নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি কি থামবে না?
০২ জুন ২০২৩, ০৭:৪৯ পিএম | আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম
অনেক দিন থেকেই বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বাজার নিয়ন্ত্রণহীন ভোজ্যতেল, প্রয়োজনীয় সবজি, চিনি, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, আলুসহ দৈনন্দিন জীবন ধারণের প্রায় সবকয়টি পণ্যের দামই ঊর্ধ্বমুখী। মূল্যস্ফীতিতে নাকাল সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি কেন সহনীয় পর্যায়ে নেই বা বাজার কেন স্থিতিশীল হচ্ছে না, এর কারণ কেবল করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশি^ক মূল্যস্ফীতি নয়, এর পিছনে রয়েছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি, অতি মুনাফাখোরী প্রবণতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্তভোগীদের প্রভাব। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসলা ইত্যাদির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটি কয়েক ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ-সুবিধা সরকার বিভিন্নভাবে দিয়ে গেলেও তার সুফল জনগণ পাচ্ছে না। তারা যে পণ্য উৎপাদন করে তার মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের নেই। যতই উন্নয়নের কথা বলা হোক, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যদি সহজ না হয়, সাবলীল ও আয়ত্তের মধ্যে না হয় তাহলে উন্নয়ন অনেকের কাছেই অর্থহীন। তাই মূল্যস্ফীতির প্রকোপ কমিয়ে আনতে হবে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া থামাতে হবে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা জনগণ মুখে বলতে না পারলেও তাদের বুকে ক্ষোভ জমছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালীর কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার। প্রতিটি ভোগ্যপণ্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যাদের কিছু সঞ্চয় আছে তাও তারা ভেঙ্গে ফেলছে। এ অবস্থায় চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। কোনো কোনো পণ্যের সরবরাহ বাজারে প্রচুর দেখা গেলেও দাম কমছে না। এটা বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা। কিছু কিছু পণ্যের দাম সরকার বেঁধে দেওয়ার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অজুহাতের শেষ নেই। একেক সময় একেক অজুহাত তারা দাঁড় করায়। এ চিত্র বদলাতে হবে। সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হলে চলবে না। সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে জোরদার করতে হবে, প্রয়োজনে সংখ্যা বাড়াতে হবে। একটি দেশে সামগ্রিক উন্নয়নের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নই মুখ্য। একটি দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা ঝুঁকি প্রকট আকার ধারণ করে। পত্রপত্রিকা ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের নানা মন্তব্য থেকে বলা যায়, দেশ ভয়াবহ ৫টি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি অন্যতম একটি। এ প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ^ব্যাংক।
এদিকে বিগত সাত বছরের মধ্যে এখন রিজার্ভও সর্বনি¤œ পর্যায়ে রয়েছে। ২৪ মে ২০২৩ রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৯৯৬ কোটি ৮৮ লাখ ৩০ হাজার ডলারে নেমে আসে। এর আগে ৮ মে এশিয়ার ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা পরিশোধের পর রিজার্ভ ক্রমে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গিয়েছিল। অথচ, সাত বছর আগে ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩৫ কোটি ডলার। রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয় থেকে রিজার্ভ ডলার জমা কম হওয়ায় এবং এলসি দায় মেটাতে ডলার বিক্রির বাড়ার কারণে রিজার্ভ কমেছে। তবে আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীদের পাঠানো রিমিটেন্স রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ও জীবন যাত্রার মান। আমাদের শিল্প উৎপাদনের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আমদানির দায় ডলারের মাধ্যমে বেশির ভাগ শোধ করতে হয়। সেজন্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে যে সব পণ্য আমদানি হয় তার বড় অংশ দেশে উৎপাদন করতে হবে। এতে আমদানির উপর চাপ কমবে। ফলে রেমিটেন্স ও রপ্তানি কম হলেও সংকট প্রকট হবে না। এতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি ক্রমে কমে আসার সুযোগ তৈরি হবে।
