ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

আমাদের গবেষণা খাত এত নড়বড়ে কেন?

Daily Inqilab ড. অজয় কান্তি মন্ডল

১৭ জুন ২০২৩, ০৯:২৪ পিএম | আপডেট: ১৮ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম

যেকোন দেশকে উন্নতির শিখরে নিতে বিজ্ঞান চর্চার বিকল্প নেই। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় যে দেশ নিজেকে যত বেশি এগিয়ে নিতে পেরেছে সে দেশ তত বেশি সুফল পেয়েছে। বিশ্বের দরবারে দ্রæত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার জনজীবনকে সহজ থেকে সহজতর করছে। বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। আজকের গবেষণা নিঃসন্দেহে আগামীকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করবে। তাই আগামী দিনগুলোকে আরও সহজতর করতে বিজ্ঞান ও গবেষণায় ব্রতী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বর্তমানে সকলের হাতে হাতে শোভাকৃত স্মার্ট ফোন যেমন রাতারাতি আবিষ্কৃত হয়নি, ঠিক তেমনি নতুন কোনো কিছু আবিষ্কারের পেছনে এক একজন গবেষকের রয়েছে নিরলস শ্রম, মেধা এবং ছোট ছোট সংযোজন ও বিয়োজন। সেখানে গবেষকরা প্রখর মেধা খাটিয়ে, সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তির দ্বারা একটু একটু করে গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে জনগণের দোরগোড়ায় গবেষণালব্ধ ফলাফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

প্রকৃত মেধাবীরাই গবেষণাকে পেশা হিসাবে বেছে নেয়। কেননা কেউ প্রকৃত গবেষকের স্বীকৃতি পেতে গেলে তার ভিতরে সৃজনশীল চিন্তা শক্তি থাকতে হবে, যে চিন্তাশক্তি হবে ‘ইনোভেটিভ’। সহজ ভাষায় যাকে বলা যায়, গবেষকের উদ্ভাবনীর ভিতরে নতুনত্ব থাকতে হবে। যে গবেষকের উদ্ভাবনীর ভিতরে যত বেশি নতুনত্ব থাকবে তিনি বিশ্বব্যাপী তত বেশি সমাদৃত হবেন। এজন্য ভালো মানের গবেষক গবেষণায় সবসময় নতুনত্ব আনার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকেন। আর এজন্য একজন গবেষককে গবেষণা কাজ পরিচালনা করতে সর্বপ্রথম গবেষণার ডিজাইন করা লাগে। যিনি এই গবেষণার ডিজাইন করেন বাইরের দেশে তাঁকে ‘মেন্টর’ বলে। একজন মেন্টরের অধীনে বেশ কয়েকজন গবেষক বা ছাত্র-ছাত্রী থাকেন। মেন্টর তার গবেষণার ক্ষেত্র অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বের নিত্য নতুন অ্যাডভ্যান্সড আবিষ্কারের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখার চেষ্টা করেন। আর এটি করার জন্য তাকে বিশ্বে প্রতিনিয়ত কি আবিষ্কার হচ্ছে সে বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান আহরণ করার প্রয়োজন পড়ে। পাশাপাশি নিজের গবেষণার ক্ষেত্র অনুযায়ী সা¤প্রতিক সময়ে প্রকাশিত প্রচুর গবেষণাপত্র পড়া লাগে। এসব গবেষণাপত্র পড়ার পরে মেন্টর নিজের মেধা ও বুদ্ধি খাটিয়ে এবং প্রোডাক্টিভ চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক একটি নতুন গবেষণার জন্য থিম বের করেন। যে থিম অনুযায়ী মেন্টরের অধীনে কর্মরত গবেষকরা পরবর্তীতে ল্যাবওয়ার্ক করেন। এই থিমের মধ্যে অবশ্যই ইনোভেটিভ কিছু থাকতে হবে। বিশ্ব সর্বদা এগিয়ে যাচ্ছে, তাই একজন গবেষক তার উদ্ভাবনীর ভিতরে যত বেশি নতুনত্ব আনতে পারবেন তিনি বিশ্বের কাছে তত বেশি পরিচিতি পাবেন। সেইসাথে তার গবেষণা ততবেশি পরিচিতি লাভ করবে। তাই মেন্টরের ভ‚মিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণায় ভালো আউটপুট আনতে গেলে টিমওয়ার্কের কোনো বিকল্প নেই। বাইরের দেশে এই টিমকে বলে ‘রিসার্চ গ্রæপ’। সেখানে একজন মেন্টরের অধীনে একের অধিক রিসার্চ গ্রæপ থাকে। প্রতিটি রিসার্চ গ্রæপে বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে শক্তিশালী টিম গড়ে ওঠে। তাদের গবেষণার ক্ষেত্র নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ঐ সকল ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রতিনিয়ত কি আবিষ্কার হচ্ছে সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে আমলে নিয়ে টিমের সবাই তাদের চিন্তাশক্তির দূরদর্শিতা খাটিয়ে নিজেদের ভাবনাগুলো মেন্টরকে অবহিত করেন, যাতে করে মেন্টরের নতুন থিমকে সামনে এগিয়ে নিতে অনেক বেশি সুবিধা হয়। স্বভাবতই একজন মেন্টরের স্বশরীরে ল্যাব ওয়ার্ক করার প্রয়োজন পড়ে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেন্টররা সা¤প্রতিক সময়ে প্রকাশিত গবেষণার উপর ভিত্তি করে নিজের আইডিয়া খাটিয়ে নতুন গবেষণা সৃজন করেন। একজন মেন্টরকে গবেষণার ডিজাইন করতে গিয়ে নিজেদের গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং আপডেটেড অর্থাৎ স¤প্রতি প্রকাশিত প্রচুর গবেষণাপত্র পড়তে হয়। এজন্য প্রথম দরকার পড়ে গবেষণাপত্রগুলোর সংশ্লিষ্ট জার্নালে ফ্রি এক্সেস বা গবেষণাপত্রগুলো ফ্রি ডাউনলোড করার। যেসব দেশ গবেষণা সেক্টরে এগিয়ে সেখানে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যে কোনো জার্নালের গবেষণাপত্র ডাউনলোড করার জন্য নির্দিষ্ট হারে ফি পরিশোধ করে নিবন্ধিত থাকে। ফলে দেদারসে যেকেউ সেই বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাগারের নেটওয়ার্কের আওতায় গবেষণাপত্র অনালাইনে পড়া বা ডাউনলোড করতে পারে। আমাদের দেশে এই সুযোগ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আছে কিনা আমার জানা নেই।

