ঢাকা   শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৫ আশ্বিন ১৪৩১

রিকনসিলিয়েশন ও রাষ্ট্র মেরামতের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য জরুরি

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২৭ জুন ২০২৩, ০৮:১১ পিএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩, ১১:৪৩ পিএম

আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র অনেকটা অকেজো হয়ে পড়লেও এখনো তা মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়েনি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করে জনগণের মেন্ডেটহীন রাজৗৈনতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র অনেকটা উচ্ছন্নে যাওয়ার পর তা এখন টালমাটাল হয়ে পড়েছে। গত ১৪ বছর, কিংবা ১৬ বছর, ৫২ বছর অথবা ২৫০ বছরের দু:শাসনের আত্মভোলা, আত্মঘাতী জাতি ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন এখনো ভুলে যায়নি। এটাই এ জাতির সম্ভাবনার মোক্ষম ভিত্তি। এ জাতি মানে, বাঙ্গালী মুসলমান জাতি। বাঙ্গালী মুসলমানের আলাদা আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক উন্মেষ ইতিপূর্বে আর কখনো ইতিহাসের পাতায় উদ্ভাসিত হয়নি। প্রশাসনিক -বাণিজ্যিক সুবিধা ও শতবছরের বৈষম্যের কারণে পিছিয়ে পড়া পূর্ববাংলার মুসলমানদের দিকে কিছুটা দৃষ্টি ফেরাতে ১৯০৫ সালে বৃটিশ রাজের ফরমানে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের বিরুদ্ধে কলকাতা কেন্দ্রিক বাঙ্গালী হিন্দুদের বিরোধিতার পিছনে ছিল তাদের জমিদারি ও কায়েমী স্বার্থ রক্ষার দূরভিসন্ধি। সেই দূরভিসন্ধিকে একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভাবাবেগের মুখোশ পরিয়ে ওরা ‘বঙ্গমায়ের অঙ্গচ্ছেদ’ বেদনায় মায়াকান্না করে তুমুল জনমত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই বৃটিশদের বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করেছিল। বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন না হলে এই বাংলা হয়তো নানাদিক থেকে আরো অর্ধশতাব্দী এগিয়ে থাকতো। বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি পূরণে বৃটিশদের প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধেও কলিকাতার হিন্দু জমিদার ও বুদ্ধিজীবীরা একাট্টা হয়ে প্রতিবাদ করেছিল। রবীন্দ্রনাথের মত বিশ্ববরেণ্য কবিও বঙ্গভঙ্গ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। অভিজাত বাঙ্গালী হিন্দু জমিদার, পেশাজীবী ও রাজনীতিকদের এমন ভূমিকার মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙ্গালী মুসলমানের বঞ্চনার খতিয়ান, স্বাতন্ত্র্য ও ভিন্ন আত্মপরিচয়ের নতুন তাৎপর্য। তিরিশের দশকে বৃটিশদের ভারত স্বাধীনতা আইনের গণতান্ত্রিক ধারাক্রমের সূত্র ধরে দুই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠি হিসেবে কলিকাতার নেতৃত্ব বাঙ্গালী মুসলমানদের হাতে বর্তায়। পশ্চিমা ধাচের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে কলকাতার মেয়র কিংবা শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মুসলমানদের আধিপত্যে ভিরমি খেয়ে বাবু বুদ্ধিজীবীরা আগের অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে ভারত ভাগের আগে বাংলা ভাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সাতচল্লিশের দেশভাগের আগে তারা বলেছিলেন, আর কিছু ভাগ হোক বা না হোক, বাংলা ভাগ হতেই হবে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির আনুকূল্যে দুইশ’ বছরে বাঙ্গালী হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষা, বিত্ত-বৈভব ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে এগিয়ে থাকলেও অখ- বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দ্বারা শাসিত না হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় বাংলা ভাগতে অনিবার্য করে তুলেছিল। যদিও সাতসমুদ্র পেরিয়ে আসা বেনিয়া বৃটিশদের দ্বারা শাসিত হতে তারা অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। সিন্ধু, পাঞ্জাব, কাশ্মির- বেলুচিস্তান কিংবা সীমান্ত প্রদেশের অগ্রসর ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র চাওয়ার পেছনে একই রকমের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিদ্যমান থাকলেও বাংলার পরিস্থিতি অভিন্ন ছিলনা। কলকাতার হিন্দু বর্ণবাদী নেতারাই বাংলাভাগের মূল কারিগর। ভাগ-বন্টনের মধ্য দিয়ে অখন্ড বৃটিশ-ভারতে অন্তত ৭টি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর বহু বছর পেরিয়ে এসে ভারতের বর্ণবাদী শাসকরা এখন আড়াই হাজার বছর আগের মৌর্য যুগের অখন্ড ভারতের স্বপ্নে বিভোর হয়েছে।

