সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শালীনতার সীমা-পরিসীমা
০৬ জুন ২০২৩, ০৮:১৭ পিএম | আপডেট: ০৭ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম
স্যোসাল মিডিয়ার কল্যাণে ‘মিম’, ‘ট্রোল’ এই বিষয়গুলো প্রায় সবার জানা। যতক্ষণ পর্যন্ত এগুলো নির্ভেজাল, সামান্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা ‘স্যাটায়ার’-এর মধ্যে ছিল, ততদিন মেনে নেওয়া যাচ্ছিল। সেখানে বরং অনেক ক্রিয়েটিভিটি থাকত। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যেত। একটা নতুন ট্রেন্ড, নতুন প্রজন্ম এবং নতুন প্রযুক্তি, কিছু নিয়ম ভাঙার খেলা তো হবেই। মুশকিল হচ্ছে, আমরা অনেক সময় সীমা ছাড়িয়ে যাই। তখন স্বাধীনতার পূর্ণ অপব্যবহার হয়। শিক্ষা, রুচি, বিচার, বিবেচনা জলাঞ্জলি দিয়ে অশালীন হয়ে পড়ি।
বাকসংযম সামাজিক ক্ষেত্রে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য জরুরি। বড়দের বা ছোটদের সঙ্গে, ছোটরা বড়দের সঙ্গে এবং সমাজের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলব, কেমন ব্যবহার করব, তার একটা সুস্পষ্ট গাইডলাইন অলিখিতভাবে মেনে চলাটা সামাজিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। এটাকে নিছক অনুশাসন বলা যাবে না। এটা সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার সামাজিক রীতি। এই রীতি কেউ মানবে কিনা, সেটা যার যার নিজের বিবেচ্য। আমরা যারা মেনে এসেছি, তারা এতে নিশ্চিতভাবে সুফল পেয়েছি। তার মানে এই নয়, আমরা প্রতিবাদ করি না। এই নয় যে, সামাজিক বৈষম্য বা অন্যায়, অসামঞ্জস্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলি না। এক্ষেত্রে রীতি মেনে চলি। কোনও অবস্থাতেই নিজের শিক্ষা ও রুচিকে নি¤œগামী করি না। যেটা করব, সেটা শালীনতা, শিষ্টতার মধ্যে থাকে।
নিঃসন্দেহে পারিবারিক শিক্ষাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে পড়ছে, শৈশবে, উঠতে-বসতে অভিভাবকদের এ ব্যাপারে রীতিমতো নজর থাকত আমাদের ওপর। কোথায় কী বলব, কতদূর বলব, তার একটা স্পষ্ট নির্দেশিকা মেনে চলতে হতো। আমাদের সময়ের সব শিক্ষা ভাল, এমন কথা বলা একপেশে হয়ে যাবে। তবে এটা ঠিক, কথাবার্তা, আচার-ব্যবহারের সেই শিক্ষা আজও কাজে লাগে আমাদের। একটা সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ বজায় রাখতে অনেকটাই সাহায্য করে।
সোস্যাল মিডিয়া আমাদের সমাজের বাইরে নয়। এর গুরুত্ব এখন অসীম। এ মিডিয়া আমাদের যাপিতজীবনের বহু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে, এক অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক সমস্যার। আগেই বলেছি, সুসম্পর্ক বজায় রাখার রীতি সুস্থ সামাজিক বাতাবরণ সৃষ্টির প্রক্রিয়া। সেই রীতি না মানার প্রবণতা এখন ফেসবুক খুললেই দেখা যায়। যে যাঁকে যা খুশি বলছে, যেভাবে পারছে অপমান করছে, গালিগালাজের তো কোনও সীমা নেই। কারও বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রথম ধাপটাই হলো, তাকে অকথ্য গালিগালাজ, খিস্তিখেউড় এবং নানাভাবে কলঙ্কিত করা। একটা শ্রেণি প্রবলভাবে সক্রিয়, যারা দিনরাত এ অপকর্ম করে। এরা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ভাল কিছু, যা সমাজের অগ্রগতির পক্ষে, সেটা করে না। এরা প্রযুক্তির সাহায্যে লোকজনকে নিয়ে নোংরা ‘মিম’ বানায়, ‘ট্রোল’ করে, তারপর তা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেয় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটারে। ভাইরাল করা, ভাইরাল হওয়ার ব্যাপারটাকে এখন ভাইরাসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। একশ্রেণির মানুষের ভেতর কী পরিমাণ বিদ্বেষ জমা থাকে, সেই বিষ কিভাবে নির্গত হতে পারে, সেটা শুধু ফেসবুক বিচরণের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়।
