচীনকাল থেকে এ দেশে যে ভূমি-ব্যবস্থা ছিল, তা ওই ধরনের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অনুস্বত্বের অধিকারী নতুন হিন্দু জমিদাররা জমির পূর্ণস্বত্ব মালিকানা লাভ করে। কৃষকরা হলো তাদের অনুগ্রহ ও মর্জির ওপর নির্ভরশীল। কৃষকরা শুধু জমি চাষ করার অনুমতি লাভ করেছিল। জমিতে তাদের কোনো স্বত্ব রইল না। কৃষকের স্বত্ব এবং ভূমি-ব্যবস্থার চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট থাকল না। এ ব্যবস্থার ফলে উপস্বত্বের অধিকারীরা পূর্ণস্বত্ব ভোগের দ্বারা কৃষকদের ওপর যে নির্মম নিষ্পেষণ চালায় তার বিবরণ তুলে ধরে আবদুল মওদুদ উল্লেখ করেছেন: ‘এই নয়া ভূস্বামী সম্প্রদায়ের অত্যাচার এতখানি চরমে উঠেছিল যে, দাড়ি রাখার জন্য নতুন ট্যাক্স বসাতে তাদের অনেকের সংকোচ হয়নি (আবদুল মওদুদ : সিপাহি বিপ্লবের পটভূমি; ড. হাসান জামান সম্পাদিত ও নওরোজ কিতাবিস্তান প্রকাশিত ‘শতাব্দী পরিক্রমা, পৃষ্ঠা-৬১)।’

মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ না করার একটি কারণ ছিল অর্থনৈতিক। ইংরেজ ও তাদের সহযোগী দালাল হিন্দু জমিদারদের শাসন-শোষণে মুসলিম অভিজাত শ্রেণী নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানের পাশাপাশি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী সম্পূর্ণরূপে রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। শহরের ব্যয়বহুল শিক্ষার জন্য সন্তানদের প্রেরণ করার মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের ছিল না। এ প্রসঙ্গে সিসিল বিডন ১৮৫২ সালের ২৫ এপ্রিলের এক মন্তব্যপত্রে লিখেছেন: ‘মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে, তারা তাদের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ের উচ্চ বেতনের ব্যয়ভার বহন করতে পারেন (সূত্র : ডক্টর ওয়াকিল আহমদ: উনিশ শতকের বাঙ্গালী মুসলমানের চিন্তাচেতনার ধারা, পৃষ্ঠা-৫৯)।’

সার্বিক এ বৈরী পরিস্থিতিতে চাকরিক্ষেত্রে মুসলমানদের যে অবস্থা দাঁড়ায়, সে সম্পর্কে হান্টার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার ১৮৭১ সালে প্রদত্ত একটি তালিকা থেকে জানা যায়, সে সময়কার ২১১১টি গেজেটেড পদে মুসলমান ছিল মাত্র ৯২ জন। আর ১৫টি ডিপার্টমেন্টের মধ্যে সর্বোচ্চ আটটিতে একজনও মুসলমান ছিল না (হান্টার, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৪৭)।

চাকরিক্ষেত্রে মুসলমানদের অপসারিত করে হিন্দুদেরকে অধিষ্ঠিত করার পিছনে ইংরেজদের যে মানসিকতা কাজ করেছে, ১৮১৩ সালে সিলেক্ট কমিটির সামনে স্যার জন ম্যালকমেব বক্তৃতা থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন: ‘ভারতের হিন্দুদের সহযোগিতাই আমাদের নিরাপত্তার প্রধান সহায়।’ লর্ড এডিনবরো একইভাবে সে মানসিকতা তুলে ধরেছেন। তিনি ১৮৪৩ সালে ডিউক অব ওয়েলিংটনকে এক পত্রে লিখেছেন : ‘মুসলমানরা বরাবরই আমাদের শক্র। ভারতে আমাদের নীতি হবে হিন্দুদের প্রতি আমাদের হস্ত প্রসারিত রাখা (A. R. Mallick: British Policy and the Muslims in Bengal, P-64)’

ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমশ গতিবেগ অর্জন করতে থাকলে উপরোক্ত কারণে বাঙলার মুসলমানরা উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক বাসভূমি পাকিস্তান অর্জনের আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। পাকিস্তান আন্দোলনকে তারা সমর্থন দিয়েছিল এ কারণে যে, ‘লাহোর প্রস্তাবে’ শুধু মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রাধান্য থেকে অব্যাহতিই নয়, পাশাপাশি রাজনৈতিক স্বাধীনতারও আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। বাঙালি নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি করে বলা হয়েছিল : নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনের মতামত হলো এই যে, নি¤œরূপ মৌলিক নীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা না হলে কোনো সাংবিধানিক পরিকল্পনা এখানে কার্যকর করা যাবে না এবং এ দেশের মুসলমানদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। সেগুলো হলো: ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো এমনভাবে চিহ্নিত করে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে যাতে করে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে এমন কতকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হয়, যেখানে প্রত্যেকটি ইউনিট হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত।

