সাদি মহম্মদের বিদায় ও কিছু প্রশ্ন
২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৩ এএম
কারো স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মহত্যা নিয়ে আমি কিছু লিখিনি। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহত্যা নিয়ে এখন লিখতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি আমার খুব প্রিয় শিল্পী ছিলেন। প্রিয় শিল্পীর অসম্মানে এখন আমি না লিখে পারছি না।
গণমাধ্যম এবং সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাদি মহম্মদ স্বেচ্ছামৃত্যু বা আত্মহত্যা বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে এখন যারা রাষ্ট্রীয় পদক পাচ্ছেন, তাদের বিবেচনায় সাদি মহম্মদের অনেক আগেই একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক পাওয়া উচিত ছিল। তাতে আমারও কোনো সন্দেহ নেই। তাকে অবহেলা করার তীব্র নিন্দা আমিও করছি। কিন্তু তাই বলে তিনি পুরস্কার না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন, একথা মানতে আমি সম্পূর্ণ নারাজ। এই বয়ান যারা দিচ্ছেন তারা সাদি মহাম্মদকে কতটা সম্মানিত করছেন? তাকে একুশে পদক দেয়া হয়নি বলে তার লাশ শহীদ মিনারে নেয়া হলো না, এই ধরনের বয়ান তাকে কি আদৌ সম্মানিত করে? আমি মনে করি, কোনো পুরস্কার কখনো না পেলেও, এমনকি মরণোত্তর পুরস্কার না পেলেও সাদি মহম্মদ বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে যে স্থান করে নিয়েছেন তাতে অনেক পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীর চেয়ে তিনি বহুদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় থাকবেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার থাকে তার শ্রোতা ও ভক্তদের স্বীকৃতি। রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক পুরস্কার কেবল গুণের বিচারে দেয়া হয় না, এর পেছনে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক তথা বিভিন্ন স্বার্থ জড়িত থাকে। তাই শিল্পীরা সব সময় ভক্ত-শ্রোতাদের অন্তরে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে চান। সে কারণেই অনেক বিখ্যাত সৃজনশীল মানুষকে নামি দামি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে দেখা যায়। সেখানে সাদি মহম্মদের মতো একজন শিল্পী পুরস্কার না পেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করবেন, এ ধরনের বয়ান কখনোই তাকে সম্মানিত করে না।
আরো একটি বিষয় বলতে চাই, টেলিভিশনের নিউজ দেখলাম, সাদি মহম্মদের লাশের বিদায় জানাতে উপস্থিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা তার লাশ সামনে রেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন। কোনো মুসলিম যখন মারা যান তখন আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীরা তাকে চির বিদায় জানাতে জানাজা করতে হাজির হন। তারা সবাই পবিত্র কুরআনের সূরা ও বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পড়ে মৃত ব্যক্তির রুহের মাগফেরাত ও জান্নাত কামনা করেন। এটাই স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু সাদি মহাম্মদের বিদায়ে উপস্থিত শিল্পীরা তার লাশের সামনে গাইলেন, ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই, কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই, তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে, যত দূরে আমি ধাই।’ রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচনা করেছিলেন ১৯০১ সালে। এটি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের গান। পুরো গানটি এরকম:
‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ
মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ
তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ
আপনার পানে চাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে
যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই
নিশিদিন কাঁদি তাই
হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে
যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই
নিশিদিন কাঁদি তাই
অন্তরগ্লানি সংসারভার
পলক ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার
রাখিবারে যদি পাই।
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু
কোথা বিচ্ছেদ নাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে
যত দূরে আমি ধাই।’
সন্দেহ নেই এটি নির্ভেজাল পূজার গান। এই গানের মাধ্যমে মূলত দেবদেবীর প্রশস্তি গাওয়া হয়েছে। তাদের প্রতি নিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। গানের দুটি চরণের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে:
‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা-কিছু সব
আছে আছে আছে--
নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন
কাঁদি তাই।