মেন্টর বা রিসার্চ গ্রæপ গড়ে ওঠার মতো রীতি আমাদের দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংস্কৃতিতে খুব একটা বেশি শোনা যায় না। সেকারণে আমরা বিশ্বের সাথে আপডেটেড গবেষণার ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে বলা যায়। সেইসাথে যেকোন গবেষক তার চাহিদানুযায়ী গবেষণাপত্র ডাউনলোড করতে পারছেন না। অনালাইনে কিছু সাইট আছে যেটা ব্যবহার করে কিছু কিছু পুরানো গবেষণাপত্র ডাউনলোড করা যায়। কিন্তু সা¤প্রতিক সময়ে প্রকাশিত গবেষণাপত্র ডাউনলোড করতে গেলে যদি প্রতিষ্ঠানের এক্সেস না থাকে তাহলে ফি ব্যতীত কোনভাবেই সেটি সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে একজন গবেষক কীভাবে আপডেটেড গবেষণাপত্র পড়বে সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কেউ যদি একটি গবেষণাপত্র জার্নাল কর্তৃক নির্ধারিত ফি দিয়ে ডাউনলোড করতে চান তাহলে সেটা আদৌ ফিজিবল নয়। কেননা, জার্নালগুলোর নির্ধারিত ফি অনেক বেশি। দেশীয় টাকায় সেটা কয়েক হাজার টাকা, যেটা ব্যক্তি পর্যায়ের একজন গবেষকের পক্ষে পরিশোধ করা কঠিন। অনেকেই যখন তার নিজের গবেষণার ফিল্ড সম্পর্কিত নতুন একটি গবেষণাপত্র খুঁজে পাওয়ার পর, প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি ডাউনলোড করে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না, তখন পরক্ষণেই তিনি গবেষণার আগ্রহ থেকে সরে আসছেন। আমার ক্ষেত্রেও এরকম বেশ কয়েকবার হয়েছে। ফলে দেশের গবেষকরা ভালো মানের গবেষণা বের করতে হিমশিম খাচ্ছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো গবেষক বা মেন্টর তৈরি হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গবেষণা খাতকে এগিয়ে নিতে হলে এই বিষয়টি অবশ্যই আমলে নিতে হবে, যেখানে একজন গবেষক অনায়াসে যেকোন জার্নালের গবেষণা প্রবন্ধ ডাউনলোড করতে পারবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জার্নালগুলোতে এক্সেসের জন্য নিবন্ধিত হতে পারে।

