বাজারে নকল ভেজাল ওষুধের জাঁকালো কারবার
১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৮ এএম
অসুস্থ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায়। চিকিৎসক রোগীকে দেখে-শুনে প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দেন। রোগী দোকান থেকে ওষুধ কিনে খায়। এটিই সাধারণ প্রক্রিয়া। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ খেয়েও রোগ সারে না। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ রোগমুক্তি প্রলম্বিত করে। রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। শেষ পরিণতি চিরনিদ্রায় শায়িত করে। ভেজালের সমারোহে নতুন সংযোজন আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ। বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ফার্মেসিতে। সম্প্রতি দেশব্যাপী এ ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে ওষুধ প্রশাসন। আটক করা হয়েছে অবৈধ বিদেশি বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল। শুধু ফার্মেসিতেই নয়, বিভিন্ন হোমিওপ্যাথির দোকানে কিংবা হেকিমি দাওয়াখানায় দেদারছে বিক্রি হচ্ছে বলবর্ধক, যৌনবর্ধক বিভিন্ন ওষুধ। ফুড সাপ্লিমেন্ট নামে এগুলো অবাধে দেশে ঢুকছে। ওষুধ প্রশাসনের একটি ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটি রয়েছে, কোনো ওষুধ বাজারজাত করার আগে অবশ্যই এ কমিটির অনুমতি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার কাছে আমরা নিজেদের সমর্পণ করে নির্ভার জীবন যাপন করছি।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিক্রির শতকরা প্রায় ১০ ভাগ। দুর্নীতি, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, দুর্বল বিচারব্যবস্থা, ক্ষমতাসীনদের অর্থলিপ্সা, শক্ত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রভৃতির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অসামর্থ্যতা, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এবং অজ্ঞতা ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বাজার বিস্তারের প্রধান কারণ। এর উপর ভর করছে ফার্মেসিতে ভয়ংকর ডাক্তারি। ৬৪ শতাংশ ওষুধ বিক্রেতা রোগের উপসর্গ শুনে নিজেরাই ওষুধ দেয়। ৮৭ শতাংশ ওষুধ বেচে প্রেসক্রিপশন ছাড়া। যোগ্যতা ছাড়াই অবৈধভাবে ওষুধ বিক্রেতার কাজ করছে ৫২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ওষুধ দেওয়া হয় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রুপের। অথচ, বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রণীত ওষুধনীতি অনুযায়ী, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রেতা কর্তৃক কোনো রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া নিষেধ।
দেশে ওষুধ বিক্রির নামে অনাচার চললেও দেখার কেউ নেই। কর্মকর্তারা ফার্মেসি খোলার অনুমতি দিয়ে আয়েশে যখন অফিস করেন, তখন বিক্রেতারাই ডাক্তার সেজে বসে। স্পর্শকাতর, ঝুঁকিপূর্ণ নানা ওষুধ তারা বিনা ব্যবস্থাপত্রে তুলে দেয় গণমানুষের হাতে। নিম্নমানের, এমনকি ভেজাল ওষুধ গছিয়ে দিতেও তাদের বাধে না। ফলে রোগমুক্তির বদলে অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা বাড়ছে। ভেজাল ওষুধে, অপচিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা তো ঘটছে বহুবার। বছরের পর বছর ধরে এমন নৈরাজ্য চলছে, গণমাধ্যমে খবর আসছে কর্তৃপক্ষের সমালোচনা হচ্ছে, এটুকুই। সংকটের সমাধান মেলে না, দায়ী ব্যক্তিদের নেয়া হয় না কাঠগড়ায়।
