প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে সামাজিক সচেতনতা ও আইন প্রয়োগ জরুরি
০৫ জুন ২০২৩, ০৯:৪০ পিএম | আপডেট: ০৬ জুন ২০২৩, ১২:০৫ এএম
প্লাস্টিক দূষণ হলো নির্দিষ্ট স্থানে পলিথিন ও সিন্থেটিক প্লাস্টিক পণ্য জমে থাকা। চারপাশে প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক পণ্যের সিঙ্গেল ব্যবহারের ফলে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ, কসমেটিক প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক, বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশিরভাগই পুনরায় ব্যবহার করা হয় না। এগুলোকে সাধারণত একবার (সিঙ্গেল ইউজ) ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়। পরবর্তীতে এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যের আকার ধারণ করে। প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা স্বাভাবিক পরিবেশে পঁচতে প্রায় ৪ শত বছরের বেশি সময় লাগে। তাই একে ‘অপচ্য পদার্থ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এতে বন্যপ্রাণী এবং তাদের আবাসস্থলের পাশাপাশি মানুষের জন্য বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।
বিশ^ব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে কয়েকটি গবেষণা থেকে খুবই উদ্বেগজনক ফলাফল পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় যে বিষয়টি উদ্ঘাটিত হয়েছে, তাতে দেখা যায়, মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্তের মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরে চলাচল করতে পারে। শরীরের কোনো অঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক জমতে পারে। গবেষণাগারে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের কোষের ক্ষতি করে। ২০২২ সালে মায়ের বুকের দুধে প্রথমবারের মতো মাইক্রোপ্লাস্টিক (অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা) শনাক্ত করেছেন ইতালীয় বিজ্ঞানীরা। মায়ের বুকের দুধে যেসব মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে তার মধ্যে আছে পলিথিন, পিভিসি এবং পলিপ্রোপিলিন। এর আগে ২০২০ সালে ইতালীয় বিজ্ঞানীদের এ দলটিই মানুষের গর্ভফুলে প্লাস্টিক কণা শনাক্ত করেছিলেন। ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল ঞযব ংবধঃঃষবং ঞরসব (দ্যা সিটলস টাইম) নামক দৈনিকে একটি খবর খুব সাড়া ফেলে। সিটল সমুদ্র সৈকতে মৃত পড়ে থাকতে দেখা যায় একটি বিশাল তিমিকে। পরে যখন সেই তিমির মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তখন দেখা যায়, তিমির পাকস্থলীতে রয়েছে বহু প্লাস্টিক পদার্থ। সেসব প্লাস্টিককেই সেই তিমির মৃত্যুর কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। উপরোক্ত গবেষণার ফলাফল আমাদের কাছে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা ও এর ব্যাপকতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও, বর্তমানে কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে গত ১৫ বছরে (২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে) প্লাস্টিকের ব্যবহার ৩ গুণ বেড়েছে। ২০২০ সালে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও তার মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। বাকিগুলো ভাগাড়, নদী, খাল, ড্রেন ও যত্রতত্র ফেলা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টন প্লাস্টিক বাংলাদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়, যার ফলে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশের কারণে শুধু সামুদ্রিক জীবন নয়, মানব স্বাস্থ্যের ওপরও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশে শীত মৌসুমে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি অনেক দূর দূরান্ত থেকে আসে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দিনকে দিন এসব অভিবাসী পাখির সংখ্যা মারাত্মক হারে কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে। এখনই এসব পরিযায়ী পাখির প্রায় ৯০% এর পাকস্থলীতেই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৯% এ, যা এসব পাখির অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি।
বাংলাদেশ বিশে^র কাছে জলবায়ু কূটনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও সেই দেশেই অবাধে প্লাস্টিক, পলিথিনের ব্যবহার হচ্ছে। প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপও নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। আমরা মনে করি, আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে প্লাস্টিকের অবৈধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, দূষণ-কর ব্যবস্থাও চালু করা যেতে পারে। ‘দূষণ কর’ ভারতের কয়েকটি রাজ্য ভালোভাবে প্রয়োগ করা শুরু করেছে। কলকাতায় কোনো শপিং সেন্টারে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিতে গেলে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন গড়ে ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের এ প্রিয় শহরে আমরা ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে অবচেতন মনে অন্যান্য বর্জ্যের সঙ্গে ফেলে দিচ্ছি। একশ’র বেশি ফ্যাক্টরিতে এসব পলিথিন ব্যাগ তৈরি হয়। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে দেশে আইন হয়েছে এক দশকের বেশি আগে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগের অভাব। পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার পর গত এক দশকে ঢাকা শহরে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণ।