নীতিমালা:
ক. ‘প্রত্যেকটি ইউনিটের সংখ্যালঘুদের জন্য সংবিধানে পর্যাপ্ত, কার্যকর এবং অবশ্যপালনীয় রক্ষাকবচ বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে করে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তারা তাদের নিজ নিজ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকসহ অন্যান্য অধিকার আদায় করতে পারে।’

খ. ‘এই অধিবেশন ওয়ার্কিং কমিটিকে উপরোক্ত নীতিমালার অনুসরণে এমন একটি সংবিধান প্রণয়নের অনুমোদন প্রদান করছে যা চূড়ান্তভাবে অঞ্চলসমূহ প্রয়োগের ক্ষমতা দেবে।’

পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আরেকটি প্রস্তাব গ্রহণ করলে লাহোর প্রস্তাবে গৃহীত নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রশ্ন কিছুটা চাপা পড়ে যায়। এতে বলা হয়েছিল যে: ‘ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাসমূহের মুসলিম লীগ প্রতিনিধিদের এই অধিবেশন সতর্ক বিবেচনার সাথে উল্লেখ করেছে যে, মুসলমান জাতি কোনো অবস্থাতেই অখ- ভারতের কোনো সংবিধান স্বীকার করবে না এবং এতদুদ্দেশ্যে গঠিত একক সংবিধান প্রণয়নকারী কোনো সংগঠনে অংশ নেবে না। ব্রিটিশ সরকার ভারতের জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার যে কৌশল অবলম্বন করবে তাতে নি¤েœাক্ত নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করা না হলে তাতে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সৌহার্দ্য নিশ্চিত হবে না এবং ভারতের বিদ্যমান সঙ্কট ও সমস্যাবলি অব্যাহত থাকবে। সেই নীতিমালা হলো এই যে, উত্তর পূর্ব অঞ্চলে বাঙলা ও আসাম এবং ভারতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের সমন্বয়ে মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে এবং পাকিস্তান গঠনের পক্ষে অবিলম্বে একটি দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দিতে হবে (সূত্র : ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ প্রণীত বাংলাদেশ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা)।’

ইতিহাস গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তৎসময়ে প্রেক্ষাপটে টু নেশন থিউরি ছিল যুক্তিসঙ্গত। কারণ ব্রিটিশদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতের রাজনীতি এবং অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে। উচ্চ বর্ণের হিন্দু তথা বিত্তশালী হিন্দুরা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখার জন্য ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়ে সফলকাম হয়। কিন্তু স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে মুসলমানরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্রিটিশদের বশ্যতা স্বীকার করেনি বিধায় ফিরিঙ্গিদের সংস্পর্শে যায়নি। ফলে ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট সুবিধাভোগী বিত্তশালী হিন্দু সমাজ দুভাবে সাম্প্রদায়িকতার বীজ তখন ভারতে রোপণ করে। প্রথমত, উচ্চবর্ণ ও নি¤œবর্ণ বলে হিন্দু সমাজকে দ্বিখ-িত, দ্বিতীয়ত, মুসলমানরা ভারতীয় নয় মর্মে স্লোগান তুলে তাদেরও নি¤œবর্ণের মতো ট্রিট করা হলো এবং এভাবেই দিনে দিনে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয়।

তবে বাংলাদেশে বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতা কথাটি ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক ফয়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে। অথচ ভারতের মুসলমানরা যেভাবে সাম্প্রদায়িক হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার প্রতিবাদ নেই। বরং বাঙালি মুসলমান অথচ নাস্তিক তারাই ‘বাঘ এলো’ ‘বাঘ এলো’ বলে ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমাটিকে হাওয়া দিয়ে অতিমাত্রায় প্রগতিশীল হওয়ার ভান করছে। এদের মধ্যে পোশাকী তথাকথিত শিক্ষিত লোকের সংখ্যাই বেশি। তারা শুধু বকধার্মিক নয় বরং জ্ঞানপাপীও বটে। ইসলাম ধর্ম কোনো দিনই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। অথচ জ্ঞানপাপীরা মুসলমানদের ওপর আঘাত হেনে সাম্প্রদায়িকতার সুরসুরি দিতে অনেক মজা পায়।

