মাদকে সমূহ বিপর্যয়
২৫ জুন ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম | আপডেট: ২৬ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম
মাদকের নেশা কেবল আত্মঘাতী নয়, সমাজ, দেশ, মনুষ্যত্ব সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী ডেকে আনছে বিপর্যয়। ব্যক্তিজীবনে যেমন মাদক স্বাস্থ্য, সম্পদ, মানসম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি নষ্ট করে ব্যক্তিকে করে তোলে সমাজের ঘৃণা ও নিন্দার একশেষ, তেমনি সমাজজীবনেও আনে অস্বাস্থ্য, অলসতা, অকর্মণ্যতা এবং সামাজিক অপরাধের সীমাহীন নিষ্ঠুরতা। ধ্বংস হয়ে যায় মাদকসেবীর রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, সামাজিক মূল্যবোধের মতো অমূল্য গুণগুলো। আজকের পৃথিবীতে এই ব্যাধি পরিব্যাপ্ত দেশ থেকে দেশান্তরে। নেশার উপর ভর করে একদল নেশার ব্যবসায়ী আজ মানুষ কর্তৃক মানুষ মারার নেশায় বুঁদ হয়ে ধ্বংস করতে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বজনীন মূল্যবোধ, প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-ভক্তি রসধারাকে সীমাহীন আত্মঘাতী নিষ্ঠুরতায়। নেশায় নেশায় বুঁদ এসব নেশার কারবারিরা আজ নেশার বাণিজ্য সম্ভারে মেতে বিশ্বকে করে তুলেছে সন্ত্রস্ত। তাই ড্রাগ কেবল ব্যক্তিজীবন নয়, সমাজ, সমষ্টি এবং বিশ্বজীবনেও ডেকে আনছে বিপর্যয়।
বিশ্বের প্রায় সবক’টি মহাদেশেই অবৈধ মাদক উৎপাদিত হয় কিংবা ব্যবহৃত হয়, যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশও এই বিষয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশে আফিম ও ভাং এর প্রচলন সুপ্রাচীন। বিগত তিন দশকে হেরোইন, এম্ফিটামিন, কোকেন এবং নানা ভেষজ ওষুধ রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে প্রবেশ করেছে, যা অবৈধ মাদকের ভয়াবহতাকে আরও উসকে দিয়েছে। এক সময় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল অর্থাৎ মায়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড কিংবা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অর্থাৎ আফগানিস্তান, ইরান ও পাকিস্তান থেকে অবৈধ ড্রাগ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে শুধু পাচার হতো। কিন্তু আজ এই চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইয়াবা নামক নেশা দ্রব্য আজ সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সৃষ্ট করছে নানা বিপর্যয়।
এক বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৬৫ লক্ষ নেশাসক্তদের মধ্যে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের সংখ্যাই বেশি। ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যাটি ক্রমশ শহরতলি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের ড্রাগ ও অপরাধ নিবারক সংস্থা যৌথভাবে অবৈধ মাদক সেবন সংক্রান্ত বিষয় পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন পেশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোরদের মধ্যে অ্যালকোহল ২১.৪ শতাংশ, ভাং ৩ শতাংশ, আফিম ০.৭ শতাংশ এবং অন্যান্য অবৈধ ড্রাগ ৩.৬ শতাংশ সেবনের প্রবণতা দেখা গেছে। অবৈধ মাদক সেবনের এই প্রবণতা সারা দেশে এক রকম নয়। যেমন উত্তরবঙ্গে যা বেশি চলে দক্ষিণে কম আবার পূর্বে যা বেশি পশ্চিমে তা কম। তবে ফেনসিডিলের ব্যবহার দেশের সর্বত্রই বিদ্যমান।
বাংলাদেশে নেশা করার এক ধরনের ওষুধ ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। এগুলো ব্যথা কমানোর ওষুধ। কোডেইন দিয়ে তৈরি কফ সিরাপ, ঘুমের ওষুধ, কিছু অ্যান্টিহিস্টামিনিক এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। নেশা করার একটি ভয়াবহ মাধ্যম হচ্ছে ইঞ্জেকশন। সম্প্রতি একটি রিপোর্টে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে হেরোইন, বুপ্রেনরফিন এবং প্রোপক্সিফেন এর মিশ্রণ ইঞ্জেকশন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তা ছাড়া, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রোক্সিভন নামক ওষুধও ইঞ্জেকশন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একটি ইঞ্জেকশনের বহু ব্যবহারের ফলে নেশাসক্তদের মধ্যে এইচআইভি-এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রচন্ড বেড়ে যায়। বর্তমানে ইয়াবার প্রচলন জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সূত্র হতে জানা যায়, ইদানিং যুবতীরাও মাদকাসক্ত হয়ে বিপথে পরিচালিত হচ্ছে।
নেশায় আসক্ত হওয়ার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। কিন্তু কারণ যাই হোক না-কেন, নেশা সমাজের প্রধান পাঁচটি অংশকে অর্থনৈতিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই অংশগুলো হচ্ছে স্বাস্থ্য, উৎপাদন, অপরাধ, নিরাপত্তা এবং সরকারি কার্যপ্রণালী। প্রথমেই আলোচনা করা যাক স্বাস্থ্য সম্পর্কে।
নেশা মানুষের স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত করে তোলে। মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবন রোগীর মানসিক অবসাদ ঘটায় এবং হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভি-এইডস ও যক্ষ্মার মতো ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই নেশাবিরোধী অভিযান, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচিতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং ঘন ঘন রোগে আক্রান্ত হওয়া কিংবা মারা যাওয়া উভয় ক্ষেত্রেই দেশের প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, নেশাবিরোধী অভিযান সরকারি অর্থের সুরক্ষা করতে পারে।
নেশাগ্রস্ত লোক যে শুধু নিজের ক্ষতি করে এমন নয়, পারিপার্শ্বিক মানুষের নিরাপত্তাও সঙ্কটাপূর্ণ করে তোলে। নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালালে পথ দুর্ঘটনায় চালকের যেমন ক্ষতি হয় পথযাত্রীদের সমান খেসারত দিতে হয়। গবেষণায় জানা গেছে, ভাং খেয়ে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা ৯.৫ গুণ এবং কোকেন ও ব্যাঞ্জোডায়াজিপাইনের ক্ষেত্রে ২ থেকে ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়। এম্ফিটামিন ড্রাগে এই আশঙ্কা ৫ থেকে ৩০ গুণ এবং মদের সঙ্গে অন্য ড্রাগ মিশিয়ে খেলে ২০ থেকে ২০০ গুণ বৃদ্ধি পায়।
আফিম ও ভাংয়ের অবৈধ চাষের ফলে ব্যাপকভাবে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে এর জলজ্যান্ত উদাহরণ বলিভিয়া, কলম্বিয়া ও পেরু। এই অবৈধ চাষ একদিকে বনভূমি ধ্বংস করছে অন্যদিকে চাষযোগ্য জমির পরিমাণও কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই অবৈধ চাষ জমি ও পারিপার্শিক পানিকে দূষিত করে বন্যপ্রাণী ও মানুষের জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে।
মাদকের সঙ্গে অপরাধের যোগসূত্র রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ সেবনেই অপরাধ সংঘটিত হয়। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডোমানিকা সেন্ট কিটস ও নেভিস এবং সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রিনাডিন এর ৫৫ শতাংশ অপরাধীরা অপরাধের সময় নেশাগ্রস্ত ছিলেন। টাকার উন্মাদনা অপরাধ সংঘটিত হয়। টাকার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় ড্রাগের জোগান আসে। আমেরিকার ১৭ শতাংশ কয়েদি শুধুমাত্র টাকার জন্য অপরাধ সংঘটিত করেছে। ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্রতারণা এবং ডাকাতিতে প্রত্যেক বছর ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাণিজ্যের এলাকা নির্ধারণ অথবা কেনাবেচার সময় সৃষ্ট সমস্যার সুরাহা করতে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত হয়। লাতিন আমেরিকায় বিশেষ করে গুয়াতেমালা ও মেক্সিকোতে এই ঘটনা খুবই সাধারণ। আগের এক রিপোর্টে জানা যায়, অষ্ট্রেলিয়ার ড্রাগ সংক্রান্ত অপরাধের জন্য বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আমেরিকাতে এর মূল্য প্রায় ৬১ বিলিয়ন ডলার। অন্য এক রিপোর্ট মতে, উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কর্মীগণ মাদকাসক্ত হলে অথবা চিকিৎসাধীন হলে উৎপাদন ক্ষমতা যথেষ্ট হ্রাস পায়। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালে আমেরিকায় মাদকাসক্ত শ্রমিকদের কাজে যোগদান না-করার ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ জিডিপির ০.৯ শতাংশ যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঠিক তেমনি অষ্ট্রেলিয়া ও কানাডাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে জিডিপির ০.৩ শতাংশ ও ০.৪ শতাংশ। চিকিৎসাধীন হলে কিংবা জেলে থাকলে শ্রমিক বা কর্মচারীরা কাজে যোগদান করতে পারে না। ফলে দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ে।
আন্তর্জাতিক নারকোটিক্স কন্ট্রোল বোর্ডের ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, অবৈধ ড্রাগ পাচারকারীরা সরকারের দুর্বল প্রশাসনিক স্তরে আঘাত করে তাদের এই অবৈধ বাণিজ্য বেপরোয়াভাবে চালায়। ফলে স্থানীয় মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। ড্রাগ পাচারকারীরা অর্থনৈতিক দুর্নীতির মাধ্যমে প্রশাসনকে পঙ্গু করে তোলে এবং তাদের অবাধ বাণিজ্য চালায়। সুষ্ঠুভাবে বাঁচার স্বার্থে আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটা সুস্থ, সুন্দর পৃথিবী গড়ার প্রত্যাশায় বিশ্ব বরণ্য গায়ক মাইকেল জ্যাকসনের সুরে আমরাও বলি, ঐধরষ ঃযব ড়িৎষফ ধহফ সধশব রঃ নবঃঃবৎ ঢ়ষধপব ঃড় ষরাব রহ. অর্থাৎ রিক্ত¯্রী পৃথিবীতে শুভ বুদ্ধির জয় হোক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মির্জাপুরে রাস্তায় বাঁশের বেড়া দেয়ায় জনদুভোগ এলাকাবাসির মানববন্ধন
মেধা বৃত্তির ফলাফল ঘোষণা করলো উষা
পাহাড় কাটা, বায়ুদূষণ ও নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা
ফুলপুরে অবৈধ ইট ভাটায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এক লাখ টাকা জরিমানা
মিরপুরে বেড়েছে চুরি ছিনতাই
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন
পালিয়ে গিয়ে হাসিনা ভারত থেকে ষড়যন্ত্র করছে: মির্জা ফখরুল
মাগুরায় দলকে গতিশীল করতে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত
মৌলভীবাজারে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে শ্রমিকের মৃত্যু, জিরো লাইন থেকে লাশ উদ্ধার
মাদারীপুরে ভুয়া সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্র জনতা
সেনবাগে ট্রাক্টর চাপায় ১ শিশু মৃত্যু : আহত ১
আ.লীগের নিবন্ধন বাতিলসহ ৩ দফা দাবিতে ৭ দিনের আল্টিমেটাম ইনকিলাব মঞ্চের
ঢাকা ফাইট নাইট ৪.০-এ জয়ী মোহাম্মদ ‘রয়্যাল বেঙ্গল’ ফাহাদ
শহীদ আবু সাঈদকে কটূক্তি, ক্ষমা চাইলেন কিশোরগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিছ আলী ভূঁইয়া
মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের বার্ষিক কমিটি গঠন
টাঙ্গাইলে কাকুয়ায় সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর পক্ষ থেকে সুবিধা বঞ্চিত গরীব অসহায়দের শীতবস্ত্র বিতরণ
নোয়াখালীকে বিভাগ ঘোষণার দাবিতে মানববন্ধন
রাজশাহীর আদালতে আ:লীগের সাবেক এমপি আসাদের রিমান্ড মঞ্জুর
বগুড়ায় পুলিশের উদাসীনতায় রাতের আঁধারে জবর দখল করে ছাদ ঢালাই
লাকসামে সরকারি খাল পাড়ের মাটি বিক্রি হচ্ছে ইটভাটায়