ঢাকা   শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪ | ২০ আশ্বিন ১৪৩১

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভাবনা ও সংকটের দোলাচল

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম

দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরশাসন ও গুম-খুনের বিভীষিকাময় অবস্থার পরিবর্তনে ছাত্র-জনতার মহান আত্মত্যাগের ঘটনা এ জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর অন্যতম। দেশের মুক্তিকামী জনগণ মনে করে, অর্ন্তবর্তী সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক কাজ হচ্ছে, গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানে হতাহতদের তালিকা তৈরী করে তাদেরকে যথাযথ পুর্নবাসন ও সম্মানিত করা এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। গত দুই মাসেও শহীদ ও আহত যোদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত না হওয়ায় গণঅভ্যুত্থানে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান উঠে আসছে না। অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে আগস্ট বিপ্লবে নিহতের সংখ্যা ৮ শতাধিক এবং শত শত মানুষ পঙ্গু ও অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তবে তার ভাষণের একদিন পর ২৮ সেপ্টেম্বর অর্ন্তবর্তী সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপকমিটির তালিকা অনুসারে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের হাতে ১৫৮১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা যায়। এ সংখ্যা জাতিসংঘ ভাষণে ড.ইউনূসের দেয়া সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। তবে ড. ইউনূসের ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা ও অভিযাত্রায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরের ইতিহাসে আর কখনো কোনো বাংলাদেশী নেতাকে নিয়ে জাতিসংঘে এতটা উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা দেখা যায়নি। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী রিজিমকে হটিয়ে একটি অর্ন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ এবং কথিত সংস্কারের এজেন্ডাকে সামনে রেখে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের বক্তব্য ও বয়ানের একটি যৌক্তিক ভিত্তি লাভ করেছে। নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটের কথা বলে অর্ন্তবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করতে নানা ধরণের প্রপাগান্ডা সফল হতে দেয়া যায় না। তবে এই সরকারকে জনগণের আস্থা ও সমর্থন ধরে রাখতে হলে প্রথমেই স্বৈরাচারের দোসর ও এজেন্টদের চিহ্নিত করে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখী দাঁড় করানোর উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে হবে। বিগত সরকারের সময় অলিগার্কদের বাজার সিন্ডিকেট এখনো তৎপর থাকলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে কতিপয় পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ না থাকায় জনমনে আস্থার সংকট তৈরী করছে। ডিম ও মুরগির দাম, ভারতে ইলিশ মাছ রফতানি এবং দেশে ইলিশের দাম বেড়ে যাওয়া, শহরে যানজট বেড়ে যাওয়া, পাহাড়ে অস্থিতিশীলতা, জামিনে ডাকাতদের মুক্ত করে দেয়ার পর ডাকাতের হাতে সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনা যেন এক সুগভীর চক্রান্তের জালে বাঁধা। রাষ্ট্রের প্রতিবন্ধক ও জনগণের শত্রুদের শক্তহাতে মোকাবেলায় শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থনপুষ্ট একটি বিপ্লবী সরকারের কোনো পিছুটানের সুযোগ নেই।