পরিবেশ বিপন্নকারী পৃথিবীর শতকরা ৫১ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে শুধু এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে, যা সব ধরনের বর্জ্যের শতকরা ৮ ভাগ।
যদিও এটা মনে হতে পারে যে, প্লাস্টিক দূষণের সমস্যা সমাধান করা রিসাইক্লিং বা খালি বোতল পরিষ্কার করার মতোই সহজ। কিন্তু মোটেই তা নয়। প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণগুলো হলো: প্লাস্টিক প্রায় সর্বত্র ব্যবহৃত হয় এবং সহজলভ্য, নগরায়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে চাহিদা বেশি, প্লাস্টিক সস্তা এবং উৎপাদন সাশ্রয়ী, প্লাস্টিক এবং আবর্জনা পরিষ্কার করা সহজ, ধীর পঁচন হার, মাছ ধরার জাল তৈরি এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব প্লাস্টিক একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর শুরুতে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আইন অনুসারে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য হলো, যে কোনো বর্জ্য যাহা নিজস্ব ভৌত বা রাসায়নিক গুণগত কারণে অথবা অন্য কোনো বর্জ্য বা পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে বিষক্রিয়া, জীবাণুসংক্রমণ, দহন, বিষ্ফোরণ ক্রিয়া, তেজষ্ক্রিয়া, ক্ষয়ক্রিয়া বা অন্য কোনো ক্ষতিকর ক্রিয়া দ্বারা পরিবেশের ক্ষতিসাধনে সক্ষম। এই সংজ্ঞা অনুসারে পলিথিন, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাতগুলো ক্ষতিকর বর্জ্যের অন্তর্ভুক্ত।’ আইনের ৬ এর ‘গ’ ধারা অনুসারে অপরাধ হিসেবে এসব বর্জ্য পদার্থ তথা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, আমদানি, মওজুদকরণ, বোঝাইকরণ, পরিবহন ইত্যাদি সংক্রান্ত বাধা-নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আইনত দ-নীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিবেশের ক্ষতিরোধকল্পে সরকার, অন্যান্য আইনের বিধান সাপেক্ষে, বিধি দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, ধারণ, মজুদকরণ, বোঝাইকরণ, সরবরাহ, পরিবহণ, আমদানী, রপ্তানি, পরিত্যাগকরণ ডাম্পিং ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
এছাড়া বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশের সুরক্ষার জন্য এবং দূষণমুক্ত রাখার জন্য বেশকিছু আইন প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭, ওজোনস্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৪, পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, বাংলাদেশ জীবন নিরাপত্তা বিধিমালা-২০১২, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭, জাতীয় পরিবেশ নীতি-২০১৮, ঝুঁকিপূর্ণ ই-বর্জ্য বিধিমালা-২০২১, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনানীতিমালা-২০২১। তবে শঙ্কার কথা হলো এসব নীতিমালা মহান সংসদে পাশ হলেও এটি প্রয়োগে কর্তৃপক্ষের যথাযথ তৎপরতা দেখা যায়নি। ফলে বন্ধ করা যায়নি পলিথিন ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্যের ব্যবহার।
প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার কমাতে জরুরি ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তাহলো: প্লাস্টিকের বেআইনি উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার রোধে দূষণ ‘কর’ প্রয়োগ করতে হবে। বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যদিও আমাদের জীবনে প্লাস্টিকের দ্রব্যের ভূমিকা স্বীকার্য, তবে তা ব্যবহারে সতর্কতা এবং পরিমিতি আবশ্যক। প্লাস্টিকের দ্রব্যকে বারবার ব্যবহার ও পুনর্চক্রায়ণকে (রিসাইক্লিং) উৎসাহিত করতে হবে। প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সব অংশীজনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কমিউনিটিভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে সরকার ও বেসরকারি খাত কর্তৃক বিভিন্ন প্রণোদনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোতে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ/সীমিত করতে হবে এবং প্লাস্টিকের পরিবেশবান্ধব বিকল্প উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা করতে হবে।
লেখক: জাহিদুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় প্রেসক্লাব।
ও ড. মল্লিক আকরাম হোসেন, অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ
আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি
কিউবায় সমাবেশ