শেয়ারবাজার : এ পথের শেষ কোথায়?
২৪ জুন ২০২৩, ০৮:১৮ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম
বিশ্ব এক টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে জীবনযাত্রার সংকট কেবলই তীব্র হয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষেরই আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। কবে যে যুদ্ধটা থামবে। আর বিশ্ব ফিরে পাবে তার চিরচেনা স্বাভাবিকতা, এটাই এখন সবার বড় চিন্তার বিষয়। স্বল্প, মধ্যম বা উন্নত দেশ, ভালো নেই কেউই। বিশেষ করে, অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিই সব সর্বনাশের মূল। আর এর মধ্যেই আসছে আমাদের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন মানেই অস্থিরতার শঙ্কা। এই পূর্বানুমান করা মোটেও অসাধ্য নয় যে, নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য এক দুঃসহ সময় অপেক্ষমান। তবে নির্বাচনী বছরে অর্থনীতির অবস্থা যে রকমই থাকুক না কেন, শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি যেন একটু ভালো থাকে, সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই এরকমই আশা করেন। স্বাভাবিকভাবেই অন্য সবার চেয়ে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা একটু স্বপ্নচারী। নির্বাচনের আগে এটি সরকারের শেষ বাজেট। তাই তো নির্বাচনী বাজেট নিয়ে বিনিয়োগকারীদের অনেক প্রত্যাশা, নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে তাদের জন্য কোনো সুখবর রেখেছেন। ব্রোকার হাউসগুলোও বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতিতে সরগরম। সবকিছু ভুলে তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। অন্তত লেনদেনের চাঙ্গাভাবে এটাই প্রতিভাত হয়। গত বছরের নভেম্বরের পর লেনদেন ছাড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপর। লেনদেনের ওপর ভর করে ঝিমিয়ে থাকা সূচকেও দেখা যাচ্ছে, কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন, শেয়ারবাজার প্রাণবন্ত ও বিনিয়োগবান্ধব করার লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে যে প্রণোদনাগুলো প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয়েছে, তা থেকে বাজেটে অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই কিছু না কিছু বিবেচনা করবেন, যা শেয়ারবাজার স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখবে। যেমন: বন্ড থেকে সুদের আয়ের ওপর কর অব্যাহতি, যা একটি শক্তিশালী বন্ড বাজার তৈরি করবে। একটি কার্যকর বন্ড বাজার অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে পারে। আবার দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা সাধারণত শেয়ারবাজার থেকে লভ্যাংশ আকারে যে মুনাফা লাভ করেন, তা কিন্তু কোম্পানিগুলোর কর-পরবর্তী মুনাফা। তাই এই লভ্যাংশের ওপর আবার কর, এটি এক ধরনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের করারোপ। এটি বাতিল করে লভ্যাংশের ওপর উৎস কর চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচিত হলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জের স্টেকহোল্ডারদের উৎসে কর হ্রাস করতে হবে। এটি এই মন্দা বাজারে তাদের টিকে থাকতে সহায়তা করবে। এসএমই বোর্ডের অধীনে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য রেয়াতযোগ্য হারে কর আরোপের দাবি জানানো হয়েছে। তাহলে ওই কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহী হবে এবং শেয়ারবাজারের গভীরতা বৃদ্ধি করবে। মূলত এই প্রস্তাবগুলো নিয়েই বিনিয়োগকারীদের একটু বাড়তি প্রত্যাশা। নিশ্চয়ই শেয়ারবাজারের জন্য বাজেটে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। তবে অভিজ্ঞরা শেয়ারবাজারের সাময়িক মুভমেন্টের জন্য এই ইস্যুগুলোই বড় করে দেখেন না। তাদের অভিজ্ঞতা বা বিশ্লেষণ বলছে, অন্য কিছু। লক্ষ্যনীয়, ব্রোকার হাউসের সবারই আলোচনার বিষয় বাজেট। আর এই সময়ে বরাবরই দেখা যায়, বাজেটে বিানয়োগকারীদের যৌক্তিক চাওয়া-পাওয়াগুলো পেছনে ফেলে, সবচেয়ে যে বিষয়টি আলোচনার বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, সেটি হলো কালোটাকা বিনিয়োগ। তবে এবারে মনে হয়, কালোটাকার বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের ভাবনার জায়গায় অতটা গুরুত্ব পায়নি। অহেতুক ভেবেই বা কী লাভ? প্রত্যাশিত হারে কালোটাকা কখনো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়নি। দেখা গেছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত নামমাত্র ৪৯ জন কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন। তাই অর্থমন্ত্রীও বোধহয় হতাশ। তিনি দেশের মধ্যে থাকা কালোটাকা বিনিয়োগের চেয়ে, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ সুযোগ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও তিনি ব্যর্থ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকারের এ সহজ সুযোগ কেউ গ্রহণ করেছে এমনটি জানা যায়নি। এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রচারের অভাব ও আস্থার সংকটে কেউ বৈদেশিক সম্পদ ফেরত আনার সুযোগ নেয়নি। তবে এটি কীভাবে আরও প্রচার করা যেত, সে সম্পর্কে তারা স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। সরকার বুঝতে ব্যর্থ হলেও অনেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন, পাচারকৃত টাকা দেশে ফিরবে না এবং আগামী বাজেটে এ সুযোগ আর