বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষক-নিপীড়কদের বল্গাহীন আধিপত্য রুখতে হবে
২০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৪, ১২:০৪ এএম
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়াবহ মানবিক সংকটের সম্মুখীন। এটি যতটা না অর্থনৈতিক, তার চেয়েও জটিল সংকট চলছে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক স্তরে। আর এই সংকট রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ থেকে শুরু হলেও এর সুতিকাগার হচ্ছে, রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাঙ্গণ। কোনো জাতিকে ভেতর থেকে দুর্বল, ভঙ্গুর ও পঙ্গু করে দিতে হলে প্রথমেই এর শিক্ষা ও সাংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে কক্ষচ্যুত করার পুরনো হেজিমনিক এজেন্ডা থেকে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো কখনোই বিরত থাকেনি। দেশের রাজনীতি ও শাসনক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণ ও সঠিক প্রতিনিধিত্ব যদি ভিন্ন কোনো আঞ্চলিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই শক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়কে নিজেদের মত নিয়ন্ত্রিত করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমেই সে অংশের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নীলনকশা আরোপ করে থাকে। আমাদের আজকের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একটি মিশ্র আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ স্পষ্টভাবে ধরা পড়লেও প্রতিবেশী ভারতের উপর ক্ষমতাসীনদের নির্ভরতা এবং বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কর্মসংস্থানের উপর ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন এখন অতি সাধারণ একজন মানুষও উপলব্ধি করতে পারছে। নিয়ন্ত্রিত ও কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সবকিছু গণমাধ্যমে সঠিকভাবে তুলে আনার সুযোগ খুব সীমিত হলেও এখনকার তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়নের সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে ওঠা সিটিজেন জার্নালিজম ও গণযোগাযোগের বহুমাত্রিক ব্যবস্থায় কোনোকিছুই আর অপ্রকাশিত থাকছে না। এক বা একাধিক আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক পরাশক্তি যখন দেশের মানুষের প্রত্যাশা, প্রয়োজনীয়তা ও আকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করে একটি অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্বাদী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বৃত্তায়নকে সমর্থন দিয়ে চলেছে, তখন দেশের মানুষ সবচেয়ে কাছের প্রভাবশালী রাষ্ট্রের হেজিমনির বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক দিয়েছে। যদিও মুক্তবাজার অর্থনীতির পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশের পক্ষে পরিপূর্ণ স্বয়ংসম্পুর্ণ সম্ভব নয়। এ কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ তেমন কোনো কাজে আসেনি। এরচেয়ে অনেক দুর্বল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে ইরানও চারদশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমা অবরোধ-নিষেধাজ্ঞার প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। পরনির্ভরতা কাটিয়ে কোনো দেশের আত্মনির্ভর, স্বয়ম্ভর হয়ে উঠতে বিদেশি নিষেধাজ্ঞা ও বয়কট বড় ধরনের প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী বিশ্বে এটা বিভিন্ন দেশে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকার্থিজমের খড়গ না ঘটলে চীনের শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিপ্লব এবং আজকের অগ্রগতি সম্ভব হতো কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। দেড়যুগ ধরে জলসীমা, স্থলপথ এবং আকাশপথে সর্বাত্মক অবরুদ্ধ থাকার পরও গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক সমর্থনপুষ্ট জায়নবাদী ইসরাইলী বাহিনীর সামরিক-নৈতিক পরাজয় বিশ্বের জন্য অনেক বড় বার্তা বহন করছে। স্থলযুদ্ধে হেরে গিয়ে বেপরোয়া বোমা হামলা চালিয়ে গাজার নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষকে গণহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ঘৃণ্য তৎপরতা তাদের নৈতিক পরাজয়ের কুৎসিত চেহারাকেই বিশ্বের কাছে উন্মোচিত করছে।