ইঙ্গ-মার্কিনী অক্ষ পশ্চিমা প্রতিবেশীদের সাথে নিয়ে তাদের হারানো উপনিবেশের উপর আধিপত্য বজায় রাখার কৃতকৌশল চর্চা করে চলেছে। চীনারা তাদের প্রাচীন সিল্করুটের গতিপথে নতুন রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের কৌশলগত বাণিজ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চলেছে। সেখানে ভারতের তেমন কোনো রোডম্যাপ না থাকলেও বৌদ্ধ ধর্মের মৌর্য শাসক কিংবা মুসলমান মুঘল শাসকদের অনুরূপ একটি অখ- হিন্দুত্ববাদী ভারতের বর্তমান শাসকরা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক দূরভিসন্ধি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তাদের এই ভূমিকা বিশ্বের কাছে এখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হরণের মধ্য দিয়ে একটি জাতিগত নির্মূল কার্যক্রমের এজেন্ডা হিসেবে বড় ধরণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণহত্যা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জোনোসাইড ওয়াচের প্রধান নির্বাহী, প্রফেসর গ্রেগরী স্ট্যান্টন গত কয়েক বছরে একাধিকবার ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন। তার এই আশঙ্কা প্রকাশের পরও ভারতের শাসকদের মধ্যে মুসলমানদের রক্ষায় সদিচ্ছার প্রতিফলন না দেখে তিনি পুনরায় নিজের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। গত সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ও মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেসের অর্ধশতাধিক সদস্য ভারতে মুসলমানদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে যৌথ পত্র পাঠিয়েছিলেন। মোদির সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জো বাইডেন তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর ইউনিপোলার বিশ্বে মার্ক্সবাদী সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থলে এখন কমিউনিস্ট চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউনিপোলার পুঁজিবাদী বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে মুদ্রা বা মার্কিন ডলার। বিরুদ্ধ মতের রাষ্ট্র ও সরকারকে শায়েস্তা করতে ডলারের রির্জাভসহ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাকে ক্রমাগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে করতে দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন আর মুদ্রা হিসেবে ডলারের উপর ভরসা করতে পারছে না। চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিক্স জোটে ভারতের যোগদান এবং ডলারের বিপরীতে একটি অভিন্ন মুদ্রা চালুর উদ্যোগে ভারতের অংশীদারিত্ব ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর যুগে দেশটির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সম্পর্কের সম্ভাবনাকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। বহুমতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের অঙ্গিকার নিয়ে ঔপনিবেশোত্তর স্বাধীন ভারত জনসংখ্যার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের সামনে যে ইমেজ গড়ে উঠেছিল, হিন্দুত্ববাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ভারতের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এখন পশ্চিমা বিশ্বে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতীয় মুসলমানরা বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠি। হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের নাগরিক অধিকার অস্বীকারের নানাবিধ আইনগত ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গ্রেগরি স্ট্যান্টন গণহত্যার যে ১০টি ধারাবাহিক পূর্বলক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন, তার সবগুলোই ভারতে বিদ্যমান রয়েছে। মোদি সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ভারতে মুসলমান-খৃষ্টানসহ অহিন্দু জনগোষ্ঠির উপর নিবর্তনের শুরু থেকে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও তথাকথিত গোরক্ষকদের হাতে শত শত মুসলমান নিহত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাব ওবামা গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুসলমানদের উপর দমন-পীড়ন ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য বন্ধ না হলে ভারত খন্ড-বিখন্ড হয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

চীন-রাশিয়া গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করে না। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান শুধুমাত্র নিজেদের নিরাপত্তা ও পুঁজিবাদী স্বার্থের মুখাপেক্ষি হয়ে উঠেছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নে যেন তাদের কোনো দায় নেই। রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট কিংবা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তাদের নিরবতা ও পৃষ্ঠপোষকতা বিষ্ময়কর। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, গত দুই অর্থবছরে চীন ও ভারতের নাগরিকরা বাংলাদেশে চাকরি করে ৩৪ হাজার কোটি টাকার সমপরিমান বৈদেশিক মুদ্রা নিজ দেশে পাঠিয়েছে। প্রকাশ্য হিসাবে চীনাদের রেমিটেন্স আয়ের হার বেশি হলেও বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভারতীয় কর্মী অবৈধভাবে অবস্থান করায় ভারতীয়দের পাঠানো রেমিটেন্সের বেশিরভাগই হিসাবের বাইরে। অন্যদিকে, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্রসহ রাশিয়ার সাথে শত শত কোটি ডলারের চুক্তিতে অসমতা অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থনৈতিক স্বার্থের বেড়াজাল এসব দেশকে রিজিমের সব অপকর্মের নিরব পৃষ্ঠপোষকে পরিনত করলেও রোহিঙ্গা সংকটের মত আঞ্চলিক সমস্যা নিরসনে তারা কার্যত বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। দেশের লাখ লাখ তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্বের হতাশায় বিপথগামি হচ্ছে অথবা বিপদসঙ্কুল পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। রফতানিমুখী গার্মেন্ট সেক্টরে মোটা বেতনের চাকরির বড় অংশই বিদেশিদের দখলে থাকার প্রধান কারণ, আমাদের তরুণদের বিদেশি ভাষায় কমিউনিকেশন স্কিলে ঘাটতি, দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, চাকরিতে নিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতার অভাব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অধ:পতনের ধারাক্রম সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিতাড়নের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে। বিসিএস ও ডক্টরেট ডিগ্রীধারি আমলা, সিইও ও বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের দুর্নীতি, ঘুষবাণিজ্য ও জালিয়াতির খেসারত দিচ্ছে পুরো জাতি। দেশটাকে অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হয়েছে। দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে দেশকে দেউলিয়া করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকাকে কঠিনতর ও দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন। শুধু সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হলেই এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। সমস্যা শেকড়ে ও নিগড়ে হাত দিতে হবে। এ সমস্যার ভিত্তি ও বিস্তৃতি অনেক গভীর ও প্রাচীন। এর সাথে রয়েছে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির নিবিড় যোগসূত্র। সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশের উপর দেশের মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং মানুষের ত্যাগ ও আকাঙ্খাকে মূল্য দিতে না পারার কারনে আমাদের রাষ্ট্র দেউলিয়াত্বও ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় পতিত হতে শুরু করেছে।

দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাধারণ আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনীয়তায় রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে। প্রধান বিরোধিদল বিএনপি সেই আকাক্সক্ষার অনুবর্তি হয়ে ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত বা সংস্কারের প্রয়োজনে ২৭ দফা রূপরেখা প্রকাশ করেছে। এসব দফায় গত দেড় দশক কিংবা কয়েক দশকে প্রকট হয়ে ওঠা রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ব্যবস্থার ঘুণে ধরা পরিকাঠামোতে পরিবর্তনের প্রলেপ দেয়ার কথা বলা হলেও অধ:পতনের পঙ্কিল পথের দিকে নজর দেয়ার কোনো ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশনের যে প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে অব্যক্ত ও প্রত্যাশিত অনেক কিছুই পুরণ করা সম্ভব হতে পারে। আমাদেরকে জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষা সংস্কার ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ধারাক্রমকে জাতির সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার উদ্যোগ নিতে হবে। মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বাদ দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ ও শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের গতিপথ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। হাজার বছর মুসলমান শাসনের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভারত সা¤্রাজ্যের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল। কোনো কুপমন্ডুক সাম্প্রদায়িক শক্তির পক্ষে এমন সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বৃটিশরা হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি সৃষ্টি করে তা কাজে লাগিয়ে ভারত শাসন ও সম্পদ পাচার করেছিল। পলাশি যুদ্ধে ট্রাজিক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এ দেশে বৃটিশ ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় শত বছর পর ১৮৩৫ সালে ২রা ফেব্রুয়ারি বৃটিশ ভারতের শিক্ষা ও প্রশাসনিক সংস্কারের প্রশ্নে বৃটিশ পার্লামেন্টে দেয়া বক্তৃতায় লর্ড মেকলে বলেছিলেন, “আই হ্যাভ ট্রাভেল্ড অ্যাক্রস দ্য লেংথ অ্যান্ড ব্রিদ অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড আই হ্যাভ নট সিন ওয়ান হু ইজ অ্যা বেগার, হু ইজ অ্যা থিফ, সাচ ওয়েল্থ আই হ্যাভ সিন ইন দিস কান্ট্রি। সাচ হাই মোরাল ভ্যালুজ, সাচ হাই ক্যালিবার, দ্যাট আই ডু নট থিঙ্ক উই উড এভার কনকোয়ার দিস কান্ট্রি, আনলেস উই ব্রেক দ্য ভেরি ব্যাকবোন অব দিস ন্যাশন, হুইচ ইজ হ্যার স্পিরিচুয়াল অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ অ্যান্ড দেয়ারফর...।” এই প্রেক্ষাপটে লর্ড মেকলে ভারতের হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ও প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতির স্থলে বৃটিশদের প্রবর্তিত ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রবর্তনের প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতীয়রা যখন বুঝবে ইংরেজী ভাষাসহ সবকিছু তাদের থেকে উত্তম তখন তাদের আত্মমর্যাদায় চিড় ধরবে, এভাবেই আমরা যেভাবে প্রত্যাশা করি, ভারতীয়দের সেভাবে (ট্রুলি ডমিনেটেড নেশন) পরিচালিত করা সম্ভব হবে। ইংরেজের সেই ফাঁদটি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হিন্দু-মুসলমানের মেলবন্ধন ও প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বদলে এ দেশের নতুন প্রজন্মকে বস্তুবাদী অর্জনের প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়া। এখন আমরা সেই প্রতিযোগিতার সর্বশেষ ও নিকৃষ্টতম ধাপে অবস্থান করছি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্তরণ ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গৌরবময় ধর্মীয় ঐতিহ্য ও নৈতিক-আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ও টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হতে পারে। আধিপত্যবাদী শক্তির সুবিধাভোগী ও তল্পিবাহকরা কখনোই তা সফল হতে দিতে চাইবে না।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

ইয়ামালের মাইলফলকের রাতে হারের তেতো স্বাদ বার্সার

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

আর্সেনালের স্বস্তির ড্র,অ্যাটলেটিকোর দারুণ জয়

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

হেডের বিধংসী শতকে লন্ডভন্ড  ইংল্যান্ড

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

পয়েন্ট হারিয়েও শীর্ষে আর্জেন্টিনা,অবনতি বাংলাদেশের

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

বিদেশে সাবেক ভুমিমন্ত্রীর আট হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

ইউনূস গুড উইলের প্রতিফলন দেখতে চায় জনগণ: রিজভী

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

সময় থাকতে হাসিনাকে ফেরত পাঠান : ভারতকে দুদু

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

রুশ সেনা কুরস্কের দুটি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

বিমানবন্দর এলাকা হবে শব্দদূষণ মুক্ত

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ৭ দিনের রিমান্ডে

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

বিচার শুরু হলে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে : আইন উপদেষ্টা

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

লোহাগড়ায় দিনে-দুপুরে বসতবাড়ি পুড়ে ছাই

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

রাষ্ট্রীয় কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিন আলেমদেরকে

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

দুই মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ওপর হামলার ঘটনায় বিএমটিএর নিন্দা

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

জিএম কাদের ও মজিবুল হক চুন্নুকে অবিলম্বে আটক করতে হবে : আবু হানিফ

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী  প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশের নীতিমালা অনুমোদন

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল-এমপি হেনরিসহ ৩ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে একবছর ,সাধারন সম্পাদককে দুই বছর একাডেমীক কার্যক্রম থেকে বহিস্কারসহ উভয়কে হোস্টেল থেকে আজীবন বহিস্কার।

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ঢাবিতে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ৫ শিক্ষার্থী গ্রেফতার

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল

রাজউক চেয়ারম্যানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল