বিশ্বনেতা ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর পরীক্ষা
২৪ জুন ২০২৩, ০৮:১৯ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম
মানুষকে আল্লাহ পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আ.)। তিনি পৃথিবীর প্রথম খলীফা ও নবী। তিনিই পৃথিবীর প্রথম নির্মাতা ও সংগঠক। তার মাধ্যমেই মানব বংশের ধারা শুরু হয়েছে। তিনি হচ্ছেন মানবজাতির আদি পিতা। আদি পিতা আদম (আ.)’র দুই পুত্রÑ হাবিল এবং কাবিল আল্লাহর নির্দেশে কুরবানি করেছিলেন। এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম কোরবানি। তাদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে কোরবানির গোড়াপত্তন ঘটে। আদম (আ.) থেকে ঈসা (আ.) পর্যন্ত সকল নবীর উম্মত হাবিল-কাবিলের অনুসরণে কোরবানি করতেন। কিন্তু আমরা যে কোরবানি করি এর ধারা শুরু হয়েছে ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) থেকে। বর্তমান মুসলিম বিশ্ব এ ধারাকে অনুসরণ করেই কোরবানি সম্পন্ন করে থাকে। আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগের কথা। ইরাকের বাবেল শহরে জন্মেছিলেন ইব্রাহীম (আ.)। তাঁর পিতার নাম ছিল আযর, তিনি ছিলেন একজন মূর্তি পূজারী। পেশায় একজন মূর্তি ব্যবসায়ী। আযর নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করতেন এবং বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। নিজ বাসায় শিরক দেখে ইব্রাহীম (আ.) বিচলিত হয়ে উঠলেন। নিজ ঘর থেকেই শুরু করলেন দা’ওয়াহ কার্যক্রম। তিনি মূর্তি পূজার অসারতা প্রমাণপূর্বক আল্লাহর ইবাদতের যুক্তি উপস্থাপন করলেন। কিন্তু বাবা তার আহ্বান প্রত্যাখ্যানপূর্বক তাকে হত্যার ঘোষণা দিলেন। অতঃপর ইব্রাহীম (আ.) পিতাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি নিজ বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি গোটা বাবেলবাসীকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাতে লাগলেন। তাদেরকেও তিনি মূর্তি ও নক্ষত্র পূজার আসারতা ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু কেউই তার দাওয়াতে সাড়া দিলো না। তখন গোটা ইরাকের বাদশা ছিল নমরুদ। নমরুদ ছিল একজন অত্যাচারী বাদশাহ। সে নিজেকে খোদা দাবি করতো। আবার মূর্তি বানিয়ে তার পূজা করতো। ইব্রাহীমের দাওয়াতের খবর বাদশা নমরুদের রাজ দরবারে পৌঁছে গেলো। বাদশাহ ইব্রাহীমকে ডাকলো। তার সব কথা শুনলো। রাজপ্রাসাদে রাজকর্মচারীদের সামনে ইব্রাহীমের যুক্তিতর্কের কাছে নমরুদ হেরে গেলো। সে অপমানে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো। সে ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করলো। অতঃপর তাঁকে শাস্তির মুখোমুখি করলো। ইব্রাহীম (আ.) কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখী হলেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইবরাহীম (আ.) ২০০ বছর জীবিত ছিলেন। আর তাঁর জীবন মানেই পরীক্ষার জীবন। নবী হবার পর থেকে আমৃত্যু তিনি পরীক্ষা দিয়েই জীবনপাত করেছেন। পরীক্ষার পর পরীক্ষা দিয়ে পূর্ণত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তিনি উন্নীত হয়েছেন। পরীক্ষায় উন্নীত হবার কারণেই ইসলাম তাঁকে ‘বিশ্বনেতা’ ঘোষণা করেছে। আল্লাহ বলেন: ‘যখন ইব্রাহীমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হ’লেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানাবো। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার যালেমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না’ (বাক্বারাহ: ১২৪)। বস্তÍুত আল্লাহ ইব্রাহীম ও তাঁর বংশধরগণের মধ্যেই বিশ্ব নেতৃত্ব সীমিত রেখেছেন। ইব্রাহীম (আ.)-এর পরবর্তী সকল নবীই তাঁর বংশধর ছিলেন। আলে ইমরান বলতে ইমরান-পুত্র মুসা, হারূন ও তাদের বংশধর দাঊদ, সুলায়মান, ঈসা প্রমুখ নবীগণকে বুঝানো হয়েছে। যাঁরা সবাই ছিলেন ইব্রাহীমের পুত্র ইসহাকের বংশধর। অপরপক্ষে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহম্মদ (সা.) ছিলেন ইব্রাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাইলের বংশধর। সে হিসেবে আল্লাহ ঘোষিত ইব্রাহীমের বিশ্বনেতৃত্ব আজ অবধি বহাল রয়েছে।
ইব্রাহীম (আ.)’র পরীক্ষাসমূহ ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। (এক) বাবেল জীবনের পরীক্ষাসমূহ এবং (দুই) কেন‘আন জীবনের পরীক্ষাসমূহ। ইব্রাহীম (আ.)-এর বাবেল জীবনের পরীক্ষাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: (১) মূর্তিপূজারী নেতাদের সাথে তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা, (২) পিতার পক্ষ থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রাপ্তির পরীক্ষা, (৩) তীব্র সামাজিক বিরোধিতার মুখে একাকী দাওয়াত চালিয়ে যাওয়ার পরীক্ষা, (৪) তারকাপূজারীদের সাথে যুক্তিগর্ভ তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা, (৫) কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাঙ্গার মতো দুঃসাহসিক পরীক্ষা, (৬) অবশেষে রাজদরবারে পৌঁছে সরাসরি সম্রাটের সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার পরীক্ষা এবং (৭) জ্বলন্ত আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার মর্মান্তিক শাস্তি হাসিমুখে বরণ করে নেবার অতুলনীয় অগ্নি পরীক্ষা। উপরে বর্ণিত পরীক্ষাগুলির সবটিতেই ইব্রাহীম (আ.) জয়লাভ করেছিলেন।
তাঁর কেন‘আনী জীবনের প্রধান পরীক্ষাসমূহ হলো: (১) দুর্ভিক্ষের কারণে মিসরে হিজরত: এটা ছিল কেন‘আনী জীবনের প্রথম পরীক্ষা। বাবেলে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় জীবিকার তাগিদে তিনি মিসরে হিজরত করেন। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এ হিজরত ছিল তার জন্য খুবই কঠিন। (২) স্ত্রী সারাকে অপহরণ। মিসরে উপস্থিত হলে সেখানকার লম্পট রাজা ফেরাউন তাঁর স্ত্রী সারাকে অপহরণ করে। এটা ছিল তার জীবনের এক বিভীষিকাময় পরীক্ষা। (৩) স্ত্রী হাজেরাকে মক্কায় নির্বাসন। মিসর থেকে ইব্রাহীম (আ.) নিজ দেশ কেন‘আনে পৌঁছান। এখানে বছরখানেক সময় অতিবাহিত হবার পর তাঁর প্রথম সন্তান ইসমাইল (আ.) এর জন্ম হয়। উল্লেখ্য, ৮৬ বছর বয়স অতিক্রম করলেও ইব্রাহীম (আ.)’র তখনও কোনো সন্তানাদি ছিল না। এটা ছিল তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আর এক বড়ো পরীক্ষা। তিনি আল্লাহর কাছে সন্তানের পিতা হতে আবেদন করলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আবেদনে সাড়া দিলেন। ইব্রাহীমের ছিল দুই স্ত্রীÑ হাজেরা এবং সারা। বিবি হাজেরার গর্ভে ইসমাইলের আগমন ঘটলো। ইব্রাহীম (আ.) যারপরনাই খুশি হলেন। অতঃপর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি স্ত্রী ও সন্তানকে নির্বাসনে পাঠাতে আদিষ্ট হন। তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে কিছু খেজুর ও এক মশক পানিসহ স্ত্রী ও শিশুকে মক্কার নির্জন মরুভূমিতে রেখে যান। তাদেরকে রেখে যখন ইব্রাহীম (আ.) একাকী ফিরছিলেন, স্ত্রী হাজেরা তখন বিস্মিত বদনে স্বামীর পিছু পিছু আসলেন। বললেন, এভাবে তাদেরকে কার কাছে এবং কেন রেখে যাওয়া হচ্ছে? বুকে বেদনার পাষাণ বাঁধা ইব্রাহীমের মুখ যেন তালাবদ্ধ ছিল। তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। স্ত্রী নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি আল্লাহর হুকুম? ইব্রাহীম (আ.) মাথা নাড়িয়ে হাঁ সূচক ইঙ্গিত দিলেন। তাৎক্ষণিক হাজেরা মনোবল ফিরে পেয়ে বললেন, ‘তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ অতঃপর তিনি শিশু বাচ্চার কাছে ফিরে এলেন। তিনি ভাবলেন, কাল বা পরশু খেজুর ও পানি ফুরিয়ে যাবে। খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে বুকের দুধ শুকিয়ে