পরিবেশ রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

২৪ মে ২০২৪, ১২:২১ এএম | আপডেট: ২৪ মে ২০২৪, ১২:২১ এএম

প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে। প্রকৃতি তখনই প্রতিশোধ নেয়, যখন সে মানুষের জুলুমের শিকার হয়। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটিয়ে থাকে। প্রকৃতির রুদ্ররূপ দিন দিন তীব্র হচ্ছে। এর পেছনে মানুষের প্রকৃতিবিনাশী কর্মকা- দায়ী। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু বা আবহাওয়ার যে বিরূপ পরিবর্তন, তাপমাত্রা ও সাগরের উচ্ছতা বৃদ্ধি, তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস, পানি ও বায়ু দূষিত করার মতো যে অপকর্ম চলছে, তারই বিরূপ প্রতিক্রিয়া এখন দেখা দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলো বেশি দায়ী। তাদের শিল্পায়ন এবং পারমানবিক কেন্দ্রগুলো থেকে নিঃসরিত বিষাক্ত কেমিক্যাল পানি ও বায়ুতে মিশে পৃথিবীকে দূষিত করে তুলছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে। উত্তর মেরুর বরফ গলে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের ভূখ- তলিয়ে যাচ্ছে। দূষণের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকদের মতে, ঊনিশ শতকের চেয়ে ২০২৩ সালে ১.৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি ছিল, যা বিগত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিগত এক দশকের মধ্যে গত বছর ছিল সবচেয়ে বেশি উষ্ণ। এ বছরও উষ্ণতম হবে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা’র গবেষকরা বলেছেন, ১৮৮০ সাল থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এ তাপমাত্রা বেশি বাড়তে থাকে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। এ বৃদ্ধির হার প্রতি বছর গড়ে ০.১৫ থেকে ০.২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পৃথিবীর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, মানুষের অপরিনামদর্শী কর্মকা-, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, গ্যাস, অনিয়ন্ত্রিত কার্বন ডাই অক্সাইড, শিষা, কার্বন মনোঅক্সাইড, যানবাহনের ধোঁয়া, বনজ সম্পদ ধ্বংস ইত্যাদি। এসব কারণে স্থল ও জলভাগের পরিবেশ দূষিত হয়ে জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন ঠেকাতে উন্নত বিশ্ব প্রতিবছর জলবায়ু সম্মেলন করে করণীয় নির্ধারণ করে। তবে তা অনেকটা লোকদেখানোতে পরিণত হয়েছে। তারা আলোচনা করছে ঠিকই, কারণগুলোর প্রতিকার করছে না।

দুই.
ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। জলবায়ু গবেষকদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ঝড়-জলচ্ছ্বোসের কারণে বছরে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখোমুখি হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি তলিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ক্রান্টি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ)-এর এক জরিপে বলা হয়েছে, পানি ও বায়ুদূষণ, বিষাক্ত শিসা ও গ্যাস নিঃসরণে বছরে প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষতি জিডিপি’র প্রায় সাড়ে ১৭ ভাগ। অন্যদিকে, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে অতি বন্যা ও বৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, তাপপ্রবাহ, খরা ও নদীভাঙ্গণ তীব্র হয়ে উঠেছে। বলা যায়, দেশ পরিবেশগত ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়টি সরকারসহ কেউ তেমন উপলব্ধি বা গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিভাবে ঝুঁকি কমানো যায়, তার উদ্যোগ নেয়া দূরে থাক, উল্টো ঝুঁকি বাড়ানোর যত ধরনের কাজ ও কারণ রয়েছে, তা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণগুলো চিহ্নিত হয়ে থাকলেও তা দূর করার কোনো উদ্যোগ নেই। পরিবেশবিদরা সভা-সেমিনার করে বললেও সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষের বসবাসের উপযোগী কোনো পরিবেশ না থাকলে বা উপযোগিতা বজায় না রাখলে, সেখানে মানুষ টিকে থাকতে পারে না। অথচ আমাদের মতো জনবহুল দেশে যেকোনো সরকারেরই উচিত পরিবেশ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। এ দিকটিই সরকার সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করে যাচ্ছে। বরং পরিবেশ ধ্বংসের সাথে যারা জড়িত, তাদের বেশিরভাগই সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করে যাচ্ছে। খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয়, বনবাদাড়, পাহাড় ধ্বংস, দখল ও উজাড় করে চলেছে। প্রশাসন দেখেও না দেখা, জেনেও না জানার ভান করছে। পরিবেশের এই ক্রমাগত ও নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ বছরের পর বছর ধরে চলছে, যার প্রতিক্রিয়া এখন দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত এপ্রিলে যে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে, তা ছিল বিগত ৭৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ। আবহাওয়ার এই বিরূপ পরিবর্তন কিভাবে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তা আমরা দেখেছি। হিট স্ট্রোকে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজনের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। অসুস্থ হয়েছে অনেকে। দেখা যাচ্ছে, দেশে নতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে হিট ওয়েব যুক্ত হয়েছে। এ বছরই যে হিট ওয়েব শেষ হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না। এটি এখন নিয়মিত হতে যাচ্ছে। আগামী বছরগুলোতেও দুর্যোগ হিসেবে তা দেখা দিতে পারে। এতে মানুষের জীবনযাপন কষ্টদায়ক হয়ে পড়বে। শ্রমজীবী মানুষের আয়-রোজগার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের নীতিনির্ধারক, ধনীক শ্রেণি ও সামর্থ্যবানরা এসিতে থাকতে ও ঘুমাতে পারবে। এসি থেকে এসিতে চলাফেরা ও জীবনযাপন করবে। এবারের তাপপ্রবাহের উত্তাপ তাদের স্পর্শ করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। এসি ব্যবহার করা দোষের কিছু নয়। তবে এর থেকে নির্গত গরম হাওয়া শীতল করার জন্য যে পর্যাপ্ত গাছপালা ও সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, তা কি আছে? কিংবা গাছপালা লাগিয়ে পরিবেশ ঠান্ডা রাখার যে উদ্যোগ, তা কি আছে? নেই। বরং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গাছপালা কেটে ছাপ করে ফেলা হচ্ছে। আগে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সড়কের দুই পাশে প্রচুর গাছপালা দেখা যেত। বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশে বৃক্ষের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যেত। এখন তার ছিঁটেফোটাও নেই। উন্নয়ন প্রকল্প সব বৃক্ষ খেয়ে ফেলেছে। একটা সময় সরকারের পক্ষ থেকে বহুল প্রচলিত একটা স্লোগান ছিল, ‘একটি গাছ কাটলে, দুটি গাছ রোপন করুন।’ এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারই উন্নয়ন প্রকল্প করতে গিয়ে অসংখ্য গাছ কেটে বিরান করে দিচ্ছে। তার পরিবর্তে দুটি দূরে থাক, একটিও রোপন করতে দেখা যায় না।

