ঢাকা   মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ১৪ কার্তিক ১৪৩১

সঠিক অবস্থানেই আছে বিএনপি

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা দেশের বিরুদ্ধে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। তাকে অন্ধ সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে সে দেশের মোদি সরকার। হাসিনা-মোদির অপতৎপরতার মূল লক্ষ্য, দেশকে অস্থির-অস্থিতিশীল করা এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়া। পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনা কিছুদিন চুপ ছিলেন। তারপরই উসকানিমূলক কথাবার্তা ও হুমকি-ধামকি দেয়া শুরু করেন, যা এখনো অব্যাহত আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শেখ হাসিনার উসকানিমূলক কথাবার্তা বলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিলেও তিনি এবং তার প্রভূ মোদি তা গ্রাহ্য করেন নি। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার বেশকিছু কলরেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে তার কথোপকথনের বিবরণ রয়েছে এসব কলে। তা অধিকাংশই হুমকিযুক্ত, উসকানিপূর্ণ। ‘দেখে নেবো, ‘কাউকে ছাড় দেবো না,’ ‘শিগরিই আসছি’, ‘বিএনপি-জামায়াত নেতাদের তালিকা করো’, ‘তাদের ঘর-বাড়ি থাকে কী করে’, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে ড. ইউনূসের সরকার থাকবে না’ ইত্যাদি ধরনের কথাবার্তা রয়েছে ওইসব কলে। সর্বশেষ ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) এক খবরে জানা গেছে, শেখ হাসিনা দেশে অস্থিরতা ও অরাজকতা সৃষ্টির এক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। ভোয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের এক মধ্যম সারির নেতা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে রাজপথে উত্তেজনা সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়েছেন। বলাবাহুল্য, তার আলামত আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পেয়েছি। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার আগে চট্টগ্রামে সশস্ত্র মিছিল করেছে। অন্য কয়েকটি স্থানেও সন্ত্রাস করেছে। নিষিদ্ধের পরেও কয়েকটি স্থানে মিছিল করেছে ও মহড়া দিয়েছে। সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা যে সঠিক হয়েছে, সেটা এই প্রেক্ষিতে বলাইবাহুল্য। আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য লীগও খোড়ল থেকে মুখ বের করতে শুরু করেছে। নানক, হানিফরাও হুমকির ভাষায় কথা বলছেন। ওদিকে বরাবর ব্যর্থ হওয়ার পরও হাসিনা-মোদি সংখ্যালঘু কার্ড খেলা থেকে বিরত হননি। চট্টগ্রামে ‘বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ’ নামে একটি ভূঁইফোড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। সংগঠনটি হুমকি দিয়েছে ঢাকামুখী লং মার্চ করবে। সংখ্যালঘু কার্ডটি মোক্ষম বলে ধারণা করা হলেও অন্যায্য ব্যবহারে তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে আগেই। তা সত্ত্বেও খেলা বন্ধ হয়নি।

পতিত স্বৈরাচার ও মোদি সরকারের যৌথ প্রযোজনায় চক্রান্ত-যড়যন্ত্র যখন অব্যাহত আছে এবং দিন দিন বাড়ছে, তখন জাতীয় ঐক্য ও ঐক্যবন্ধ উদ্যোগ ও পদক্ষেপের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটার আশাঙ্কা দেখা দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য ও সংহতি লক্ষ করা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তাতে চিড় ধরেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গেও কোনো কোনো ইস্যুতে তাদের মতভিন্নতা লক্ষ করা যাচ্ছে। গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের পরে বড় দাগে বিরোধ বা মতপার্থক্য দেখা দিলে গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য ব্যাহত এমনকি ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হওয়ার আশাঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে সকল পক্ষের সতর্কতা অবলম্বন ও দূরদর্শিতা প্রদর্শন করা আবশ্যক। কোনো একটি ইস্যুতে সকল পক্ষ একমত হবে। এটা আশা করা যায় না। তবে খেয়াল রাখতে হবে, মতান্তর যেন মনান্তরে পরিণত না হয়। প্রেসিডেন্টের অপসারণ বা পদত্যাগের বিষয়ে একটা দ্বিধা-বিভক্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর হওয়ায় তার পদত্যাগ বা অপসারণের দাবি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই পদত্যাগ বা অপসারণে অনিবার্য সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহ, এমন কি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও বিষয়টি আমলে নেয়ার জোর প্রয়োজন দেখায়নি। প্রেসিডেন্টের থাকা না থাকায় আগামীর ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে প্রেসিডেন্টের দেয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তার পদত্যাগ বা অপসারণ ইস্যু হিসেবে সামনে চলে এসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সদ্যজাত নাগরিক কমিটি ইত্যাদি প্রেসিডেন্টের অপসারণ বা পদত্যাগ দাবিতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল তাদের সমর্থন করেছে। পক্ষান্তরে বিএনপি ও বিএনপিসমর্থক ১২ দল ইত্যাদি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে বা অপসারিত হলে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে। নতুন করে দেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারবিরোধী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন বাংলাদেশ গঠন, রাষ্ট্রসংস্কার এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনতার সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে।

প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ বা অপসারণে অন্তর্বর্তী সরকার দ্বিমত পোষণ করে না। তবে এখনই তা চায় না। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্তই সে নিতে চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা নাগরিক কমিটিও তাদের কঠোর অবস্থান ছেড়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর এখন ভরসা করছে। তারা এর মধ্যে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে। কিন্তু বিএনপি এ মুহূর্তে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ বা অপসারণে সম্মতি দেয়নি। দলের তরফ থেকে সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ফ্যাসিবাদের প্রডাক্ট হলেও সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করা যাবে না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ মুহূর্তে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়, এমন কোনো হঠকারি সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। বিএনপির সর্বোচ্চ ফোরামে এ নিয়ে আলোচনা হবে। কোনো রকম হঠকারি সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা যায়, বিএনপি প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ বা অপসারণে রাজি হবে না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে সঠিক অবস্থানেই রয়েছে বলে মনে করে পর্যবেক্ষক মহল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ সংস্কার ও নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বও এটি চায়। তারাও বলছে দ্রুত সংস্কার এবং যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন। এটা হলে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি ও নানা ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারের আশঙ্কা দূর হবে এবং ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন তরান্বিত হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা তার সমন্বয়কদের অভিমতের সঙ্গে বিরোধ নেই কারো। তবে তাদের বাস্তবতাটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। সংকট সৃষ্টি করা নয়, বরং সংকট যাতে সৃষ্টি না হয়, সেটা করাই শুভবুদ্ধির দাবি। আমরা আশা করবো, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ বা অপসারণ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যভিত্তিক সিদ্ধান্তই নেয়া হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মাদক থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে কোরআন ও হাদিসের সঠিক শিক্ষা সন্তানদের দিতে হবে -ধর্ম উপদেষ্টা

মাদক থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে কোরআন ও হাদিসের সঠিক শিক্ষা সন্তানদের দিতে হবে -ধর্ম উপদেষ্টা

উৎপাদনে ২১১৩ পোশাক কারখানা, বন্ধ ৬টি

উৎপাদনে ২১১৩ পোশাক কারখানা, বন্ধ ৬টি

হাবের বার্ষিক সাধারণ সভা চেম্বারকোর্টে স্থগিত

হাবের বার্ষিক সাধারণ সভা চেম্বারকোর্টে স্থগিত

লগি বৈঠার তান্ডবকারীদের বিচার দাবীতে পঞ্চগড়ে গণ অবস্থান

লগি বৈঠার তান্ডবকারীদের বিচার দাবীতে পঞ্চগড়ে গণ অবস্থান

বিশেষ অভিযান জোরদার করার নির্দেশ আইজিপির

বিশেষ অভিযান জোরদার করার নির্দেশ আইজিপির

‘সংবিধানের দোহাই দিয়ে অযথা সময়ক্ষেপন করবেন না'

‘সংবিধানের দোহাই দিয়ে অযথা সময়ক্ষেপন করবেন না'

জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও বাংলাদেশ

জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও বাংলাদেশ

বগুড়ায় সাবেক এমপি রিপুর দেহরক্ষী নিঝুম জনতার হাতে আটক।। পরে পুলিশে সোপর্দ

বগুড়ায় সাবেক এমপি রিপুর দেহরক্ষী নিঝুম জনতার হাতে আটক।। পরে পুলিশে সোপর্দ

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারি কারিকুলামে ইসলামী শিক্ষা

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারি কারিকুলামে ইসলামী শিক্ষা

প্রকাশ্যে এলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির

প্রকাশ্যে এলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির

ইসরাইলে ট্রাক হামলায় হতাহত ৪১

ইসরাইলে ট্রাক হামলায় হতাহত ৪১

সুদানে আবারো আধাসামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত ১২০

সুদানে আবারো আধাসামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত ১২০

ধিক্কারের মুখে বক্তৃতা থামাতে বাধ্য হলেন নেতানিয়াহু

ধিক্কারের মুখে বক্তৃতা থামাতে বাধ্য হলেন নেতানিয়াহু

আগামী ২ নভেম্বর ঢাকায় আলা হযরত কনফারেন্স

আগামী ২ নভেম্বর ঢাকায় আলা হযরত কনফারেন্স

তাইওয়ানে বিলিয়ন ডলার মূল্যে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি, চীনের হুঁশিয়ারি

তাইওয়ানে বিলিয়ন ডলার মূল্যে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি, চীনের হুঁশিয়ারি

ইউরোপজুড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে মুসলিমরা

ইউরোপজুড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে মুসলিমরা

ড্রোন অনুপ্রবেশের অভিযোগ উ.কোরিয়ার, নিশ্চুপ সিউল

ড্রোন অনুপ্রবেশের অভিযোগ উ.কোরিয়ার, নিশ্চুপ সিউল

নিউ ইয়র্কে ট্রাম্পের সমাবেশে অশোভন ও বর্ণবাদী মন্তব্য

নিউ ইয়র্কে ট্রাম্পের সমাবেশে অশোভন ও বর্ণবাদী মন্তব্য

গণভবন জাদুঘরে ‘আয়নাঘরের রেপ্লিকা’ রাখার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

গণভবন জাদুঘরে ‘আয়নাঘরের রেপ্লিকা’ রাখার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

লালমোহনে ৫২ জেলে আটক। জেল-জরিমানা, জাল-মাছ-ট্রলার জব্দ

লালমোহনে ৫২ জেলে আটক। জেল-জরিমানা, জাল-মাছ-ট্রলার জব্দ