গত ৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনে ৪র্থ বারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বছরের শুরুতে অবধারিত ধারণা ও প্রত্যয় সৃষ্টি করেছিল যে, শেখ হাসিনা আমৃত্যু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব করবেন। নির্বাচনের আগে একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার দাবিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দেশের অন্তত ৯০ ভাগ মানুষের সমর্থন পেলেও সেসব আন্দোলনকে বিপুল শক্তিতে দমন করে নির্বাচন ও শাসনক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও নিষ্কণ্টক করতে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে হাসিনা রিজিমের মাফিয়াতান্ত্রিক বাহিনী। প্রতিবেশী ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, নিস্পেষণ-নিপীড়ন ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেড় দশকে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ গণবিষ্ফোরণে পরিনত হতে ফ্যাসিবাদী রিজিম তার সীমা অতিক্রম করে একটি চূড়ান্ত আত্মঘাতি পরিনতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। দেশের শিক্ষার্থীরা অযৌক্তিক কোটা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলেও স্বৈরাচারি সরকারের দলীয় ক্যাডার এবং দলবাজ পুলিশ-বিজিবির নৃশংস ভূমিকা সেই বিক্ষোভের অগ্নিতে ঘৃত সঞ্চার করেছিল। জুলাইয়ের মাঝমাঝি আন্দোলন চূড়ান্ত পরিনতি গ্রহণের মুহূর্তেও বাংলাদেশের মাফিয়াতান্ত্রিক অলিগার্ক ব্যবসায়ী নেতারা শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু ক্ষমতায় দেখতে এবং ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে সম্ভাব্য সব পথ অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। গুলি করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও রাজপথে আমাদের সন্তানরা যখন আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী হেলমেট বাহিনী ও পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছিল, তখন রক্তপিপাসু রিজিমের প্রতি দেশের তথাকথিত ব্যবসায়ী নেতাদের নি:শর্ত সমর্থন ছিল বিস্ময়কর ও দু:খজনক বাস্তবতা। স্বৈরাচারি হাসিনার মূল খুঁটির জোর ছিল ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী রেজিম। ওরা মুখে মুখে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের গুরুত্বের কথা বললেও হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর মোদির রিজিম বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের সাথে যে আচরণ করছে, তাতে বোঝা যায়, তারা এখনো অপকৌশলে হাসিনাকে বাংলাদেশেই পুর্নবাসিত করতে চায়। গুম-খুন, গণহত্যা ও রাষ্ট্র ধ্বংসের হোতা হাসিনাকে নিয়ে ভারতে বাজিকে ‘ব্যাড বেট’ বা খারাপ বাজি বলে অভিহিত করেছিল একটি বিদেশি গণমাধ্যম। পরিবর্তিত বাস্তবতায় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সদিচ্ছা প্রদর্শন না করে অর্ন্তবর্তী সরকারের চলার পথকে দূরূহ করতে যারা এখনো সক্রিয় রয়েছে, তারা ভারতীয় এজেন্ট হিসেবেই কাজ করছে।

জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে দেশের তরুণ প্রজন্ম যেভাবে জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে দেশকে নতুন সম্ভাবনার সোপানে উন্নীত করেছে। তার বিপরীতে স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী আমলা, ব্যবসায়ী অলিগার্ক, দেশে-বিদেশে ঘাপটি মেরে থাকা দলীয় ক্যাডাররা এখন এই সরকারকে ব্যর্থ করে দিয়ে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়ার জোরদার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ড.ইউনূস তার জাতিসংঘ ভাষনে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য, চেতনা ও আকাঙ্খার কথা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় স্বৈরশাসনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ না করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নভঙ্গের বিষয়টি যথার্থভাবেই তুলে ধরেছেন। সেই স্বপ্নভঙ্গের যাত্রায় শেখ হাসিনার গত ১৬ বছরের মাফিয়াতান্ত্রিক স্বৈরশাসন ও রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে অকার্যকর করে তোলা এবং দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করে দেশের অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর ও দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি দেশকে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের ক্রীড়নকে পরিনত করেছিল। শেখ হাসিনার পরিবার ও লেসপেন্সারদের লুটপাট ও পেটোয়া বাহিনীর গুম-খুনের বিভীষিকা সৃষ্টি করা হয়েছিল মূলত ভারতীয় আধিপত্যবাদের ছত্রছায়ায়। জুলাই-আগস্টের বিপ্লব শুধু শেখ পরিবারের মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধেই সংঘটিত হয়নি. একই সঙ্গে তা ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদেরও বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে একদিনে শত শত মানুষ হত্যা করেও যখন শেষ রক্ষা হয়নি, শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা এবং ভারতীয় হেজিমনিক এজেন্ডা টিকিয়ে রাখার যুগপৎ মোক্ষ সুযোগ হিসেবে ভারত তাকে দিল্লীতে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণে গেলে ভিসা ছাড়াও ৪৫দিন বৈধভাবে ভারতে অবস্থানের সুযোগ রয়েছে। হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হলেও ভারত এক্ষেত্রে ইমিউনিটি দিয়েছে। তবে শুরু থেকেই দিল্লীতে বসে শেখ হাসিনার বিতর্কিত ভূমিকা, রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সরকার বিরোধী কর্মকান্ডে উৎসাহিত করা এবং ১৬ বছরে গড়ে তোলা দলবাজ পুলিশ, আমলা ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর যোগসাজশে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে একটি পাল্টা অভ্যুত্থান সৃষ্টি অথবা অর্šÍবর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার নীলনকশা সক্রিয় রয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারই শুধু নয় ভারতের এস্টাবলিশমেন্ট ও শাসকশ্রেণী বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়না। বিজেপি সরকারের মন্ত্রী ও বিধায়করা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর তথা হেইট স্পিচ দিচ্ছেন। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি’র নীতির প্রতি সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছেন।

বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জটিল এক সময়ে ভারতের প্রবল আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির নানাবিধ এজেন্ডা ও অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণমানুষের কণ্ঠ ও আকাক্সক্ষাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে ড. ইউনূসের চেয়ে শক্তিশালী দ্বিতীয় আর কোনো ভয়েস ছিল না। জাতির এই ক্রান্তিকালে ৮৪ বছর বয়েসি নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূস এখন ২৪ বছরের তরুনের মত দৃপ্তকণ্ঠে তারুণ্যের জয়গান গেয়ে বাংলাদেশের বিশ্ব জয়ের সংগ্রামে শামিল হয়েছেন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি যিনি নিজের উদ্ভাবনী প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ ও ব্যাংকিং সিস্টেম চালুর মধ্য দিয়ে বিশ্বের সামনে এক অনন্য নজির স্থাপন করে নোবেল বিজয়ের পাশাপাশি বিশ্বের দেশে দেশে সম্মানীত, সমাধৃত ও প্রসংশিত হলেও বাংলাদেশের স্বৈরাচারি রিজিমের চোখে তা ছিল অসহ্য ও অগ্রহণযোগ্য। বিশ্ব সংস্থা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো যখন প্রফেসর ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ, সোশ্যাল বিজনেস এবং থ্রি-জিরো মডেল নিয়ে উৎসাহী হয়ে ইতিবাচক আলোচনা করছিল, বাংলাদেশের রিজিম এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম প্রফেসর ইউনূসকে শুধুমাত্র সুদখোর, রক্তচোষা বলে অপবাদ দিয়েই বসে থাকেনি, দীর্ঘ ৫ দশকে গড়ে তোলা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা, নানাবিধ মামলা দিয়ে হয়রানি করা, পদ্মাসেতু থেকে ফেলে দিয়ে চুবিয়ে তোলার মত অসুয়াপ্রবণ অপপ্রচার চালিয়েছে। ৫ আগস্টের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে মনোনয়নকে একটি বিপ্লবী উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যে ড. ইউনূসকে বছরের পর বছর ধরে দেশবাসি ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হচ্ছিল, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের মত ভূয়া মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের একজন প্রবীন বিশিষ্ট্য নাগরিকই নন, তিনি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল এবং কংগ্রেশনাল মেডেলসহ অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত হয়ে বাংলাদেশের নামকে বিশ্বে সম্মানীত ও অলঙ্কৃত করেছেন। সেই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তারই হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারিদের দিয়ে মামলা করানো হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব রোর্ডসহ বিবিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে মামলা দিয়ে মামলায় হাজিরার দিন সিএমএম কোর্টের লিফ্ট বন্ধ রেখে একজন অশীতিপর বিশিষ্ট্য নাগরিককে পায়ে হাটিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সেই ইউনূসকে ছাত্র-জনতা দেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রথম মধুর প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিনত করে জনগণের রুদ্ররোষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার রেখে যাওয়া অনুগত ও বশংবদ আমলা ও কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। তারা সেখানে ঘাপটি মেরে নিরবে রং বদলে সরকারের আনুগত্য জাহির করে টিকে থাকতে চাইবেন, এটাই হয়তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু না, তাদের অনেকে সরকার বা জনগণের পক্ষে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে দেশে একটি স্থবিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার গোপন এজেন্ডা নিয়েই তারা কাজ করছে।

লগি-বৈঠার তা-বের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকারের সময় সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদের দিল্লী সফরে গেলে দিল্লীর পক্ষ থেকে তাঁকে কয়েকটি ঘোড়া উপহার দেয়া হয়েছিল। সেই থেকেই বাংলাদেশের সেনাসমর্থিত সরকারের ঘাড়ে দিল্লীর ভুত চেপে বসেছিল। পরবর্তী ১৬ বছর ধরে তারা বাংলাদেশের জনগণের উপর লালঘোড়া দাবড়িয়ে চলেছে। আমেরিকার উপর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ফাঁদ দেখিয়ে বাংলাদেশে একটি ভারতীয় বশংবদ সরকার বসানোর কারসাজি অনুসারে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করতে সম্ভাব্য সবকিছু করা হয়। এরপর পশ্চিমাদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটলেও দিল্লীর কারণে বাংলাদেশের পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে সরাসরি ভারতীয় প্রভাব ও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা হয়। দিল্লীর অনুগত আমলা, পুলিশ প্রশাসন ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের উপর ভর করে যে মাফিয়াতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী সরকার কায়েম করা হয়েছিল, ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই সরকারের পতন ঘটলেও সেই আমলা, সেই পুলিশ ও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে থেকে বিপ্লবী সরকারকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছে।

বিগত সরকার হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার এবং হাজার হাজার কোটি ডলার ঋণ নিয়ে দেশের অর্থনীতির উপর অনেকগুলো স্বেতহস্তি রেখে গেলেও জনগণের উপর মূল্যস্ফীতির দুর্ভোগ ও নানা ক্ষেত্রে অচলাবস্থার অচলায়তন থেকে জাতিকে মুক্ত করার কার্যকর উদ্যোগের বদলে দেশকে নতুন নতুন সংকটে নিপতিত করতেই কাজ করছে। অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মাত্র দেড়মাসে দুই দফায় জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলেও বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। অথচ জ্বালানি তেলের দাম সামান্য বাড়ানোর সাথে সাথেই বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে দেখা গেছে। সেই সাথে সরকারে থাকা পরিবহন মাফিয়া ও তাদের চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট পালিয়ে গা ঢাকা দিলেও গণপরিবহনে ভাড়া কমেনি এবং যানজট, নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা নিরসনের কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারি সরকারের দলবাজ আমলারা দেশে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, যাতে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটি তুলনামূলক বাস্তবতা উপস্থাপন করা সহজ হয়ে ওঠে, যখন মানুষ বলবে, এর চেয়ে আগের সরকারই ভাল এবং সফল ছিল। ইতিমধ্যে পতিত হাসিনার এজেন্ডায় কয়েকজন আমলার অপতৎপরতা অর্ন্তবর্তী সাফল্যের সাফল্যের ডানায় ছুরি মারতে উদ্ধত হয়েছে। এর মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানার কারসাজির কারণে আগামী ইরি-বোরো মওসুমে দেশে তীব্র সার সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সার আমদানি প্রক্রিয়া ব্যাহত করে ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার ক্ষতির পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকে একটি খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দেয়ার পায়তারা এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেছে। যেখানে বিগত সরকার বিএনপি-জামায়াতের সময় নিয়োগ পাওয়া কিংবা অতীতে বিএনপি-জামায়াতের সাথে দূরবর্তী কোনো সংশ্রবের অভিযোগে অনেককে চাকরিচ্যুত ও পদায়ন বঞ্চিত করা হয়েছে, সেখানে শেখ হাসিনার সাথে বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়িত এবং স্বৈরাচারি সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণের নির্দেশদাতার স্ত্রী হয়ে প্রশাসনে প্রিভিলেজ পাওয়া জাকিয়া সুলতানা শিল্প মন্ত্রণালয়ে বসে সার আমদানিতে সংকট সৃষ্টির নেপথ্য কলকাঠি নাড়ার দু:সাহস কি করে হয়? একটি রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অর্ন্তবর্তী সরকারে এ ধরনের আমলারা বহাল থাকেন কি করে, সে প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বুঝতে হবে, সর্ষের ভিতরেই ভুত রয়েছে! দিল্লীর অনুগত সেবাদাস পতিত স্বৈরাচার দিল্লীতে পালিয়ে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া অনুগত-অনুচরদের প্রশাসনে বহাল রেখে অর্ন্তবর্তী সরকারের সাফল্য ধরে রাখা অসম্ভব। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম সম্মেলন উপলক্ষে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ৬দিনের নিউইয়র্ক সফরে যে অর্জন বিগত সরকারের পক্ষে বহু বছরেও তা সম্ভব হয়নি। জোবাইডেসহ বিশ্বনেতাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক,সিজিআই এবং সাইডলাইনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্বমূলক আলোচনার মধ্য দিয়ে বহুবছর পর বাংলাদেশ বিশ্বসভায় নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে এ সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। সরকারের ভেতরে এবং আমলাতন্ত্রে সক্রিয় ভারতীয় আধিপত্যবাদের এজেন্টদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দিতে পারলে আর কেউ আমাদের গণতন্ত্র ও স্বাধীন অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অযোগ্য, অদক্ষ ও আওয়ামী লীগ পন্থীদের সরিয়ে জনপ্রশাসনে জনবান্ধব কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগে এগিয়ে যেতে হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