ওষুধ হলো রাসায়নিক পদার্থ, যা সঠিক পরিমাণ, সঠিক মাত্রা, সঠিক রোগের জন্য গ্রহণ-সেবন এবং সঠিক মেয়াদ পর্যন্ত চালালে মানুষের জন্য কার্যকর। অপব্যবহারে জীবাণু ধ্বংস হয় না, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ যদি মানসম্পন্ন না হয়, নিম্নমানের হয়, ভেজাল হয়, যথেচ্ছ ব্যবহার কিংবা নির্বিচারে প্রয়োগ, প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হয় কিংবা কম দামী অন্য ওষুধ দিয়ে দেয়া হয়, তবে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। নকল ও নিষিদ্ধ ওষুধ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও মজুদ করার কাজে সমাজ বিরোধী চক্রের সাথে ওষুধের দোকানদারও সহযোগিতা করে থাকে। এর পরিণামে ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে আমাদের সহজ-সরল মানুষগুলো।
মাদকাসক্তি আমাদের জাতীয় সমস্যা। তা এখন রাজধানী শহর অতিক্রম করে গ্রামের পাড়ায়, মহল্লায় প্রবেশ করেছে। দেশের তরুণ সমাজ ড্রাগ আসক্ত হয়ে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে, যা পরিবারের কর্তা, সমাজসেবক, জাতীয় কর্ণধারগণকে ভাবিয়ে তুলছে। তরুণরা ড্রাগগুলো গ্রহণ করছে অসাধু ওষুধের দোকানদারদের কাছ থেকে, ওষুধ বিজ্ঞানে তাদের প্রশিক্ষণ না থাকাতে জাতির প্রতি তাদের কোন কমিটমেন্ট নেই।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপশহরের প্রতিটি গলি, উপগলিতে এক বা একাধিক এবং দেশের প্রতিটি গ্রামে বা পাড়ায় এক বা একাধিক ওষুধের দোকানসহ প্রায় ৬ লক্ষের মতো ফার্মেসি বিদ্যমান। একজন ওষুধ বিক্রেতার অবশ্যই ওষুধ সংরক্ষণ, মাত্রা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ ওষুধ বিক্রেতারই এ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান নেই। যোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই বিক্রেতারা ওষুধ বিক্রি করছে। ফার্মেসি চালানোর জন্য যে আইন রয়েছে তার খুবই কম মানা হচ্ছে।
রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় পৃথিবীর কোনো দেশেই হয় না। ব্যতিক্রম কেবলই আমাদের দেশ। ওষুধের সঠিক ব্যবহার এবং চিকিৎসকের নির্দেশমত নিয়ম পালনে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই একজন রোগী পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পেতে পারে। এই নিয়মটুকু বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যে ওষুধ বিক্রি করবে তারই। আমাদের দেশে সবমিলিয়ে প্রায় ৮০০ ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির তৈরি করা ওষুধ গুণ ও মানসম্পন্ন কিনা, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগার বা লোকবল ওষুধ প্রশাসনের নেই, যা আছে তা নিয়ে যদি তারা তৎপর থাকত চাঁদাবাজি না করত তাহলে পরিস্থিতির এত অবনতি হত না। এদিকে যে বা যারা ওষুধ বিক্রি করবে তাদেরও যদি ওষুধ বিজ্ঞানের ন্যূনতম শিক্ষা প্রশিক্ষণ না থাকে পরিণতি তো ভয়াবহ হবেই। বলাবাহুল্য, অন্যান্য দ্রব্যের ত্রুটি ক্ষমা করা গেলেও ওষুধের ক্ষেত্রে তা কোনোভাবেই করা যায় না। বিশ্বের সকল সভ্য দেশেই ওষুধ একটি বিশেষায়িত ও উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য।
এদিকে নানান কল্পকাহিনী আর অনিয়ম অব্যবস্থাপনার ফাঁদে পড়ে ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই নতুনভাবে ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ করে রেখেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত পরবর্তীতে নতুন ড্রাগ লাইসেন্স ইস্যু করা হবে না বলে জানানো হয়েছে। তবে নতুন ড্রাগ লাইসেন্স কারা পাবে, কার মাধ্যমে ওষুধ বিক্রি হবে, দেশব্যাপী তার নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। কিন্তু অবৈধভাবে ঔষধের দোকান তো সর্বত্রই খোলা হচ্ছে। এসব তদারকি করছে কে বা কারা? ওষুধ বিক্রি করতে যেখানে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন সেখানে কোন সনদ বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই ঔষধ কেনা-বেচা করছে প্রায় ফার্মেসিতেই, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালার বিরোধী। আমাদের দেশে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রশিক্ষণের