কোনরকমে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে গবেষণাপত্র লেখার পরে সেটির পাবিøকেশনেও বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। যেমন, ওপেন এক্সেস জার্নালে (যেখানে গবেষণাপত্র কোনরকম ফি ছাড়া যেকেউ ডাউনলোড করতে পারে) গবেষণাপত্র পাবিøকেশনে করতে গেলে ‘আর্টিকেল প্রসেসিং চার্জ’ নামে পাবিøকেশন ফি দেওয়া লাগে। এই ফি নির্ভর করে জার্নালগুলোর কোয়ালিটি তথা সামগ্রিক র‌্যাংকিং, যেমন, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, কোয়ারটাইল র‌্যাংকিং, সাইন্স স্কোপাস ইন্ডেক্সের (SCI)) অধিভুক্ত কিনা এরকম অনেক বিষয়ের উপর। দেশীয় টাকায় এই আর্টিকেল প্রসেসিং চার্জ লক্ষ লক্ষ টাকা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, পাবিøশার Elsevier কর্তৃক পাবিøশকৃত ৮ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের একটি জার্নালে ওপেন এক্সেস পাবিøকেশনে চার্জ দিতে হয় ৩৯২০ ইউএস ডলার, দেশীয় টাকায় যেটা প্রায় ৪ লাখ টাকা। এই পাবলিকেশন ফি দিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশে সহয়তা করে এমন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। কেননা আমাদের দেশে গবেষণা খাতে সেই ধরনের বাজেট বরাদ্দ নেই। অথচ, বাইরের দেশগুলো হরহামেশাই এর চেয়ে অধিক ফি দিয়ে পাবিøকেশন করে যাচ্ছে। তাদের গবেষণায় যথেষ্ট ফান্ড আছে। চাওয়া মাত্র সেই ফান্ড থেকে কেমিক্যাল ক্রয় বা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার অন্যান্য খাতে পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায়। সেজন্য তারা যেকোন জার্নালে অনায়াসে গবেষণাপত্র পাবিøশ করতে পারেন।

চীন বর্তমানে পাবিøকেশনে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। পূর্বে আমেরিকা এই অবস্থানে থাকলেও বর্তমানে চীনকে টপকানো দুঃসাধ্য হয়েছে। কেননা চীনাদের গবেষণা খাত অনেক মজবুত। বিজ্ঞান ও গবেষণা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ব্যতীত কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়, চীনারা বহু পূর্বে এটা ভালো করেই বুঝে গেছে। তার সুফল চীনারা পদে পদে পাচ্ছে। চীনে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার গবেষণা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গিয়েছি। প্রতিবার এমন হয়েছে যে, এয়ারপোর্টের নির্দিষ্ট বোর্ডিংয়ের গেটে গিয়ে দেখতাম সবই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। বিমানে ভিতরে গিয়ে দেখতাম পুরো বিমানের ৮০ ভাগই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রী। পরবর্তীতে পরিসংখ্যান মেলানোর চেষ্টা করতাম এবং খেয়াল করতাম আমাদের ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মাস্টার্স এবং পিএইচডি অধ্যয়নরত যত ছাত্র-ছাত্রী আছে তাদের সবাই মোটামুটি কনফারেন্সে যোগ দিচ্ছেন এবং সেই সাথে বহু শিক্ষক থাকতেন। কনফারেন্সে গিয়ে সবাই নিজ নিজ গবেষণা উপস্থাপনা করতেন। কনফারেন্সের ৩ দিন থ্রি স্টার বা ফোর স্টার আবাসিক হোটেলে থাকা খাওয়া এবং যাতায়াতের ব্যয়ভার সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খরচের বিষয়টি উপেক্ষা করত। কেননা তাদের গবেষণা খাতে বরাদ্দ সেই অনুপাতেই ছিল। গবেষণা খাতকে এগিয়ে নিতে হলে এভাবেই অগ্রসর হওয়া উচিত। নচেৎ এই খাত দিনকে দিন মুখ থুবড়ে পড়বে। চীনাদের গবেষণা খাতে এই বিপুল বরাদ্দের ফলাফল কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাতে নাতে পায়। তিন বছর মেয়াদী মাস্টার্সে অধ্যয়নরতদের দেখেছি, তারা ৫টির কম কেউ পাবিøকেশন করে না এবং পাবিøশকৃত সব জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর অনেক বেশি।