অর্থাৎ যে সুমহান প্রভু আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর পদতলে সবই আছে। সেখানে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। যত ভয় আছে সবই আমাদের অন্তরের ভেতরকার ভয়। সেই ভয় আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আমাদের কাঁদায় প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে।
অন্তরগ্লানি সংসারভার পলক
ফেলিতে কোথা একাকার
জীবনের মাঝে স্বরূপ তোমার
রাখিবারে যদি পাই॥
মানে হল, আমাদের জীবনের কেন্দ্রে (হৃদয়াসনে) যদি আমাদের সুমহান প্রভুকে স্থান দেই তাহলে আমাদের অন্তরের যত কষ্ট ও ভয়, সংসারের যত ভার সবই পলক ফেলতে না ফেলতেই এক নিমেষেই কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। তখন আমাদের পাহাড়তুল্য বিষাদে ভরা মনেও আপনা আপনি একটা প্রেরণাদায়ক ভাবনা সৃষ্টি হয় যে, ছোট খাটো দুঃখ ও কষ্টে জীবন ভেঙে পড়ার না, কখনোই ভেঙে পড়ার না। এইভাবে আমাদের শোক রূপান্তরিত হয় শক্তিতে।’
সন্দেহ নেই, রবীন্দ্রনাথ যে প্রভুর কথা বলেছেন, যে প্রভুর চরণ তলে নিবেদন করেছেন এই গানে, তা রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্বের সকল গানে উল্লেখিত বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবী ছাড়া অন্য কেউ নয়। মুসলিম শিল্পী সাদি মহম্মদের লাশের সামনে পূজার গান, হিন্দু দেবদেবীর স্তুতিকীর্তন কতটা সঙ্গত এই বিচার পাঠকরাই ভালো করতে পারবেন। তবে রবীন্দ্রনাথের রচনায় ধর্মীয় চেতনার মূল উৎস উপনিষদ ও পুরাণ। ধর্মীয়ভাবে তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও চেতনাগতভাবে তিনি সনাতন ধর্মের অনুসারী। জাতীয়ভাবে তিনি মহাভারতীয় চেতনায় উদ্ভাসিত, যা এসেছে ব্রাহ্মণ্য সুপ্রিমেসির চেতনা থেকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় দেশ, প্রেম এবং পূজাকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা বুঝতে হলে বা এগুলোর পার্থক্য করতে হলে বিশেষ অভিনিবেশ প্রয়োজন। যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো গুলিয়ে ফেলি। আর প্রগতিশীলতার বিষয়ে বিতর্কের মীমাংসা করতে হলে আগে বুঝতে হবে এই প্রগতিশীলতার মানদ- কী, কে তা নির্ধারণ করেছে এবং এর মাপকাঠি কার হাতে? আপনি মন্দিরে যান, গির্জায় যান, প্যাগোডায় যান, আপনার প্রগতিশীলতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। বরং এটি আরো শক্তিশালী যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু আপনি মসজিদে যান, আপনি প্রতিক্রিয়াশীল। আপনি নমস্কার বলেন, আদাব বলেন, আপনি প্রগতিশীল। কিন্তু আপনি সালাম দিলে, আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানআল্লাহ বললে আপনি প্রতিক্রিয়াশীল।
এর আগেও একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীকে তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে বিদায় দিতে দেখেছি। বছরখানেক পূর্বে বিখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার মারা গিয়েছেন। তার লাশের পাশে তো এরকম আয়োজন দেখিনি। অনেকেই হয়তো বলবেন, সাদি মহম্মদ যেহেতু সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন, সে কারণেই তার লাশের পাশে গান গাওয়া দূষণীয় ব্যাপার নয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে, নৃত্যশিল্পী মারা গেলে কি তার লাশের সামনে নাচতে হবে? চলচ্চিত্র শিল্পী মারা গেলে কি তার লাশের সামনে মুভি চালাতে হবে? যন্ত্রশিল্পী মারা গেলে কি তার লাশের পাশে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে হবে?
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গাজীপুরের দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে
৭ মাসে গাজায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৪০ জন ছাড়িয়েছে
হবিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একই পরিবারের চারজনের পটুয়াখালীতে দাফন সম্পন্ন
আচমকাই খাদে পড়ল যাত্রীবাহী বাস, পাকিস্তানে নিহত ২০
বিক্ষোভে অংশ নেয়ায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত বাংলাদেশি ছাত্রী
ভারতকে ‘অপমান’ বাইডেনের, যা বলল হোয়াইট হাউজ
নিয়মভঙ্গের অভিযোগে আদানির ৬ সংস্থাকে শোকজ নোটিস
কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের
পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির
গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ
দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া
শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন
লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান
গাজীপুরে যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষঃ চালকসহ আহত ৪
পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল
মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক
উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা
বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য