পণ্যমূল্যকে সাধ্যের মধ্যে রাখতে হলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদনের খরচ কমাতে হবে। এজন্য আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। দেশে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের কাঁচামাল উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে হলে পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন ও ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর পথ সহজ করতে হবে। উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবহন, ভ্যাট, শুল্ক, সহনীয় পর্যায়ে রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো কৃষি ও শিল্প। তাই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম জনগণের সাধ্যের মধ্যে রাখতে হলে কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি শিল্প উৎপাদন জোরদার করতে হবে। সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির চরম ভোগান্তি থেকে বাঁচতে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি রক্ষণশীল হতেই হবে। খাদ্য সরবরাহসহ নিত্যপণ্য কমদামে সরবরাহ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের পর তা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্টোরেজ করে সংরক্ষণ করতে হবে। টিসিবিকে ব্যবহার করে বা বাজার মনিটরিং জোরদার করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
দ্রব্যমূল্যকে মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখার জন্য একটি স্থায়ী সমাধান বের করতে হবে। এজন্য কৃষির উৎপাদন আধুনিকিকরণ করা ও সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা উচিত। কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি ভর্তুকির সঠিক ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের সাথে বিদ্যুৎ ও জ¦ালানিও গুরুত্বপূর্ণ। সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ তাদের প্রায় সময় প্রেসার, ডায়েবেটিস, কিডনি, হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হয়। তাই তাদের খাদ্যদ্রব্যের চেয়ে বেশি জরুরি ঔষধপত্র ও চিকিৎসা সেবা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে প্রবীণ ও অসুস্থ, রোগগ্রস্ত লোকজনকে নানা সংকটে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সাধারণভাবে মাসে কমপক্ষে ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। নি¤œ আয়ের মানুষ যা আয় করছে তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, শিক্ষার ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে থাকছে না। যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরি জীবন কাটিয়েছে তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। কারণ, চাকরি জীবনের একমাত্র সঞ্চয়, পেনশন বা গ্রেচ্যুইটির টাকা। তাদের অনেকে সঞ্চয়পত্র কিনে মাসে মাসে সেখান থেকে মুনাফা নিয়ে জীবন নির্বাহ করেন। ইদানিং সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারও কমানো হয়েছে। ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীসহ নি¤œ মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষের অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী ভাব আর কতদিন জনগণ দেখবে? বিবিএস-এর তথ্য মতে, গত বছর আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে নয় শতাংশ, যা গত ১১ বছরের সর্বোচ্চ। তারপর থেকে ৮-৯ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে। এ বছর এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ২০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। জ¦ালানি তেলের মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। শ্রীলংকা ও পাকিস্তান ছাড়া এশিয়ার কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো এতো মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী অবস্থান দেখা যায় না। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্য, ভোজ্য তেল, জ¦ালানি তেল ও গ্যাস, সার প্রভৃতির যে দাম সে তুলনায় আমাদের দেশের বাজার মূল্য অনেক বেশি। আমাদের দেশের চালের বাজারে গেলে দেখা যায়, বর্তমানে মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৬-৫০ টাকা, সরু চাল ৬৫-৭০ টাকা। ডিমের ডজন ১৩০-১৪৫ টাকা, ব্রয়লার মুরগী বিক্রি হয় প্রতি কেজি ২২০-২৩০ টাকা। গত এপ্রিলে কেজি প্রতি দাম ছিল ২৫০-২৭০ টাকা। চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪৮ টাকা। আদা, পেঁয়াজ, রসুন ও মসলার দাম আবারো বেড়ে চলেছে। এভাবে প্রত্যেকটি পণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে মানুষের আয় সে হারে বাড়ছে না। নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষের সংকট আরো বেশি। তারা সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। কমে যাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান। নিত্যপণ্যের এই ঊর্ধ্বমুখিতা থেকে জনগণ মুক্তি চায়। তাই এর থেকে উত্তরণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ করা, গরিব ও অসহায়দের স্বল্পমূল্যের খাদ্য বিতরণ এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো উচিত। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর ঊর্ধ্বমুখী দাম যেন জনগণের সাধ্যের মধ্যে থাকে, সে দিকে নজর দেওয়া উচিত।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘণকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ
আওয়ামী লীগ যা করেছে, বিএনপি তার বিপরীত কাজ করে সুন্দর সমাজ গড়বে- কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের নেতা ইয়াকুব চৌধুরী
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ
আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত