নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং রফতানি করার মতো বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা অহরহ বলা হয়েছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে শুরু করে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন এবং এ নিয়ে যাতে কোনো ধরনের অভিযোগ ও অনুযোগ করা না যায়, এজন্য ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির বিধান করা হয়েছিল। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক ছিল সরকারের ঘনিষ্ট লোকজন। ফলে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ না করেও সরকারের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে। এগুলো পরিণত হয়েছিল, অর্থ লুটপাটের প্রকল্পে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার কথায় কথায় দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কথা বলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামে-গঞ্জের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের তার পৌঁছলেও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ মানুষ পায়নি। নামকাওয়াস্তে কয়েক ঘন্টার জন্য বিদ্যুৎ দেয়া হতো। এ নিয়েই বিগত সরকার ব্যাপক প্রপাগান্ডা চালিয়েছে। অন্যদিকে, বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলে বেশি দামে ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ব্যবস্থা করেছে। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে স্বৈরাচার সরকার উন্নয়নের ফানুস উড়িয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়লেও সরবরাহ ব্যবস্থার কোনো উন্নতি করেনি। ফলে দেশের মানুষ নিরবচ্ছিন্ন পায়নি। চালাকি করে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বোঝাতো, বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। বাস্তবতা ছিল একেবারেই বিপরীত। মানুষ নিয়মিত বিল দিয়েও বিদ্যুৎ পায়নি।
গণবিপ্লবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বিদ্যুৎ খাতের অনিয়মের চিত্র বের হয়ে আসছে। পাশাপাশি এ খাতে থাকা তার দোসররা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে চলেছে। গত বৃহস্পতিবার পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আন্দোলনের কারণে সারাদেশ বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। এ আন্দোলন যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে শেখ হাসিনার দোসরদের ষড়যন্ত্র, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। এতে জড়িত বেশ কিছু কর্মকর্তাকে অব্যাহতি ও গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র যে চলতে থাকবে, তা আমরা আগেও বলেছি। এ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এর মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির ৩৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মতিপত্র বাতিল করেছেন বলে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে এ সিদ্ধান্তকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আত্মঘাতী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ সিদ্ধান্তে বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। কারণ, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইতোমধ্যে বিনিয়োগকারিরা বিনিয়োগ করেছেন। উপদেষ্টা সৎ উদ্দেশ্যে নতুন করে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের চিন্তা থেকে এগুলো বাতিল করলেও পুনরায় তা চালু করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কমপক্ষে দেড় থেকে দুই বছর সময় লেগে যাবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম পিছিয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অব্যাহত থাকলে, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মতিপত্র অব্যাহত রাখতে অসুবিধা কোথায়? এসব সম্মতিপত্র অব্যাহত রাখা যেতে পারে। হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে এর নেতিবাচক প্রভাব বিনিয়োগকারিদের ওপর পড়বে। তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে। বরং বিদ্যমান ব্যবস্থায় কীভাবে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে উপদেষ্টার মনোযোগ দেয়া জরুরি। সামনে বোরো মৌসুম। এ সময়ে সেচকাজে কৃষকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এছাড়া ব্রয়লার মুরগি, ডিম, হ্যাচারিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকতে হবে। বাজারে ডিম, মুরগিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিদ্যুৎসংকট অন্যতম কারণ হয়ে রয়েছে। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট শিল্পকারখানাগুলো অর্থনীতির বড় একটি শক্তি হিসেবে রয়েছে। কৃষি ও গ্রামীণ শিল্পের উৎপাদন যেকোনো মূল্যে সচল রাখতে হবে। বিদ্যুতের অভাবে এসব কারখানার উৎপাদন ব্যহত হলে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারন করবে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, বেকারত্ব বাড়বে। বড় বড় শিল্পকারখানার উৎপাদনও ব্যহত হবে। উৎপাদন অব্যাহত রাখতে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে, এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। চার-পাঁচ মাস পর রোজা শুরু হবে। সেসময় বিদ্যুৎ চাহিদা বেশি থাকে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে জনঅসন্তোষ বৃদ্ধি পাবে। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের বদনাম হবে। শুধু তাই নয়, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারিদের আকৃষ্ট করতে হলে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সংকট তীব্র থাকলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের দেশে পশ্চিমা দেশগুলোর যেমন বিনিয়োগ ও ব্যবসা রয়েছে, তেমনি বড় বিনিয়োগ ও অংশীদার হিসেবে চীনও রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে কয়েকটি সোলার প্যানেল স্থাপন করার জন্য চীনের কাছে অনুরোধ করেছেন। এজন্য উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সম্মতিপত্র বাতিল এক্ষেত্রে ভিন্ন বার্তা দিতে পারে বৈকি! ভূ-রাজনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব চীনের আধিপত্য ঠেকাতে চাইবে। আবার চীনও পশ্চিমাদের ঠেকাতে চাইবে। তাদের মধ্যে লড়াই চলছে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষ চীন-রাশিয়া ব্রিকসের জন্ম দিয়েছে। এ সংস্থার পরিধি ও প্রভাব রয়েছে। এমন বাস্তবতায়, পশ্চিমা বিশ্বকে যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি চীনকেও প্রয়োজন। উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে তাদের সাথে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে, যাতে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়া যায়। ইতোমধ্যে, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ‘প্রকল্প বিলাস’ হিসেবে উপদেষ্টা আখ্যায়িত করায় জাপান অসন্তুষ্ট হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, অতিরিক্ত দামে আদানি থেকে বিদ্যুৎ কেনা অব্যহত রাখা ও এন্তার দুর্নীতি সত্ত্বেও রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি অব্যাহত রাখা যায়, তাহলে ৩৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মতিপত্র রাখা যাবে না কেন?
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে দুই মাস অতিক্রম হয়ে গেলেও এ খাতে তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা দীর্ঘমেয়াদি। এসব উদ্যোগ ভালো হলেও তা অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তাঁর এ সময়ের দায়িত্ব হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় কীভাবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দেয়া। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা যেতে পারে, তবে তার বাস্তবায়ন নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেয়া ভালো। কীভাবে কৃষি, পোলট্রি, খামারসহ গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখা যায়, তা নিশ্চিত করা। আমাদের এখন সবুজ বিপ্লব ও গ্রামীণ উৎপাদনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়অ প্রয়োজন, যাতে দারিদ্র্য কমে, মূল্যস্ফীতি কমে, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সহনীয় হয়। খবরে প্রকাশ, কিউবায় মারাত্মক বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুতের অভাবে জীবন ও উৎপাদন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরকম পরিস্থিতি যাতে আমাদের দেশে না হয়, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। উপদেষ্টাকে মনে রাখতে হবে, পতিত স্বৈরাচার হাসিনার দোসররা বিদ্যুৎ খাতে অচলাবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালু রেখেছে। এমন কিছু করা যাবে না, যাতে তাদের নীলনকশা বাস্তবায়ন সহজতর হয়ে যায়। বিদ্যুৎখাতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া দোসরদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা অতিক্রম করে জরুরি পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতেহবে। এখানে প্রকল্প বাতিল বা নতুন উদ্যোগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিমলায় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার
ফায়ার ফাইটার নয়নের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া
কচুয়ার একাধিক মামলার আসামি বাবু দুমকীতে গ্রেফতার
পূর্বাচলের সরকারি প্লটে অনিয়ম: হাসিনা-রেহানার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
ধামরাইয়ে ২ সন্তানের জননীর আত্মহত্যা স্বামী আটক
দৌলতদিয়ায় বয়স্ক যৌনকর্মীদের শীতবস্ত্র ও শিশুদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ
যারা নির্বাচনকে বিতর্কিত করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত: বদিউল আলম
নাচোল পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মুসা মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত
কুষ্টিয়ায় দরজা ভেঙে নারী পুলিশ সদস্যের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
হাজীগঞ্জে ৩৫ একর কৃষি জমিতে পানিবদ্ধতা
টাঙ্গাইলে টুকুর পক্ষ থেকে সুবিধাবঞ্চিত গরীব অসহায়দের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ
ফায়ারফাইটার নিহতের ঘটনায় যা বললেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব
বোয়ালমারীতে পর্ণোগ্রাফির চক্রের ২ সদস্য আটক, প্রায় বারো লাখ টাকা খোয়ালেন প্রবাসীর স্ত্রী
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নিখোঁজের একদিন পর বৃদ্ধের মরদেহ মিলল পুকুরে
চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়কে ৫ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ
বুধবার রাতে সচিব নিবাসেও আগুন লেগেছিল
শৈলকুপায় নিহতের ঘটনায় অর্ধশতাধিক বাড়িঘর গুড়িয়ে দিয়েছে দূর্বৃত্তরা
মধ্যরাতে আগুন লেগেছিল সচিব নিবাসেও
গোয়েন্দা সংস্থা একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে : রিজভী
ফুলপুরে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবিতে মানববন্ধন