হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি মামলার রায়

Daily Inqilab ইনকিলাব

২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০৩ এএম

বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে হলমার্ক গ্রুপের বড় কোনো অবদান বা খ্যাতি না থাকলেও জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ধরা পড়ার পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এরপর দেশে আরো অনেক বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেলেও এসবের সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা বিচারের প্রক্রিয়া এখনো দৃশ্যমান নয়। এক যুগের বেশি সময় পরে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির বিচারিক রায় প্রকাশিত হলো। রায়ে গ্রুপের চেয়ারম্যান তানভির মাহমুদ ও তার স্ত্রী জেসমিনসহ ৯ জনের যাবজ্জীবনসহ ১৭ জনের কারাদন্ড এবং তানভির দম্পতিকে ৫ কোটি টাকা অর্থদন্ড দিয়েছেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। গত মঙ্গলবার বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারক মো. আবুল কাশেম এই রায় প্রদান করেন। বিচারক তার পর্যবেক্ষণে এ ধরনের অর্থ কেলেঙ্কারির ভয়াবহতার মাত্রা নির্দেশ করে বলেন, যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, অর্থনীতিকে খেলো মনে করেন, তাদের মৃত্যুদ-ের মতো সাজা হওয়া উচিত। হলমার্কের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১১টি মামলা হয়েছিল। এর একটির রায়ে এ দ- ঘোষিত হলো। বাকি মামলাগুলো এখনো পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে রয়েছে। এসব মামলার কার্যক্রম দ্রুতায়িত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার প্রত্যাশা দেশের মানুষের।

হলমার্ক গ্রুপের চেয়েও বড় বড় ব্যাংক জালিয়াত, ঋণ খেলাপি এবং দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে ধসিয়ে দেয়ার কুশীলবরা দেশে বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গত মাসে হাইকোর্টে এস আলম গ্রুপের অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল মামলায় এস আলম গ্রুপের বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের অনুসন্ধানের আদেশ খারিজ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের ৬ সদস্যের আপিল বেঞ্চ। গত দেড় দশকে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এস আলম গ্রুপের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ইসলামি ব্যাংক থেকে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহণসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে অর্থ সরিয়ে পুরো সেক্টরকে দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তোলার অভিযোগ উঠেছে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর থেকে সরকারের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারির হোতাদের দাপট ও প্রভাব সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এরই প্রেক্ষাপটে হলমার্কের তানভির-জেসমিনসহ দ-প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চুনোপুঁটি বলে অভিহিত করেছেন এ এইচ মনসুরের মতো শীর্ষ অর্থনীতিবিদ। আরেক অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজ হলমার্ক কেলেঙ্কারির এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে অন্য সব কেলেঙ্কারির বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়েছেন। হলমার্কের হস্তান্তরিত অর্থ ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত এই রায়ের প্রত্যাশিত বাস্তবায়ন বাহ্যত অনিশ্চিতই রয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটসহ রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে আরো সক্রিয় ও শক্তিশালী ভূমিকা নিয়ে মাঠে নামতে হবে।

দেশ আজ এক ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়েছে। হঠাৎ করেই এটি সংঘটিত হয়নি। গত দেড় দশকে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটির উপরে উন্নীত হয়েছে। দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক লোন থেকে বঞ্চিত হলেও ভুয়া কোম্পানি ও ব্যবসা সাজিয়ে হলমার্ক-বিসমিল্লাহ গ্রুপ ইত্যাদির শীর্ষ ব্যক্তিরা নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ও অর্থব্যবস্থাকে চরম বিশৃঙ্খলা ও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের আলোকে গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, আস্থাহীনতার কারণে গত বছর দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৯৫ হাজার আমানতকারী হারিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন এ অবস্থাকে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থার প্রতিফলন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একই সাথে তিনি হলমার্কের বিচার প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ ও অপর্যাপ্ত বলে মন্তব্য করেন। এখানে পাচারকৃত অর্থ ও ফেরত আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য উদঘাটনে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে অনেক দেরিতে হলেও হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারির বিচারিক রায় এ ধরনের কেলেঙ্কারির হোতাদের জন্য একটি অশনি সংকেত। বড় বড় ঋণখেলাপি ও অর্থ কেলেঙ্কারির হোতারা দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। সরকার, রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়। তথ্য প্রযুক্তির বিশ্বায়নের এই যুগে রাষ্ট্রীয় কোনোকিছু ধামাচাপা দিয়ে দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার নেপথ্যে থাকা অর্থপাচারকারী ও ঋণ জালিয়াতদের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের

কষ্টের ‘স্মৃতি’ ভুলে রায়বরেলিতে রাহুল, আমেঠিতে নতুন মুখ কংগ্রেসের

পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির

পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মীয় মেরুকরণ উস্কে দেয়ার চেষ্টা মোদির

গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ

গাজীপুরে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহবান জানিয়ে বিএনপি'র লিফলেট বিতরণ

দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া

দুই ভারতীয় গুপ্তচরকে বহিষ্কারের প্রসঙ্গে যা জানাল অস্ট্রেলিয়া

শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন

শিক্ষার্থী বিক্ষোভ নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বাইডেন

লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান

লন্ডনের মেয়র পদে হ্যাটট্রিক জয়ের পথে সাদিক খান

গাজীপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ : ৫ বগি লাইনচ্যুত, আহত অন্তত ৫০

গাজীপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ : ৫ বগি লাইনচ্যুত, আহত অন্তত ৫০

পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল

পশ্চিম তীরে দুই শিশুকে হত্যা, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইল

মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক

মুক্তি পেলেন মাওলানা মামুনুল হক

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই : চিকিৎসক

উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা

উখিয়া থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে দীর্ঘ ৩৬ ঘন্টা পর ছেড়ে দিল আরাকান আর্মি'র সদস্যরা

বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য

বিশ্বের দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞার মুখে ভারতীয় খাদ্যপণ্য

নাইজারে মার্কিন ঘাঁটিতে অবস্থান নিল রুশ সেনা

নাইজারে মার্কিন ঘাঁটিতে অবস্থান নিল রুশ সেনা

মুদ্রাপাচার নিয়ে সরকার ও আইএমএফ রহস্যজনক কারণে নীরব : ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন

মুদ্রাপাচার নিয়ে সরকার ও আইএমএফ রহস্যজনক কারণে নীরব : ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন

বাইডেন না ট্রাম্প, কে হবেন প্রেসিডেন্ট? জানালেন বিখ্যাত ভোটকুশলী

বাইডেন না ট্রাম্প, কে হবেন প্রেসিডেন্ট? জানালেন বিখ্যাত ভোটকুশলী

তথ্য পাঠাচ্ছে চীনের বৃষ্টিপাত পরিমাপক স্যাটেলাইট

তথ্য পাঠাচ্ছে চীনের বৃষ্টিপাত পরিমাপক স্যাটেলাইট

ইইউ-তে ফ্রান্স চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার

ইইউ-তে ফ্রান্স চীনের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার

বাইডেনের জনপ্রিয়তায় ভয়াবহ ধস

বাইডেনের জনপ্রিয়তায় ভয়াবহ ধস

পুরুষদের থেকে বেশি সময় বাঁচলেও অসুস্থ থাকেন মহিলারা, গবেষণাপত্রে প্রকাশ

পুরুষদের থেকে বেশি সময় বাঁচলেও অসুস্থ থাকেন মহিলারা, গবেষণাপত্রে প্রকাশ

তাইওয়ান ইস্যুতে ডব্লিউএইচও-কে ব্যবহার না করতে যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের তাগিদ

তাইওয়ান ইস্যুতে ডব্লিউএইচও-কে ব্যবহার না করতে যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের তাগিদ