তিন.
উন্নয়ন দেশের জন্য অবশ্যই জরুরি। তবে যে উন্নয়ন পরিবেশ বিধ্বংসী হয়ে উঠে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো উন্নয়ন প্রকল্প করতে গিয়ে প্রকল্প এলাকায় সবার আগে পরিবেশের কি ক্ষতি হবে এবং তা কিভাবে রক্ষা করে উন্নয়ন করা যায়, তা গবেষণা করে নির্ণয় করে। প্রকল্পের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়। এজন্য তারা দিনের পর দিন প্রকল্প এলাকায় গবেষণা করে, সমীক্ষা চালায়। তারা যে কাজটি করে তা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কত বৃক্ষ ও জলাশয় এবং পশু-পাখির আভাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তা নির্ধারণ করে। প্রকল্প এলাকায় কোন কোন প্রজাতির পশু-পাখি বসবাস করে এ নিয়ে জরিপ করে। প্রকল্প এলাকার কোথায় কোথায় পশু-পাখির আভাসস্থল তা নির্ণয় করার জন্য রাতের বেলা অত্যাধুনিক যন্ত্র নিয়ে সেগুলোর ভাষা বা শব্দ শনাক্ত করে। তারপর প্রকল্পের কারণে যাতে তা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেভাবে প্রকল্প পরিকল্পনা করা হয়। অর্থাৎ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না করে প্রকল্পের কাজ শুর করা হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের সমীক্ষা চালানো হয় না বললেই চলে। বরং ‘প্রকল্প আগে পরিবেশ পরে’ এ নীতি অবলম্বন করে পরিবেশ ও পশু-পাখির আভাসস্থল ধ্বংস করে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। নগর উন্নয়ন করতে গিয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়। উন্নয়ন করতে গিয়ে যশোর ও চট্টগ্রামের প্রাচীন বৃক্ষ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘটনাও সাম্প্রতিককালে ঘটেছে। এ নিয়ে পরিবেশবিদ ও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। অথচ জাপানে কোনো উন্নয়ন কাজ কিংবা সড়ক নির্মাণ করার ক্ষেত্রে যদি কোনো গাছ বাধা সৃষ্টি করে তবে আমাদের মতো তা তৎক্ষণাৎ কেটে ফেলা হয় না। তারা গাছ না কেটে অনেকটা চারাগাছের মতো মূলসহ অত্যন্ত যতেœর সাথে গাছটি তুলে এনে সড়কের পাশে বা অন্যকোনো স্থানে লাগিয়ে দেয়। গাছের প্রতি তথা প্রকৃতির প্রতি তাদের এতটাই মায়া। এর বিপরীত চিত্র আমাদের দেশে। এখানে সড়ক নির্মাণ বা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রকৃতির প্রতি কোনো মায়া না দেখিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়া হয়। সারাদেশেই নির্বিচারে প্রকৃতিবিনাশী কাজ চলছে। বন কেটে উজাড়, পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা হচ্ছে। এমনকি যেসব বন সরকারিভাবে রিজার্ভ বা পশু-পাখির জন্য অভয়রাণ্য ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। গত ১৪ মে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একসময় শেরপুরের গারো পাহাড়ে গভীর অরণ্য ছিল, সেটি এখন বিলুপ্তির পথে। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কেটে সমতলভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি সেখানে পশু-পাখির অভয়রাণ্য বলতে কিছু নেই। গারো পাহাড় সৌন্দর্য হারিয়ে বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে। এই পাহাড় ধ্বংসের পেছনে অসাধু বন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। শুধু গারো পাহাড়ই নয়, সিলেট, চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়-টিলা ও অভয়রাণ্যে চলছে প্রভাবশালীদের ধ্বংসযজ্ঞ। উপকূলীয় অঞ্চলেও চলছে বননিধন। উল্লেখ করা প্রয়োজন, একটি দেশে তার মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়। বাংলাদেশে তা নেই। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, বর্তমানে দেশের মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে। জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার (এফএও)-এর হিসাবে বাংলাদেশে বনভূমি রয়েছে ১১.১ শতাংশ। এর মধ্যে ১০.৭% সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে ২৫টি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য, ১৯টি জাতীয় উদ্যান এবং গেম রিজার্ভ। এর মধ্যেই চলছে বন নিধন। এমন কোনো বন নেই, যেখানে নিধন চলছে না, বন ও পাহাড় কেটে অবৈধ দখল ও স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে না। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পরিবেশ। বলা বাহুল্য, বন যেমন পরিবেশ শীতল ও বৃষ্টি ঝরাতে সাহায্য করে, তেমনি ঝড়-ঝঞ্ঝাও ঠেকিয়ে দেয়। সুন্দরবন বহু সাইক্লোনের তীব্রতা কমিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে। অন্যদিকে, পাহাড়ও ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রতীর ঘেঁষে পাহাড়ের যে সারি, তা প্রকৃতির এক অপার দান। পাহাড়গুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং সমুদ্রের ভাঙন ও ঝড় ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য যেন রুখে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এসব পাহাড় কেটে অবৈধ দখলের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বর্ম ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। শুধু কক্সবাজারই নয়, চট্টগ্রাম, সিলেট, বান্দরবানসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাহাড়, টিলা কেটে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য তো বিনষ্ট হচ্ছেই, প্রকৃতিকেও রুদ্র করে তুলছে। পাহাড়ে বিপুল সম্পদ রয়েছে। বনজবৃক্ষসহ মূল্যবান শাল, গজারি কাঠের ভান্ডার, ওষুধি বৃক্ষ, ফলফলাদি, শিল্পের কাঁচামালসহ আরও অনেক মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখির আবাসস্থলও পাহাড়। পাহাড় কাটার ফলে বন্যপ্রাণীর বসবাসের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ফলে সেগুলোর যাওয়ার জায়গা থাকে না। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। অনেক সময় পাহাড় থেকে হাতির দল লোকালয়ে নেমে এসে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তাদের আবাস ও খাদ্য বিনষ্ট করলে এছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না।

চার.
একশ্রেণীর মানুষ বছরের পর বছর ধরে দেশজুড়ে পরিবেশ ধ্বংসের যে তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর সাবের হোসেন চৌধুরী পরিবেশ রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলেছিলেন, যা আশার সঞ্চার করেছে। পরিবেশ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আগে এ মন্ত্রণালয়ের কোনো মন্ত্রী যে রয়েছে, তা টের পাওয়া যেত না। পরিবেশ রক্ষায় কোনো কর্মসূচির কথা শোনা যেত না। সাবের হোসেন চৌধুরী মন্ত্রী হওয়ার পর একশ’ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। গত সপ্তাহে বলেছেন, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগাবেন। এ সবই ভাল উদ্যোগ। তবে দেশের সংরক্ষিত বনসহ পাহাড় কাটার যে মচ্ছব চলছে, তা বন্ধে এবং এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। গাছ লাগানোর আগে বিদ্যমান গাছ ও পাহাড় কাটা যে বন্ধ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি, এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। গাছ লাগালেই তো হয় না, তা পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করে তোলাও জরুরি। স্বাধীনতার পর হাজার হাজার কোটি টাকার গাছ লাগানো হলেও তার ফলাফল কখনোই আশাপ্রদ ছিল না। বরং বিদ্যমান বন ও পাহাড় কেটে উজাড় করে প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন ও রুক্ষ করে তোলা হচ্ছে। জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। এই পরিবর্তন রোধে বিশ্বের জলবায়ু তহবিল থেকে শত শত কোটি ডলার সাহায্য এলেও তা এ কাজে ব্যয় করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। কেবল উপকূলে নামকাওয়াস্তে কিছু বনায়ন করে খরচ দেখানো হচ্ছে। বাকি অর্থের কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। সম্প্রতি জানা যায়, সরকার জলবায়ু তহবিল থেকে ঋণ পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে, যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সমালোচনা করেছেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, পরিবেশ রক্ষায় সরকারের তেমন কোনো উদ্বেগ নেই। অথচ দেশের জলবায়ু পরিবর্তন রোধে, পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশ, মানুষের জানমাল ও ফসলের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা অপূরণীয়। এ ক্ষতি রোধ করতে না পারলে যতই অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হোক না কেন, তা কোনো কাজে লাগবে না। কাজেই, প্রাকৃতিক অবকাঠামো বন, পাহাড় রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। এগুলো ধ্বংসের কাজে যারা জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। গাছ কাটার পরিবর্তে, তা কিভাবে রক্ষা করা যায় এবং আরও বেশি গাছ লাগানো যায়, এ উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষকে পরিবেশ রক্ষায় সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সার্বিয়াকে বিদায় করে শেষ ষোলোতে ডেনমার্ক