প্রথম মহাযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের পতন নিশ্চিত হওয়ার পর, রাশিয়ায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের হাত ধরে ইউরোপে মিশ্র এক রাজনৈতিক বাস্তবতার উদ্ভব ঘটে। একদিকে হিটলার-মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদী শক্তির বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক শক্তি অন্যদিকে জায়নবাদী পুঁজিবাদের নেপথ্য প্রভাবিত ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যদিয়ে তাদের জন্য সে পথ আরো অর্গলমুক্ত হয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও সমাজবাস্তবতার ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে গবেষণা ও উত্তরণের পথ নির্মাণ করতে গিয়ে জার্মান দাশর্নিক কার্লমার্ক্স, ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনিবার্য সংঘাতকে তাদের রাষ্ট্রদর্শনে তুলে ধরেছিলেন। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভøাদিমির ইলিচ লেনিন বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তবতাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন। কিন্তু মানুষের প্রয়োজন এবং কল্যাণে শ্রম এবং পুঁজিই শেষ কথা নয়। হাজার বছর ধরে মানুষ এক পরম মানবিক-আধ্যাত্মিক বোধকে লালন ও অনুসরণ করে চলেছে। সেসব বিষয়কে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র পুঁজি ও বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণার অনুসরণে পরিচালিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সাত দশকের বেশি টেকসই হয়নি। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সাথে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয়ে বিংশ শতকের শেষ দশকে পদার্পণের আগেই তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছিল। পশ্চিমা বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ না করলেও সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদকে গ্রহণ ও আত্মস্থ করার মাধ্যমে কমিউনিষ্ট গণচীন এক সময় বিশ্বের অন্যতম পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। সম্পদ পুঞ্জিভবনের প্রতিযোগিতায় যেন জায়নবাদী কুশীলবদের মতই বেপেরোয়া ও অন্ধ। বাংলাদেশ-মিয়ানমারসহ উপমহাদেশের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা, চীন-ভারতে মুসলমানদের উপর সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন, রোহিঙ্গা গণহত্যার মত ঘটনাগুলোর সাথে চীন-ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির প্রতিযোগিতা এবং এক ধরনের অঘোষিত বোঝাপড়া লক্ষ করা যায়। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ, বাংলাদেশে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের আকাক্সক্ষাকে অগ্রাহ্য করে ভোটারবিহীন, জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন একেকটি ভুয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অব্যাহতভাবে ভারত ও চীনের সমর্থন সেই অঘোষিত সমঝোতাকেই নির্দেশ করে। একইভাবে বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়ে পশ্চিমাদের গলাবাজি শুধু বাহ্যিক তর্জন-গর্জনেই সীমাবদ্ধ, আমাদের নাগরিক স্বার্থের প্রশ্নে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা শুধু কৌশলগতভাবে রাষ্ট্রশক্তিকে নিজের অক্ষে টেনে রাখতেই সবকিছু করছে। জনগণের সমর্থন, স্বার্থ ও নিরাপত্তা আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর কাছে খুবই গৌণ বিষয়। রাজনীতির মাঠের ক্রীড়নক কিংবা ভোটের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদলের হাতিয়ার হওয়া ছাড়াও যে কোনো রাষ্ট্রে ভোক্তা হিসেবে সাধারণ মানুষের এক অসামান্য ক্ষমতা রয়েছে। পণ্য, সেবা ও ভ্রমণ বর্জন-বয়কটের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ অনেক বড় অসাধ্যও সাধন করতে পারে। জায়নবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বিডিএস (বয়কট, ডাইভেস্ট, স্যাংশন) আন্দোলনের মাধ্যমে ইসরাইলের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল কার্যকর বলে প্রমানিত হয়েছে। ভারতে বিজেপি নেতাদের ইসলাম বিদ্বেষী ভূমিকার বিরুদ্ধে ২০২২ সালে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ভারতীয় পণ্য বর্জণের ডাক যথেষ্ট কার্যকর বলে প্রমানিত হয়েছিল। বাংলাদেশের উপর পানি আগ্রাসন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, শিক্ষা-সংস্কৃতি, একতরফা বাণিজ্য ও মূল্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নেটিজেনরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক থাকলেও শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে এটি এ দেশের মানুষের একটি স্বতস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই গণ্য হতে পারে।
এ দেশের সাধারণ মানুষ মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সবচেয়ে অহিংস ও নিরাপদ ভাষা হিসেবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। এটি মূলত শুরু করেছিল ভারতীয়রাই। গত বছর ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের হেরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট দর্শকদের ভারতের পরাজয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশি তরুণদের এমন প্রতিক্রিয়াকে ভারতীয়রা অকৃতজ্ঞতা ও ভারত বিদ্বেষ হিসেবে অভিহিত করে তারাও পাল্টা বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পর্যটনের জন্য, চিকিৎসার জন্য কিংবা কেনাকাটা করার জন্য ভারতে যায়। বাংলাদেশি ক্রেতা-ভোক্তা এবং রোগীদের টার্গেট করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ চেন্নাইসহ বিভিন্ন স্থানে