দায়িত্বে আছে ফার্মেসি কাউন্সিল। ফার্মেসি কাউন্সিল এখন পর্যন্ত সমগ্র দেশে ওষুধের দোকান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, গবেষণাগার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ওষুধশিল্পে কত লক্ষ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন তা নিরূপণ করতে পারেনি। যে বিশাল সংখ্যক ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট প্রয়োজন তাদের কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে জাতি অপচয় থেকে রক্ষা পাবে, এই পরিকল্পনাটুকুও সরকারের কাছে পেশ করতে পারে ফার্মেসি কাউন্সিল।
ওষুধের মতো সংবেদশীল পণ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করা একটি স্বাধীন জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ওষুধের দোকান পরিচালনা ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে ওষুধ প্রস্তুতকরণ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। তাতে দরকার অন্তত ৭ লাখ ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট। ফার্মেসি কাউন্সিল স্বাধীনতার ৫০ বছরে তাদের ভাষায় শর্ট, লং, দীর্ঘ, সুদীর্ঘ মিলিয়ে ৯৫ হাজারের মতো ব্যক্তিকে ওষুধ জ্ঞানের আওতায় এনেছে মাত্র। ব্যর্থ ফার্মেসি কাউন্সিল আবার ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট প্রদানের মতো কান্ডজ্ঞানহীন কান্ডও করে যাচ্ছে অবলীলায়। একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা সার্টিফিকেট প্রদানের গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠান বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়। ফার্মেসি কাউন্সিলের নীতিহীন অনৈতিক কাজের খেসারত দিচ্ছে এদেশের চিকিৎসাপ্রার্থী জনগণ। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন আলাদা স্বাধীন স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ড, যেমনটা আমাদের দেশেও অন্যান্য ডিপ্লোমা শিক্ষার ক্ষেত্রে চলমান। ওষুধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও বিতরণ ব্যবস্থার মতো ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত দক্ষ দায়িত্বশীল ব্যক্তির উপরই নির্ভর করছে, আমাদের নিরোগ স্বাস্থ্য, প্রশান্ত দেহমন আর সুস্থ সবল সৃজনশীল আগামী প্রজন্ম।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতের বিশ্বকাপ দলে পান্ত, দুবে, স্যামসন, রাহুল বাদ
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রংপুরের মামলা হাইকোর্টে স্থগিত
আগামীকাল কেন্দ্রীয় বিএনপির, ৫ সদস্যের একটি টিম মধুখালি চোপরঘাট নিহত দুই সহোদরের বাড়ী আসছেন।
মুন্সীগঞ্জে হিট স্ট্রোকে দুইজনের মৃত্যু
প্রিমিয়ার লিগে ফিরল লেস্টার
স্বর্ণ কিনতে ছুটছে চীনের তরুণরা
রাশিয়া-চীন সম্পর্ক আরো দৃঢ় হচ্ছে
সউদির আগ্রহের পরও সালাহর ব্যাপারে আশাবাদী লিভারপুল
যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩.৮ ডিগ্রি, তিন দশকে সর্বোচ্চ
৫২ বছরের মধ্যে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, নিম্ন আয়ের মানুষ পড়ছেন চরম বিপাকে
অবহেলার দায়ে শিক্ষা কর্মকর্তাকে শোকজ
কালিয়াকৈর অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার
রাজবাড়ীতে পৃথক সড়ক দুঘর্টনায় ৩জনের মৃত্যু
কালিয়াকৈরে অজ্ঞাত যুবকের
চেলসিকে বিদায় বলে দিলেন সিলভা
২৯ বছরের তাপমাত্রা ডিঙিয়ে চুয়াডাঙ্গায় আবারো সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস
টেকনাফে বিজিবি'র চেকপোস্টে তল্লাশীকালে আইস ও ইয়াবাসহ প্রাইভেট কার জব্দ, আটক-১
বালিয়াকান্দিতে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু
কোনো মাদক ব্যবসায়ী প্রার্থী হলে তাকে বর্জন করা উচিত
পাঁচবিবিতে র্যাবের অভিযানে অপহরণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপহৃত উদ্ধার। আটক-৩