যাবে। তখন শিশু কী খাবে? তিনি সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় পাগলপরা হয়ে দিগি¦দিক ছুটতে থাকলেন। তিনি খাদ্য ও পানীয়ের সন্ধানে দৌড়াতে থাকেন। তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত ছুটাছুটি করেন। এভাবে এ পাহাড়দ্বয়ে তিনি সাতবার দৌড়ান। সপ্তমবারে তিনি পাহাড় থেকে দেখেন, শিশু ইসমাইলের পায়ের কাছে মরুভূমির বুক চিরে ঝর্না ধারা বেরিয়ে আসছে। তিনি পাহাড় থেকে ছুটে এলেন। বাচ্চাকে কোলে নিলেন। পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, ‘আপনারা ভয় পাবেন না। এ শিশু ও তার পিতা এ ঘর নির্মাণ করবেন। আল্লাহ তার ঘরের বাসিন্দাদের ধ্বংস করবেন না।’ এ কথা বলেই শব্দটি মিলিয়ে গেলো। এরপর থেকে শুরু হলো ইসমাইল (আ.) এর অধ্যায়। পানি হলো সকল জীবের বেঁচে থাকার অন্যতম সেরা উপাদান। মরুভূমিতে পানি দেখে সেখানে পাখির আনাগোনা বেড়ে গেলো। পাখির উড়া দেখে সেখানে ব্যবসায়ী কাফেলার আগমন ঘটলো। তারা হাজেরার কাছে পানি ব্যবহারের অনুমতি চাইলো। হাজেরা তাদেরকে বসতি স্থাপনের শর্তে পানি ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। কোনো বিনিময় ছাড়া বসবাসের শর্ত তাদের কাছে বিস্ময়কর মনে হলো। তারা এ শর্ত সাগ্রহে কবুল করলো। এ কাফেলা হলো ইয়ামন থেকে আগত বনু জুরহুম গোত্র। এ গোত্রই পরবর্তীতে বায়তুল্লাহর খাদেম নিযুক্ত হয়েছিলো। ইসমাইল (আ.) বড়ো হয়ে এ গোত্রে বিয়ে করেন। এ বংশেরই এক শাখা গোত্র হলো কুরাইশ বংশ। শেষ নবী মুহম্মদ (সা.) এ বংশেই জন্মগ্রহণ করেন।
উল্লেখিত ঘটনার প্রেক্ষিত বিবেচনায় বলা যায়, ইব্রাহীম (আ.) কর্তৃক তাঁর স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে মরুভূমিতে রেখে আসা কোনো সুস্থ বিবেকবান লোকের কাজ হতে পারে না। এটি একটি অমানবিক আশ্চার্য ব্যাপারই বটে। তবে এখানে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রকৃত মালিকের নির্দেশ মান্য করা, প্রকৃত গোলামের জন্য কোনো আশ্চার্যজনক ব্যাপারই নয়। হাজেরার কণ্ঠেই সে প্রত্যয়ধ্বনির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, ‘তাহলে আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করবেন না।’ আর প্রকৃত গোলাম যখনই তার প্রকৃত মালিকের হুকুম পালন করলো, ঠিক তখনই তার জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা হয়ে গেলো, যা পৃথিবীর ইতিহাসে যমযম কূপ নামে পরিচিত, যার উৎসধারা আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত সমভাবে বহমান। এর স্বাদ, গন্ধ, রূপ, রস-কোনোটিতেই কোনো ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়নি। ইব্রাহীম (আ.) দোয়া করেছিলেন: ‘হে আমাদের রব! আমি আমার পরিবারের কয়েকজনকে তোমার মর্যাদায় সিক্ত ঘরের নিকট অনুর্বর উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। হে প্রভু! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং তুমি কিছু মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও! আর তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা খাদ্যের ব্যবস্থা করো। তারা সম্ভবত কৃতজ্ঞ হবে’ (ইব্রাহীম-৩৭)। আল্লাহ তা‘আলা তার প্রিয় বান্দার এ দোয়া এমনভাবে কবুল করেছেন যে, আধুনিক বিশে^র যেকোনো শহরের চেয়ে পবিত্র মক্কায় সবসময় ফল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য ব্যাপকহারে মজুদ থাকে। আর তারই দোয়ায় এখানে সালাত ও বিভিন্ন ইবাদত বছরের বারো মাস ধরেই চালু থাকে। আর তারই দোয়ার অংশ হিসেবে বিশে^র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে সে শহরের দিকে আকৃষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আর সে অংশটি হলো মুসলমান।