রাখা হবে না। এটি একটি মনস্তাত্বিক ব্যাপার বই আর কিছু নয়। তাই কালক্রমে কালোটাকার বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের কাছে এখন আর খুব বেশি অর্থবহ কিছু নয়। দীর্ঘ সময় ধরে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এতে মানুষের উপার্জন কমে গেছে। অন্যদিকে লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যয় বেড়েছে। ফলে মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না। তাই ব্যাংকে যেমন আমানত কমছে, তেমনি অন্যান্য সঞ্চয়ী উপকরণেও বিনিয়োগ প্রবণতা কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে জানা গেছে, অর্থনীতির এই অবস্থায় বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণ গ্রহণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ৩৭ শতাংশ পরিবার ঋণ গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই যখন সামষ্টিক অর্থনীতির হাল, তখন শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী। অথচ, বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য কোনো সুখবর রাখা হয়নি। বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনেও দেখা গেছে, অর্থমন্ত্রী, সচিব ও গভর্নর শেয়ারবাজার প্রশ্নেরÑউত্তর, একে অপরকে পাস দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয়, এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়েনি। না, এটা এত সরল দৃষ্টিতে দেখতে রাজি নন বোদ্ধারা। কারণ, অস্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক আচরণ, এটি একটি অস্বাভাবিকতার লক্ষণ। সাম্প্রতিক সময়ে বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ছেড়ে ওপরে উঠে গেছে। কিন্তু ভালো মৌলভিত্তি শেয়ারের কোনো ক্রেতা নেই। লেনদেনে শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভালো মৌলভিত্তি শেয়ার আতশি কাচ দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়। লেনদেন যা হয়, এর এক-তৃতীয়াংশ নির্দিষ্ট একটি সেক্টরের। জানা যায়, সেই সেক্টরে নাকি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই কোনো কোনো শেয়ারদর বেড়ে তিন-চারগুণ হয়েছে। এটি কি কোনো স্বাভাবিক বাজার? নাকি সেই পুরোনো বীমা খাতের প্রেতাত্মারা বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, এবারের বাজেটে তালিকাভুক্ত আর অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করের পার্থক্য আরেকটু বাড়ানো যেত কি না। এটি করলে নিঃসন্দেহে ভালো হতো। তবে ভেবে দেখার বিষয় হলো, শেয়ারবাজারে যেসব ভালো কোম্পানি রয়েছে, সেগুলো কি যথাযথ মূল্যে রয়েছে? বাজার কি এই শেয়ারগুলোর প্রতি যৌক্তিক আচরণ করছে? এটা কি প্রমাণ করে না, আমাদের শেয়ারবাজার এখনো সেই ম্যাচিউর্ড জায়গায় পৌঁছায়নি। কোনো যৌক্তিক নিয়ম মেনে আমাদের শেয়ারবাজারের গতি নির্ধারিত হয় না। এ বাজারে বাস্তবতা নেই, আছে অকারণে প্রত্যাশার প্রসারণ। বাজার যখন কোনো একদিকে মোড় নেয়, তখন সবাই সেই দিকেই ছুটতে থাকে। এটাকে বলে হার্ড মেন্টালিটি। অনেক বেশিসংখ্যক বিনিয়োগকারী কারসাজির প্ররোচনায় নির্দিষ্ট বা কমসংখ্যক কিছু শেয়ারের পেছনে যুক্তিহীনভাবে ছোটে। চিন্তা-চেতনার কোনো বালাই নেই। সবাই এখানে স্বপ্নে পৌষ দেখে, কিন্তু দিগন্তে অপেক্ষমান সর্বনাশের কথা কেউ ভাবেন না। প্রখ্যাত দার্শনিক সান্তানার বিখ্যাত একটি উক্তি: ‘যারা অতীত মনে করতে পারে না, দ-নীয়ভাবে তারা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে’। সেই পথ ধরেই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বারবার একই পরিণতি। সুযোগসন্ধানী চক্রের কলকাঠি নাড়ানোই শেয়ারবাজারের ইতিহাস। এখানে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কোনো বিনিয়োগ নেই। আবার কেউ করলেও বিনিয়োগসুরক্ষা নেই, সুশাসন নেই। অব্যবস্থাপনার শেষ নেই। কবির ভাষায়: ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে’।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মোহনপুর উপজেলা বিএনপি দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে সভাপতি মুন সাধারণ সম্পাদক মাহবুব বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না:সালাম
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
নির্বাচনে কারা যোগ্য, সে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি: বদিউল আলম মজুমদার
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
রেমিট্যান্সে সুবাতাস: ডিসেম্বরের ২১ দিনেই এলো ২০০ কোটি ডলার
প্রশাসন ক্যাডারের ‘ইয়াং অফিসার্স’ ফোরামের সভাপতি শুভ, সাধারণ সম্পাদক জয়
ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও কেওক্রাডং বাংলাদেশ’র উদ্যোগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হলো ‘কোস্টাল ক্লিনআপ’
তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী রাহাত ফাতেহ আলী খানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ছাত্র জনতার বিজয়কে নস্যাৎ হতে দেয়া যাবে না
বিপিএল মিউজিক ফেস্ট: যান চলাচলে যে নির্দেশনা ডিএমপির
গাজীপুরের শ্রীপুরে মেঘনা গ্রুপের একটি বাটন তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
সোনারগাঁওয়ে ছেলের ছুরিকাঘাতে বাবা নিহত
আনজার গ্রুপের আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠকদের সংবর্ধনা
মির্জাপুরে রাস্তায় বাঁশের বেড়া দেয়ায় জনদুর্ভোগ এলাকাবাসির মানববন্ধন