যেখানে নাহিদাই প্রথম

যেখানে নাহিদাই প্রথম

যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ডলারে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন জয়

যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ডলারে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন জয়

সরকারের সর্বত্র এখনো শেখ হাসিনার দোসররা সক্রিয় : রিজভী

সরকারের সর্বত্র এখনো শেখ হাসিনার দোসররা সক্রিয় : রিজভী

পোশাক খাতে অস্থিরতা

পোশাক খাতে অস্থিরতা

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনা এত করুণ কেন

সরকারি হাসপাতালের টয়লেট ব্যবস্থাপনা এত করুণ কেন

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের জন্য রহমত স্বরূপ

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের জন্য রহমত স্বরূপ

পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে দুদকের উল্টো সুর কেন

পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে দুদকের উল্টো সুর কেন

বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য : যুবদল সভাপতি মুন্না

বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই বিএনপির একমাত্র লক্ষ্য : যুবদল সভাপতি মুন্না

বিএনপির সঙ্গে  প্রধান  উপদেষ্টার  সংলাপ  শনিবার

বিএনপির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ শনিবার

চলতি পথে

চলতি পথে

সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

ডেঙ্গু গল্প

ডেঙ্গু গল্প

তারেক রহমানের পক্ষে বাবুগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নাজমুল হাসানের গণসংযোগ

তারেক রহমানের পক্ষে বাবুগঞ্জে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নাজমুল হাসানের গণসংযোগ

অচেনা সুরে

অচেনা সুরে

লাতিন কবি রোকে ডালটন’র দুটি কবিতা

লাতিন কবি রোকে ডালটন’র দুটি কবিতা

কোনো কিছুর উদ্দেশ্যে মানত করলে তা পুরণ না হলে করণীয় প্রসঙ্গে।

কোনো কিছুর উদ্দেশ্যে মানত করলে তা পুরণ না হলে করণীয় প্রসঙ্গে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ শফিকের লাশ দুই মাস পর কবর থেকে উত্তোলন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ শফিকের লাশ দুই মাস পর কবর থেকে উত্তোলন

মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তির খসড়া অনুমোদন

মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী বিনিময় চুক্তির খসড়া অনুমোদন

ব্যাপক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্য

ব্যাপক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মধ্যপ্রাচ্য

বাবা-মা-দুই ছেলের লাশ উদ্ধার ভারতে

বাবা-মা-দুই ছেলের লাশ উদ্ধার ভারতে