(৪) চতুর্থ পরীক্ষা হলো, ইব্রাহীমকে ৮০ বছর বয়সে খাৎনা করতে নির্দেশ। নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়াই নিজের খাৎনা নিজেই সম্পন্ন করেছিলেন। (বুখারী: হাদীস নং ৩৩৫৬) প্রকৃত বান্দাই কেবল বিনা দ্বিধায় এ জাতীয় কঠিন বেদনাদায়ক কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। আধুনিক মুসলিম বিশে^ ধর্মীয় সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে আজও এটি চালু রয়েছে। বস্তÍুত এ খাৎনার মধ্যে মানুষের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এটিকে অজানা অনেক রোগের প্রতিষেধক বলে মন্তব্য করেছেন। (৫) ইসমাইলকে কুরবানির নির্দেশ: শিশুপুত্র ইসমাঈলকে মক্কার উপত্যকায় রেখে এলেও ইব্রাহীম (আ.) তাদেরকে দেখাশুনা করতেন। মাঝে মধ্যে তিনি তাদেরকে সান্নিধ্য দিতেন। ইতোমধ্যে পুত্রের বয়স ১৩/১৪ বছরে উপনীত হলো। বলা যায় যে, পিতা তখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়েছেন আর ছেলে তখন সহযোগী হয়ে পিতৃহদয়ে পুরোপুরি জুড়ে বসেছেন। এমন সময়ে আল্লাহ হৃদয় জোড়ানো এ পিতৃ¯েœহকে কুরবানির নির্দেশ করলেন। ইতিপূর্বে অগ্নিতে নিক্ষেপের পরীক্ষা দেওয়ার সময় ইব্রাহীমের ন্যূনতম পিছু টান ছিল না। কিন্তু এবারের নির্দেশে রয়েছে রক্তের টান। দ্বিতীয়ত অগ্নি পরীক্ষা ছিল বাদশাহ কর্তৃক নির্দেশিত, যা দিতে ইব্রাহীম (আ.) বাধ্য ছিলেন। কিন্তু এবারের পরীক্ষা স্বেচ্ছায় ও স্বহস্তে সম্পন্ন করতে হবে। সুতরাং আগের সকল পরীক্ষার চেয়ে এ পরীক্ষাটি ছিল সবচেয়ে কঠিন। আল্লাহ বলেন: ‘যখন পুত্র পিতার সাথে চলাফেরা করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহীম তাকে বললেন, হে আমার ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি। এখন তোমার অভিমত কী? ইসমাইল বললেন: হে পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ করা হয়েছে, আপনি তা কার্যকর করুন! আল্লাহ যদি চান অবশ্যই আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের কাতারে দেখতে পাবেন’ (ছাফফাত-১০২)।
ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত যে, ইব্রাহীম (আ.) যখন ইসমাইলকে নিয়ে মক্কা থেকে ৮ কি.মি. দূরে মিনা নামক স্থানে পৌঁছান, তখন ইবলিস তাকে তিনবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। প্রত্যেকবারই ইব্রাহীম (আ.) শয়তানের প্রতি ৭টি করে পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন। বর্তমানে হাজীগণ ঐ তিন স্থানে তিনবার ৭টি করে পাথর নিক্ষেপ করে থাকেন। মূলত ইব্রাহীমের এ ম্মৃতিকে জাগরুক রাখতে এবং শয়তানের প্ররোচণার বিরুদ্ধে মুমিনকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করতেই এ পাথর নিক্ষেপকে ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাথর নিক্ষেপের পর ইব্রাহীম (আ.) ইসমাইলকে নিয়ে কুরবানির স্থান মিনাতে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি আবারো তার স্বপ্নের কথা ছেলেকে শুনালেন এবং অভিমত জানতে চাইলেন। পুত্র তার হাঁ সূচক অভিমত পেশ করে বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাবেন’। এখানে শিক্ষনীয় হলো, ইসমাইল ইনশাআল্লাহ না বললে হয়তো ধৈর্য ধারণের তৌফিক পেতেন না। এরপর তিনি নিজেকে ছবরকারী না বলে ‘ছবরকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ বলেছেন। এখানে এ বাক্যের মাধ্যমে নিজেকে নিজের পিতা ও পূর্বেকার বড়ো বড়ো উৎসর্গকারীদের মধ্যে নিজেকে শামিল করে নিজেকে অহংকারমুক্ত করেছেন। আল্লাহ বলেন: ‘অতঃপর পিতা-পুত্র উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করলো এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে শুয়ায়ে দিল। তখন আমরা তাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘হে ইব্রাহীম তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো। আমরা এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটি একটি সুস্পষ্ঠ পরীক্ষা। আর আমরা তার পরিবর্তে একটি মহান যবেহ প্রদান করলাম এবং আমরা এ বিষয়টি পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম। ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক’ (ছাফফাত-১০৩-১০৯)। ইতিহাসের গতিধারায় আজও বিশে^র লাখ লাখ হাজি এ মিনাতেই কোরবানি সম্পন্ন করে থাকেন।