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

রাজশাহী বাঘায় পদ্মা নদীতে টিনের তৈরী ডুঙ্গা নৌকা ডুবে আবারও এক যুবক নিখোঁজ

রাজশাহী বাঘায় পদ্মা নদীতে টিনের তৈরী ডুঙ্গা নৌকা ডুবে আবারও এক যুবক নিখোঁজ

লালমনিরহাটে ট্রেনে কাটা পড়ে এক যুবকের মৃত্যু

লালমনিরহাটে ট্রেনে কাটা পড়ে এক যুবকের মৃত্যু

দুবাই বন্যার কারণ: কৃত্রিম বৃষ্টিপাত, নাকি আবহাওয়া পরিবর্তন?

দুবাই বন্যার কারণ: কৃত্রিম বৃষ্টিপাত, নাকি আবহাওয়া পরিবর্তন?

পেশাদার বক্সিংয়ে অভিষেকের অপেক্ষায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ বক্সার হামজা উদ্দীন

পেশাদার বক্সিংয়ে অভিষেকের অপেক্ষায় বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ বক্সার হামজা উদ্দীন

মাগুরায় আগুনে পুড়ে দুই পরিবারের লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি!

মাগুরায় আগুনে পুড়ে দুই পরিবারের লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি!

মধ্যপ্রাচ্যে ‘প্রতিশোধের চক্র’ বন্ধ করতে হবে: জাতিসংঘ মহাসচিব

মধ্যপ্রাচ্যে ‘প্রতিশোধের চক্র’ বন্ধ করতে হবে: জাতিসংঘ মহাসচিব

অপরাজিতারা নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত : স্পিকার

অপরাজিতারা নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত : স্পিকার

দিনাজপুরে জাল টাকা তৈরির সরঞ্জাম ও জাল টাকা সহ ২ জন আটক

দিনাজপুরে জাল টাকা তৈরির সরঞ্জাম ও জাল টাকা সহ ২ জন আটক

থাই-মিয়ানমার সীমান্ত শহরের কাছে আবারও সংঘর্ষ শুরু: থাই সেনাবাহিনী

থাই-মিয়ানমার সীমান্ত শহরের কাছে আবারও সংঘর্ষ শুরু: থাই সেনাবাহিনী

উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কমিটি গঠন বন্ধ থাকবে : ওবায়দুল কাদের

উপজেলা নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও কমিটি গঠন বন্ধ থাকবে : ওবায়দুল কাদের

সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৌয়াল নিহত

সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মৌয়াল নিহত

থিম্পুতে বাংলাদেশ ও ভুটানের পররাষ্ট্র বিষয়ক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত

থিম্পুতে বাংলাদেশ ও ভুটানের পররাষ্ট্র বিষয়ক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত

কাল থেকে নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রমে ফিরছে সুপ্রিম কোর্ট : তীব্র গরমে আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না

কাল থেকে নিয়মিত বিচারিক কার্যক্রমে ফিরছে সুপ্রিম কোর্ট : তীব্র গরমে আইনজীবীদের গাউন পরতে হবে না

অসুস্থ্য হয়ে ঠাকুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী জাকির হোসেনের মৃত্যু

অসুস্থ্য হয়ে ঠাকুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী জাকির হোসেনের মৃত্যু

বঙ্গবন্ধু কন্যা তৃণমুল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছেন : হুইপ ইকবালুর রহিম

বঙ্গবন্ধু কন্যা তৃণমুল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছেন : হুইপ ইকবালুর রহিম

রায়গঞ্জে চারটি বসতবাড়িতে আগুন লেগে ১০ লাখ টাকার মালামালসহ পুড়ে গেছে গরু

রায়গঞ্জে চারটি বসতবাড়িতে আগুন লেগে ১০ লাখ টাকার মালামালসহ পুড়ে গেছে গরু

চাঁদপুর মেঘনায় যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন, আহত ৮

চাঁদপুর মেঘনায় যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন, আহত ৮

চাঁদপুর ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আবারও বন্ধ

চাঁদপুর ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আবারও বন্ধ

মন্দিরে আগুনের পর দুইজন হত্যা, যা বলছেন নেটিজেনরা

মন্দিরে আগুনের পর দুইজন হত্যা, যা বলছেন নেটিজেনরা

দুইজন মুসলিম শ্রমিককে হত্যা সাম্প্রদায়িক উস্কানির শামিল

দুইজন মুসলিম শ্রমিককে হত্যা সাম্প্রদায়িক উস্কানির শামিল