সার্বিয়াকে বিদায় করে শেষ ষোলোতে ডেনমার্ক

বিবর্ণ ফুটবলে ফের জয়হীন থেকেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড

বিবর্ণ ফুটবলে ফের জয়হীন থেকেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড

ফিরেই গোল পেলেন এমবাপে,তবুও জয় পেলনা ফ্রান্স

ফিরেই গোল পেলেন এমবাপে,তবুও জয় পেলনা ফ্রান্স

ডাচদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই নকআউটে সার্বিয়া

ডাচদের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েই নকআউটে সার্বিয়া

ওয়েল সাবরা বিএটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মইন উদ্দীনের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন

ওয়েল সাবরা বিএটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মইন উদ্দীনের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন

৪৪তম বিসিএস পরীক্ষা-২০২১ এর পুনর্বিন্যাসকৃত মৌখিক পরীক্ষার সময়সূচি

৪৪তম বিসিএস পরীক্ষা-২০২১ এর পুনর্বিন্যাসকৃত মৌখিক পরীক্ষার সময়সূচি

যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘব হোক

যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘব হোক

সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ চাই

সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ চাই

সেন্টমার্টিনের অদূরে গুলি এবং খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর চক্রান্ত কি একসূত্রে গাঁথা?

সেন্টমার্টিনের অদূরে গুলি এবং খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর চক্রান্ত কি একসূত্রে গাঁথা?

পশ্চিমের ইসলামোফোবিয়া ও নরেন্দ্র মোদির নতুন মন্ত্রীসভা

পশ্চিমের ইসলামোফোবিয়া ও নরেন্দ্র মোদির নতুন মন্ত্রীসভা

নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে হবে

নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে হবে

টিআরপিতে সেরার আসন ধরে রাখল ফুলকি

টিআরপিতে সেরার আসন ধরে রাখল ফুলকি

স্টার ওয়ারসে ফিরছেন ডেইজি রিডলি

স্টার ওয়ারসে ফিরছেন ডেইজি রিডলি

সিঙ্গেল লাইফে ভালো আছেন মোনালিসা

সিঙ্গেল লাইফে ভালো আছেন মোনালিসা

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ফের উত্তপ্ত ভারতের যোধপুর

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ফের উত্তপ্ত ভারতের যোধপুর

পরীমণির সাথে অনৈতিক সম্পর্কের জেরে চাকরি হারাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা

পরীমণির সাথে অনৈতিক সম্পর্কের জেরে চাকরি হারাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা

সঙ্গীতজীবনের ৬০ বছর পূর্তিতে রুনা লায়লাকে চ্যানেল আই-এর সংবর্ধনা

সঙ্গীতজীবনের ৬০ বছর পূর্তিতে রুনা লায়লাকে চ্যানেল আই-এর সংবর্ধনা

চীনে আবার ছুরি হামলা, গ্রেপ্তার ১

চীনে আবার ছুরি হামলা, গ্রেপ্তার ১

ফজর সুন্নত নামাজের পূর্বে কাজা বা নফল নামাজ পড়া প্রসঙ্গে।

ফজর সুন্নত নামাজের পূর্বে কাজা বা নফল নামাজ পড়া প্রসঙ্গে।

ময়মনসিংহে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে নারী চিকিৎসকের আত্মহত্যা

ময়মনসিংহে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে নারী চিকিৎসকের আত্মহত্যা