এখানে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, ইব্রাহীমকে আল্লাহ স্বপ্নাদেশ করেছিলেন, সরাসরি আদেশ করেননি। তিনি স্বপ্ন না দেখিয়ে সরাসরি তাকে নির্দেশ করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেন নি। কারণ, নির্দেশ করলে নির্দেশটি সাথে সাথে পালন হয়ে যেতো। সেখানে পরীক্ষার কিছুই থাকতো না। আর পরীক্ষা দিতে গিয়ে ইব্রাহীম পরীক্ষার ময়দানে শয়তানের ফাঁদ দেখতে পেয়েছিলেন। স্বপ্নের কাল্পনিক ব্যাখ্যার ফাঁদে ফেলতে শয়তান মাঝপথে বন্ধু সেজে তাকে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে পারেনি। এর দ্বারা আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনে অহেতুক প্রশ্ন ও যুক্তিবাদের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। বরং সর্বদা তার প্রকাশ্য অর্থের উপরে সহজ-সরলভাবে আমল করে যেতে হবে। সবশেষে বলা যায়, যেকোনো নেতৃত্বে পরীক্ষা অনিবার্য। পরীক্ষা ব্যতীত যে নেতৃত্ব সেটি কোনো নেতৃত্ব নয়; সেটি অন্তসারশূন্য ও সারবস্তুহীন এক বৃহৎ আয়োজন, যার সবকিছুই অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। বিশ^দরবারে যার সকল আয়োজন গুরুত্বহীন। আর ইসলামী নেতৃত্বে¡ পরীক্ষার বিষয়টি ঐতিহাসিক সত্য, যা ইব্রাহীম (আ.) ও অন্যান্য সকল নবীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল।
লেখক: অধ্যাপক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman&gmail.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মোহনপুর উপজেলা বিএনপি দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলে সভাপতি মুন সাধারণ সম্পাদক মাহবুব বিএনপি নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় আসতে চায় না:সালাম
ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স শূন্য যে ১০ ব্যাংকে
নরসিংদীর শিবপুরে প্লাস্টিক কারখানা আগুনে পুড়ে ছাই
দিনাজপুর জেলা শিক্ষা অফিসারের বিদায়ী সংবর্ধনা
ব্র্যাক ব্যাংকের রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন
হাসিনা পরিবারের নামে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে
আমার খাবার কি ফর্টিফায়েড?
এনার্জিপ্যাকের বার্ষিক সাধারণ সভায় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ
নির্বাচনে কারা যোগ্য, সে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি: বদিউল আলম মজুমদার
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
রেমিট্যান্সে সুবাতাস: ডিসেম্বরের ২১ দিনেই এলো ২০০ কোটি ডলার
প্রশাসন ক্যাডারের ‘ইয়াং অফিসার্স’ ফোরামের সভাপতি শুভ, সাধারণ সম্পাদক জয়
ইউনিলিভার বাংলাদেশ ও কেওক্রাডং বাংলাদেশ’র উদ্যোগে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে হলো ‘কোস্টাল ক্লিনআপ’
তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে পাকিস্তানের বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী রাহাত ফাতেহ আলী খানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ছাত্র জনতার বিজয়কে নস্যাৎ হতে দেয়া যাবে না
বিপিএল মিউজিক ফেস্ট: যান চলাচলে যে নির্দেশনা ডিএমপির
গাজীপুরের শ্রীপুরে মেঘনা গ্রুপের একটি বাটন তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
সোনারগাঁওয়ে ছেলের ছুরিকাঘাতে বাবা নিহত
আনজার গ্রুপের আয়োজনে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠকদের সংবর্ধনা
মির্জাপুরে রাস্তায় বাঁশের বেড়া দেয়ায় জনদুর্ভোগ এলাকাবাসির মানববন্ধন