শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন পীড়নের কারণ দূর করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যা করেছে। অবন্তিকা কেন এ পথ বেছে নিয়েছে, ফেসবুকে পোস্ট করা সুইসাইড নোটে তার বিবরণ রয়েছে। সে লিখেছে : ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই তবে আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী, আর তার সহকারী হিসাবে তার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন-অনলাইনে থ্রেটের ওপর রাখতো, সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেও আমার লাভ হয়নি। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানাভাবে ভয় দেখায় আম্মানের হয়ে যে, আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার।’ তার এ বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, সহপাঠীর দ্বারা যৌনহয়রানি ও হুমকি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যথাযথ কর্তৃপক্ষের তরফে প্রতিকার না পাওয়াই তার এভাবে জীবন দেয়ার কারণ। কতটা বিব্রত, কতটা অতিষ্ঠ, কতটা নিরূপায় হলে তার মতো একজন মেধাবী ছাত্রীকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়, সেটা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হওয়া আমাদের দেশে মোটেই কোনো নতুন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিককালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকের বিরুদ্ধে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যেখানে পিতা ও সন্তানতুল্য সেখানে শিক্ষকের দ্বারা ছাত্রীর যৌন পীড়নের শিকার হওয়া কতটা অপমানজনক, কতটা হীন ও ধিক্কারযোগ্য কাজ বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরুষ সহপাঠীর দ্বারা যৌন নির্যাতন ও হুমকি-ধমকির কবলে পড়ার ঘটনা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অনেকেরই হয়তো স্মরণ আছে, এক সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের ধর্ষণের সেঞ্চুরি করার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক গবেষণা মতে, গত এক বছরে সারাদেশে অন্তত: ১৪২ জন ছাত্রী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেলেল্লাপনা অনৈতিক আচার-আচরণ, যৌনতার প্ররোচনাদায়ী কার্যকলাপ, লাজ-শরম ও শালীনতার বালাই থাকা ইত্যাদির পেছনে তথাকথিত প্রগতিবাদীদের ভূমিকা যেমন আছে, তেমনি আছে নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয় পাঠ্যসূচি থেকে বর্জন করা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্বলিত যেসব বিষয় অতীতে পাঠ্যসূচিভুক্ত ছিল, পর্যায়ক্রমে তা তুলে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে সেটা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ, অভিভাবকদের ক্ষোভের কোনো শেষ নেই। এখন শিশু-কিশোর শিক্ষার্র্থীদের মধ্যে বিদ্যাশিক্ষা, শিল্পসাহিত্যের চর্চা ও খেলাধুলার প্রতি অনুরাগের বদলে গ্যাং কালচারের নেশা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। তথাকথিত এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা খুন, সন্ত্রাস, লুটপাট, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক সেবন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি ইত্যাদি এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করছে না। দুঃখের বিষয়, কিশোর গ্যাংগুলো প্রায় সর্বত্রই লালিত-পালিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণীর নেতাকর্মীর দ্বারা। অবশ্য আমরা সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখি মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে। মাদরাসায় পড়ে সাধারণত দরিদ্র ও কম আর্থিক সঙ্গতি আছে, এমন পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তাদের অনেক কষ্টেসৃষ্টে চলতে হয়। সেটাই তারা মেনে নেয়। তারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হয় না। তাদের দ্বারা ছিনতাই, রাহাজানি হয় না। চুরি-ডাকাতি করে না। অনৈতিক কাজ ও মাদকের ধারে কাছে যায় না। তাদের এই চরিত্র-বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে এই কারণে যে, মাদরাসা শিক্ষা নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তির ওপর দণ্ডায়মান। ১০-১২ বছর বয়সে সাধারণত চরিত্র গঠনের বুনিয়াদী ভিত গঠিত হয়। এ সময় মাদরাসায় অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুসরণ, হালাল-হারামের শিক্ষা দেয়া হয়। তিক্ত হলেও বলতে হচ্ছে, মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, বিকাশ এবং তার যথাযথ মূল্যায়নের প্রতি সরকারেরর মনোযোগ নেই বললেই চলে। এবতেদায়ী মাদরাসা এখনো চরমভাবে অবহেলিত। তদুপরি মাদরাসা শিক্ষা পাল্টে দেয়ার চক্রান্তও জোরেসোরে চলছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই শিশুদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। গত ১৭ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি শিশুদের সততা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শিক্ষা এবং সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মাদক ও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে শিক্ষা দেয়ায় আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বর্তমানে জঙ্গীবাদের অস্তিত্ব দেশে নেই। জঙ্গীবাদের চর্চার দিন শেষ। তবে সন্ত্রাস আছে, মাদকের আসক্তি ও কারবার আছে, আছে দুর্নীতির উৎসব। এসবের জন্য ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের দায় কখনো বাতিল করে দেয়া যাবে না। সরকারকে এসব অপরাধ দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর শিশুদের সুনাগরিক, নৈতিক ও সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অভিভাবক ও শিক্ষকদের সমান ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার পুনঃস্থাপন যেমন করতে হবে, তেমনি পরিবারে আগের মতো ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানে জোর দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের যে অবাধ চর্চা এখন চলছে, তার জন্য শিক্ষকদের দায় অনেক বেশি। কাজেই যারা শিক্ষক, তাদের নৈতিক মানে, মেধায়, আচরণে উন্নত হতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, শিক্ষকদের সবদিক দিয়ে মানাবনতির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের নিয়োগ প্রদান। এমন অবস্থা আগে ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে চরিত্র, মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতাকেই প্রাধান্য দেয়া হতো- রাজনীতি, মোটেই নয়। সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ সমুন্নত করতে এর বিকল্প নেই।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গাজীপুরের দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

গাজীপুরের দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে

এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে

৭ মাসে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০ জন ছাড়িয়েছে

৭ মাসে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০ জন ছাড়িয়েছে

হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের চারজনের পটুয়াখালীতে দাফন সম্পন্ন

হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের চারজনের পটুয়াখালীতে দাফন সম্পন্ন

আচমকাই খাদে পড়ল যাত্রীবাহী বাস, পাকিস্তানে নিহত ২০

আচমকাই খাদে পড়ল যাত্রীবাহী বাস, পাকিস্তানে নিহত ২০

বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি ছাত্রী

বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি ছাত্রী

ভারতকে ‘অপমান’ বাইডেনের, যা বলল হোয়াইট হাউজ

ভারতকে ‘অপমান’ বাইডেনের, যা বলল হোয়াইট হাউজ

নিয়মভঙ্গের অভিযোগে আদানির ৬ সংস্থাকে শোকজ নোটিস

নিয়মভঙ্গের অভিযোগে আদানির ৬ সংস্থাকে শোকজ নোটিস

কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের

কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের

পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির

পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির

গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ

গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ

দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া

দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া

শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন

শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন

লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান

লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান

গাজীপুরে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষঃ চালকসহ আহত ৪

গাজীপুরে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষঃ চালকসহ আহত ৪

পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল

পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল

মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক

মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক

উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা

উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা

বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য

বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য