শুধু পোস্ট বা কমেন্টও যদি দেখি, সেখানে সহমত না হলেই আক্রমণ। সেই আক্রমণের ভাষাও অশ্লীল, অশালীন। রাজনৈতিক দলের সভা, সমর্থক হলে তো কথাই নেই। সাম্প্রতিক সময়ে বহু ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে সামাজিক কাজকর্ম করে এমন সংস্থার মধ্যেও দেখেছি চরম ঔদ্ধত্য। সেখানে এমন সব গালিগালাজ করা হয়, যা কোনো সভ্য মানুষের পক্ষে উচ্চারণ করা যায় না। এদের কথোপকথন পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, ফেসবুকের পাতাতেই কি এভাবে নিজেদের প্রকাশ করে এরা? নাকি মুখোমুখি হয়ে ভাব বিনিময়েরও এটাই রীতি? বলতে খারাপ লাগে, পরিণত বয়স্ক অনেক মানুষের মধ্যেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। রাগ, ক্ষোভ, জ্বালা বিরক্তি প্রকাশে এ ধরনের ভাষার ব্যবহার কি অপরিহার্য? এই আচরণ, ব্যবহার, মুখের ভাষা নিয়ন্ত্রণের কি কোনও উপায় আছে? প্রয়োজন যে আছে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু এর শুরুটা কোথা থেকে হবে? আগে তো এর কুফল সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে, এটা সভ্যতা নয়। এটা করে চললে শিক্ষা, বুদ্ধি, যুক্তির চর্চা ক্রমশ কমতে থাকবে। বড় কথা হচ্ছে, যারা এর ভিকটিম হচ্ছে, তাদের কথা ভাবা দরকার। তারা যে অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যায়, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? সাধারণভাবেও ফেসবুকের সবাই যে এটা পছন্দ করে, এমনটাও নয়। এমন তথাকথিত বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে গিয়ে কতজনকে আনফ্রেন্ড আর ব্লক করা যায়? এতে তো সুস্থ ভাবনার আদান-প্রদানটাই বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের পুলিশ বাহিনীর গৌরবজ্জ¦ল ইতিহাস আমাদের জানা। অতীতে দেশ বা জাতির বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র হয়েছে, তারা তা দৃঢ় হস্তে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। মহতি এ কাজের জন্য তাদেরকে সাধুবাদ জানাই।
জানি না, আজকের সোস্যাল মিডিয়ায় বিচরণকারী কতজন মানুষ এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। আইন করে, অর্থাৎ সেন্সর করে কি এই ট্রেন্ড বন্ধ করা সম্ভব? এ প্রসঙ্গে একটা ছবির কথা মনে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এক চেনা মহলে আড্ডা হচ্ছে। কেউ সাংবাদিক, কেউ বিনোদন জগতের। একজন আমাকে প্রশ্ন করল, ‘দিল্লি বেলি’ দেখেছ? না দেখলে দেখে নাও। নয়তো মিস করবে। ছবিটা সদ্য মুক্তি পেয়েছে। কিছুটা বিতর্কও তৈরি করেছে। বিষয়টা সেটা নয়। সেই সময় আমার কর্মব্যস্ততা এতটাই ছিল যে, ইচ্ছা থাকলেও সব ছবি হলে গিয়ে দেখা হতো না। সাংবাদিকতা করলেও ছবির প্রিমিয়ারে অন্যকে পাঠাতে হয়েছে, এমনটাও ঘটেছে। অতএব টিভিই ভরসা।
আমার এ অবস্থার কথা ওই আড্ডা মহলের সবাই জানত। আর আমার ভাবনার সূত্র ধরেই একজন বলে ওঠে, কবে টিভিতে আসবে, সেই আশায় যদি থাকো, তবে, ‘দিল্লি বেলি’ দেখার ইচ্ছা তোমাকে ত্যাগ করতে হবে। জিজ্ঞেস করতেই জানলাম, টিভিতে যখন ছবিটা দেখানো হবে, তখন তা হলে পুরো সময়টাই সংলাপের বদলে ‘বিপ’ শুনতে হবে। এটা সত্যি, সংলাপে অত্যধিক গালিগালাজ ব্যবহারের কারণে এ ছবি সেসময় কোনও ভারতীয় চ্যানেল দেখাতে পারেনি। এই প্রয়োগ নিঃসন্দেহে গল্পের প্রয়োজনে। কিন্তু টিভি যেহেতু পারিবারিক বিনোদন মাধ্যম, তাই এই বাধ্যবাধকতা। সাধারণভাবে সিনেমা বা বিনোদনের যেকোনও মাধ্যমে আজও এই বিধিনিষেধ আছে। ফেসবুক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সভ্যতা ও রুচির প্রয়োগ থাকা জরুরি। যারা এগুলো ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব এই রুচিবোধের প্রয়োগ থাকা দরকার। যারা অশালীন, তাদের বর্জন করে নিজের পেজকে শালীন করা তাদের দায়িত্ব।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ
আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি
কিউবায় সমাবেশ