হোটেল-রেস্তোঁরা, হাসপাতাল ও মার্কেট গড়ে উঠেছে। সেখানে কোনো কোনো হোটেল বাংলাদেশিদের জন্য বুকিং নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশিদের ভারতে যাওয়া তিনভাগের একভাগে নেমে যায়। এসব হোটেল-রেস্তোঁরা ও হাসপাতালের চেম্বারগুলোর বিরাণ হয়ে ব্যবসায় লালবাত্তি জ্বলতে শুরু করলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলাদেশ বিদ্বেষী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পুলিশি কার্যক্রম শুরু করে। ভারতে বাংলাদেশবিরোধী প্রপাগান্ডা কমলেও দিল্লীর বিজেপি সরকারের বাংলাদেশ ও মুসলিম বিদ্বেষী তৎপরতা এবং গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার প্রশ্নে পশ্চিমাদের নানাবিধ উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিয়ে আরেকটি একতরফা ভোটারহীন নির্বাচনকে বৈধতা দিতে ভারতের কুপ্রভাব বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। যদিও জনগণের সাথে রাষ্ট্রীয় নীতির সমর্থন না থাকলে এ ধরণের আন্দোলন খুব বড় প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনা। হঠাৎ করে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে এখানে আরেকদফা মূল্যস্ফীতি ঘটানোর পর ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিলেও বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারত ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ রফতানি করছে। ভারত ছাড়া বিকল্প দেশ থেকে সরকার পেঁয়াজ আমদানি করলে তা জনসমর্থন লাভ করতে পারতো। ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধের পর বাংলাদেশের কৃষক ও খামারিরা গরুর গোশত উৎপাদনে দেশকে অনেকটা সমৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পুর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সিন্ডিকেটেড মুনাফাবাজির অপতৎপরতা বন্ধ করতে পারলে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত তুলে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি না করলেও বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়না। পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদনে কোনো ঘাটতি নেই। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। বাম্পার ফলনের পরও ধানের ভরা মওসুমে ভারত থেকে চাল আমদানির সুযোগ দিয়ে কৃষককে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে মধ্যস্বত্তভোগীদের মুনাফার সুযোগ করে দিতে কৃষকদের লোকসানি দামে ধান বেচতে বাধ্য করে মূলত দেশের কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা করা হচ্ছে। অন্যান্য সব পণ্যে একই ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের বাজারের উপর ভারতীয় আধিপত্য অটুট রাখা। কিছু কিছু পণ্যে দেশের চাহিদা, উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণের ভার পরোক্ষভাবে প্রতিবেশীর উপর ছেড়ে দেয়ার এক অদ্ভুত সাপলুডু খেলা দেখা যাচ্ছে। শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেই নয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রতিটি ধাপেই ভারতীয় আধিপত্যবাদের থাবা সবকিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে।
আজ থেকে শত বছর আগে ১৯২২-২৩ সালে ইতালিতে মুসোলিনীর জেলখানায় বসে লিখে লিখে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রদার্শনিক এন্টোনিও গ্রামসি যে, নোটবুকগুলো ভরিয়ে তুলেছিলেন, তা আজো রাজনৈতিক দর্শনের অনেক বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গ্রামসির কালচারাল হেজিমনি তত্ত্বের বাস্তব রূপায়ন ঘটেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস হলে কার লাভ? বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হলে লাভ কার? এখানে গণতন্ত্র ধ্বংস করে বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে কারা লাভবান হয় তা নিয়ে নতুন করে গবেষণার দরকার নেই। আমাদের পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের উৎপাদন ও রফতানিমুখী শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরী করতে পারলে, দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকারকে কর্মহীন রেখে ভারতীয় কর্মী নিয়োগ দিয়ে দেশ থেকে শত শত কোটি ডলার ভারতে পাঠানোর কোনো সুযোগ থাকতো না। দেশের রাজনীতি ও সামাজিক সংস্কৃতি থেকে বহুত্ববাদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিতাড়িত করে একটি ফ্যাসিবাদী চরিত্র আরোপ করা হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষাঙ্গণ থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে জনমনে অসন্তোষ ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যাণয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। স্বদেশি আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে নব্বইয়ের গণতন্ত্র আন্দোলন পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। গণতন্ত্রের পক্ষে দেশের সব রাজনৈতিক পক্ষের ঐকমত্যের যে প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছিল তা ভেঙ্গে দিয়ে জাতিকে রাজনৈতিক এন্টাগনিজমের মধ্যে ঠেলে দিয়ে দেশকে একটি অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও মুক্তচিন্তার বিকাশ নিশ্চিত করার কথা। সেখানে এখন আর জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক আন্দোলন হয় না। ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেয়ার উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার পরিবেশকে পরিকল্পিতভাবে নস্যাৎ করা হয়েছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তচিন্তা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতি মূল্যবোধের উপর নিষেধাজ্ঞা ও বিরোধী মতের মেধাবি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের আখড়ায় পরিনত হয়েছে। ফেইসবুকে ভারতের পানিচুক্তির সমালোচনা করায় বুয়েটের মেধাবি শিক্ষার্থী আবরার ফয়সালকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি হলে শতাধিক টর্চার সেল থাকার তথ্য গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। নব্বই দশকে আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর দেশের সবচেয়ে মনোরম-সুশৃঙ্খল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জসিমউদ্দিন মানিক নামের এক ছাত্রলীগ নেতা নারী ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব পালনের ঘৃণ্য ইতিহাস সৃষ্টির পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপেষকতায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্ষক-নিপীড়কদের দুর্ভেদ্য আখড়ায় পরিনত হয়েছে। অসংখ্য শিক্ষার্থী নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে। ধর্ষণ ও যৌণ নিপীড়নের শিকার হয়ে মেধাবী ছাত্রীরা নির্বাক-স্থবির হয়ে কক্ষচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে অথবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে আটকে রেখে এক নারীকে ছাত্রলীগ নেতাদের গণধর্ষণ কান্ড, ঠিক একই কায়দায় জাহাঙ্গির নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে আটকে রেখে নারীকে ধর্ষণ করে সংবাদ শিনোনাম হয়েছে এক ছাত্রলীগ নেতা। যৌণ নিপীড়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও ছাত্র নেতারা একাকার হয়ে পড়েছে। জাবি পাবলিক হেল্থ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। জনির মত শিক্ষকরাই নাকি ভিসির চেয়ারে কে বসবে তা নির্ধারণ করেন! কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেত্রিদের দ্বারা শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা, গত সপ্তায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া ফাইরুজ অবন্তিকা কিংবা জবি শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রতিবাদে বিচারের দাবিতে রাস্তায় একা প্লাকার্ড হাতে দাড়ানো শিক্ষার্থীর বিচার না পাওয়ার ঘটনা আমাদের উচ্চশিক্ষাঙ্গণের বর্তমান অবস্থার বাস্তব চিত্র। দেশ ও জাতি যখন এক চরম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত, তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে উত্তরণের পথ দেখানোর ঐতিহাসিক ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়ে আত্মরক্ষা, আত্মহত্যা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রনেতাদের যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে ক্ষণস্থায়ী আন্দোলন করার মধ্যেই তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- সীমাবদ্ধ। আমাদের প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা পথ হারিয়েছে। একে আবার নিরাপদে জনগণের স্বপ্নের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষাঙ্গণ থেকেই শুরু করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে
৭ মাসে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০ জন ছাড়িয়েছে
হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের চারজনের পটুয়াখালীতে দাফন সম্পন্ন
আচমকাই খাদে পড়ল যাত্রীবাহী বাস, পাকিস্তানে নিহত ২০
বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি ছাত্রী
ভারতকে ‘অপমান’ বাইডেনের, যা বলল হোয়াইট হাউজ
নিয়মভঙ্গের অভিযোগে আদানির ৬ সংস্থাকে শোকজ নোটিস
কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের
পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির
গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ
দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া
শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন
লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান
গাজীপুরে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষঃ চালকসহ আহত ৪
পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল
মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক
উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা
বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য
নাইজারে মার্কিন ঘাঁটিতে অবস্থান নিল রুশ সেনা