চীনারা আমাদের চেয়ে মেধাবী, এটা আমি কখনো বলার পক্ষপাতি না। কিন্তু তাদের সুযোগ সুবিধার কোনরকম ঘাটতি নেই। সবার আগে যে বিষয়টা আমি বলব সেটা হচ্ছে, চীনাদের গবেষণা খাতে বরাদ্দ পর্যাপ্ত। চীনাদের বিভিন্ন ন্যাশনাল প্রকল্প আছে যেটা শুধুমাত্র গবেষণার লক্ষ্যে ব্যয় করা হয়। চাওয়া মাত্র কেমিক্যাল বা যাবতীয় গবেষণা সামগ্রী হাতের নাগালে পাওয়া যায়। ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য শিক্ষকরাই ছাত্র-ছাত্রীদের চাপ দেন। কেননা শিক্ষকেরা জানেন শিক্ষার্থীদের চাপে রাখতে পারলে তাদের থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী বের হবে। উপরন্তু কনফারেন্সে গিয়ে নিজের আইডিয়াকে সবার সামনে উপস্থাপন করার পাশাপাশি অন্যদের থেকে আইডিয়া নিয়ে আসবে। গবেষণাকে এগিয়ে নিতে নিজের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষকদের আইডিয়া ভাগাভাগি করার জুড়ি নেই। আমার পিএইচডি চলাকালীন ফার্স্ট অথোর হিসেবে ৮টি পাবিøকেশন করেছিলাম, যার মধ্যে শেষের ৪টি ছিল ১ বছর সময়সীমার মধ্যে। সেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটস্টান্ডিং পারফরম্যান্স। কীভাবে ১ বছরে ৪টি পাবিøকেশন করা সম্ভব হয়েছিল, সে বিষয়ে একটু বলে রাখি। ল্যাবের কাজ করতে গিয়ে কখনো কোনো রকমের সমস্যার সম্মুখীন হইনি। ল্যাবের কোনো কেমিক্যাল বা এক্সেসরিস লাগলে সুপারভাইজারকে বলার সাথে সাথে উনি অর্ডার করতেন। কিছু কেমিক্যাল দিনের দিন হাতে পেয়ে গেছি আবার কিছু আসতে ২/৩ দিন সময় লেগেছে। তবে কোনো কেমিক্যাল যেটুকু লাগার কথা বলতাম সুপারভাইজার তার দ্বিগুণ/তিনগুণ অর্ডার করতেন। দাম বেশি হলেও কখনো এই বিষয়ে তিনি কার্পণ্য করেননি। সবই ভালো ব্র্যান্ডের কেমিক্যাল কিনেছেন। স্যাম্পল ক্যারেক্টারাইজেশন বা অ্যানালাইসিস করার জন্য যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে সেই মেশিনারিজ সুবিধা না থাকত তাহলে মুহূর্তের মধ্যে সুপারভাইজার অনলাইন ঘেঁটে যেখানে অ্যানালাইসিস করার সুযোগ ছিল সেখানে স্যাম্পল পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। ৩/৪ দিনের ভিতরে রেজাল্ট হাতে পেয়ে যেতাম। সেজন্য ল্যাবের কাজে কোনো রকম সময়ক্ষেপণ হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশে এধরনের কোনো সুযোগই নেই। কমদামী সব কেমিক্যালে ভেজালের আধিক্য আবার ভালো ব্র্যান্ডের কেমিক্যালের দাম মাত্রারিক্ত। সেটা পর্যাপ্ত ফান্ড ছাড়া আদৌ ক্রয় করা সম্ভব নয়। এখানে বলে রাখা ভালো, একজন গবেষক বহু পড়ালেখার পরে নিজের সৃজনশীল মেধা খাটিয়ে একটি গবেষণা ডিজাইন করেন। ভেজালযুক্ত কেমিক্যাল দিয়ে ল্যাব ট্রায়াল দেওয়ার পরে সেই গবেষণা সাকসেক্স হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ওই গবেষকের গবেষণার মোড় পুরোপুরি বিপরীত দিকে ঘুরে যায়। তাই ডিজাইনকৃত যেকোন রিসার্চকে বাস্তবে রূপ দিতে ভেজালমুক্ত কেমিক্যালের বিকল্প নেই। কিন্তু ভেজালমুক্ত ভালো ব্র্যান্ডের কেমিক্যাল ক্রয় করতে যথেষ্ট ফান্ড দরকার, যেটার সীমাবদ্ধতা বরাবরই লক্ষনীয়। এজন্য এরকম উভয়সংকটে পড়ে দেশীয় গবেষকরা ঠিকমত এগোতে পারে না। ফলে বহু গবেষণা কার্যক্রম সফলতার মুখ দেখতে পায় না।

অবশ্য চীনাদের গবেষণা খাতের সাথে আমাদের দেশের গবেষণা খাতকে মেলাতে গেলে সবকিছু এলোমেলো লাগে। আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাগারের ওয়েবসাইট যথেষ্ট আপডেটেড না। সেখানে সহজে কেউ কোনো স্যাম্পল অ্যানালাইসিসের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্সট্রæমেন্ট বা প্যারামিটার খুঁজে পায় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অহেতুক কালক্ষেপণ করা হয়, সেইসাথে অ্যানালাইসিসের ফি পরিশোধ নিয়ে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা তো আছেই। চাহিদানুযায়ী ফান্ড, শিক্ষক, গবেষণা বান্ধব পরিবেশ, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের পাবিøকেশন প্রতি মোটা অংকের আর্থিক সম্মানী, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশগ্রহণের সুযোগ চীনাদের গবেষণা খাতের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রেখেছে। সেখানে গবেষণা করার জন্য শুধুমাত্র তার মনোভাবই যথেষ্ট। ফান্ডের অপর্যাপ্ততা বা অন্যান্য কোনরকম ঝামেলা চীনাদের নেই। কিন্তু আমরা এই সবকয়টি ইন্ডিকেটর থেকে বেশ পিছিয়ে। আমাদের দেশের খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা গবেষক দেশে বা দেশের বাইরে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়। একটি গবেষণার সুফল যেমন একদিনে আসে না, ঠিক তেমনি প্রতিটি আবিষ্কার বহু গবেষকের হাত বদলে একটু একটু সংযোজনের মধ্য দিয়ে তার পূর্ণতা পায়। তাই গবেষণার ক্ষেত্রকে ছড়িয়ে দিতে সকলের মাঝে উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে বহু গবেষকের সাথে নিজের আইডিয়াকে ভাগাভাগি করার। ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সগুলোতে ঠিক এমনটাই হয়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের উদ্ভাবনীকে উপস্থাপনের মাধ্যমে বিস্তর জ্ঞান আহরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের দেশে এই ধরনের চর্চা খুব একটা দেখা যায় না।
প্রতিবছর খবরে প্রকাশিত হয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দকৃত কোনো অর্থই ব্যয় হয়নি। এসব বিশ্ববিদ্যালয় চিহ্নিত করে সেখানে বরাদ্দ বন্ধ করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকার অর্থে গবেষণা করে সেখানে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। একমাত্র পর্যাপ্ত ফান্ড, সময়ে সময়ে গবেষকদের দেশীয় বা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ, গবেষকদের গবেষণার ক্ষেত্র বিষয়ক প্রশিক্ষণসহ গবেষকদের পারফরম্যান্স অনুযায়ী বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পরে তাদের থেকে ভালো আউটপুট আশা করা যায়। প্রকৃত মেধাবীদের গবেষণায় গভীর মনোনিবেশ করতে গবেষণা বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। গবেষণা কর্মকাÐ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে কী কী প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা আছে সেগুলো খুঁজে বের করে নীতি নির্ধারকদের সুষ্ঠু সমাধানই পারে এই খাতকে আলোর মুখ দেখাতে। অন্যথায় এই সেক্টর দিনকে দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

‘স্পেন্ড অ্যান্ড উইন’ ক্যাম্পেইনের বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে মাস্টারকার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

সিটি ব্যাংক আনল অভূতপূর্ব ভিসা ইনফিনিট ক্রেডিট কার্ড

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

শেখ হাসিনার কোনো ক্ষমা নেই, জবাব তাকে দিতেই হবে : মির্জা ফখরুল

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে খুনিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে