অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস : সাফল্য ও ব্যর্থতা
০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
আজ আন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পূর্ণ হলো। গত ৮ আগস্ট এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা ৩৬ দিন রক্তাক্ত লড়াই করে ৫ আগস্ট পতন ঘটায় এবং নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এই সরকার প্রতিষ্ঠা করতে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করে। বিশ্বে এমন বিপ্লব খুব কমই হয়েছে। এটি এমনই এক বিপ্লব, যেখানে এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীসহ সবশ্রেণীর মানুষ ফ্যাসিস্ট হাসিনাবাহিনীর বুলেট বুক পেতে নিয়েছে। অভ্যুত্থান দমাতে হাসিনাবাহিনী যত গুলি করেছে, ‘বুক পেতেছি, গুলি কর’ বলে হাজার হাজার, লাখ, লাখ মানুষ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। গুলি করতে করতে হাসিনার গুলি শেষ হয়ে গেছে। দেড় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করে ভয়ে জীবন নিয়ে তাকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, এ হত্যার সংখ্যা আরও বেশি। অন্যদিকে চিরতরে পঙ্গু ও অন্ধ হয়েছে বিশ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা। এখনও হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শত শত মানুষ। অনেকে স্ক্রাচে ভর দিয়ে চলছে। আমার পরিচিত এক তরুণ রামপুরায় লড়াইয়ের সময় পুলিশের গুলিতে পায়ে গোড়ালি হারিয়েছে। এখন সে স্ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটে। কখনো দুপায়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা, জানে না। ইতোমধ্যে চিকিৎসা করতে গিয়ে সে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমাদের মনে আছে, পুলিশের গুলিতে এক কিশোরের ডান হাত উড়ে গেছে। হাসপাতালে শুয়ে থেকেই টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল, আমি এক হাত হারিয়েছি, আরেক হাত রয়েছে। প্রয়োজন হলে আবার আরেক হাত নিয়ে নামব। কী দৃপ্ত চেতনা এই কিশোরের মধ্যে! এমন আরও অনেক আহত এমন চেতনা নিয়েই বেঁচে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ছাত্র-জনতার রক্তে রচিত পথে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে এবং তার মেয়াদ তিন মাস পূর্ণ হয়েছে, এ সরকার গণবিপ্লবে শহীদ ও আহতদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পেরেছে কিনা। নিদেনপক্ষে তাদের তালিকা করতে পেরেছে কিনা। অনেকের মতে, সরকার এ কাজটি এখনও পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেনি। এমনকি, অসংখ্য আহতরা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না। অনেকে শরীরে বুলেট নিয়ে যন্ত্রণাদায়ক জীবন কাটাচ্ছে। অনেকে অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না। অথচ এখনও রাজধানীসহ সারাদেশের দেয়ালে দেয়ালে ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী শিহরণ জাগানিয়া বিপ্লবী কথামালা রয়ে গেছে। এক সময় হয়তো দেয়ালের লেখা বৃষ্টিতে মুছে যাবে। দেয়ালের নতুন রংয়ে ঢাকা পড়ে যাবে। ইতোমধ্যে মুছে যেতে শুরু করেছে। শহীদ, আহত এবং বেঁচে থাকা বিপ্লবীদের এই কথামালা মুছে যাওয়ার আগেই তো শহীদ এবং আহতদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসাসহ সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিৎ।
দুই.
ছাত্র-জনতার বিপ্লব দেশে নতুন স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছে। ভেঙে চুরমার করে দেয়া হাসিনার রেখে যাওয়া দেশকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিপ্লবী ছাত্র-জনতার অনেকের মতে, একমাত্র ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া এ সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টার যেভাবে বিপ্লবী চেতনা ধারন করা উচিৎ ছিল, তা ধারন করতে পারেনি। ৮৪ বছরের ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২২ বছরের টগবগে তরুণের চেতনা ধারন করলেও বেশিরভাগ উপদেষ্টার কেউ বয়সের ভারে, নতুবা অন্যকোনো উদ্দেশ্যে তা এড়িয়ে যাচ্ছে। যেভাবে বিপ্লবী হয়ে ওঠার কথা, সেভাবে তারা হয়ে উঠতে পারেনি। এ নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। তবে বাস্তব চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই, অন্তর্বর্তী সরকার এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের কাঠামো বলে কিছু ছিল না। হাসিনার পতন হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার রেখে যাওয়া দোসরে পরিপূর্ণ ছিল এবং এখনো আছে। আর্থিক শূন্যতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাজ শুরু করতে হয়েছে। অর্থাৎ এক ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সরকারকে দাঁড়ানোর ভিত্তি খুঁজতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেই সরকারকে ফেলে দেয়ার জন্য হাসিনা ও তার প্রভু মোদির দোসরদের একের পর এক মারাত্মক ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রশাসনের ভেতরে বাইরের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবেলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে এবং হচ্ছে। শুরুতেই পুলিশের বিদ্রোহ, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিদ্রোহ, জুডিশিয়ারি ক্যু, আনসার বিদ্রোহ, হিন্দুদের উপর নির্যাতনের উসিলায় আন্দোলন, ১৫ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দশ লাখ লোক জড়ো করে অচল করে দেয়ার চক্রান্ত, গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মতো ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের মধ্যে সরকারকে পড়তে হয়েছে। হাসিনা ও মোদির এ ষড়যন্ত্র থেমে নেই। বরং একেকটি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মিসাইল হয়ে সরকারের দিকে ছুটে আসছে। বলা যায়, ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেখে যাওয়া জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে থেকেই সরকারকে এসব ষড়ন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলা করতে হয়েছে ও হচ্ছে, যা অরাজনৈতিক তো বটেই যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের জন্যও অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের বিষয়। অন্তর্বর্তী সরকারের ভিত্তিটি ছিল ছাত্র-জনতার বিপ্লব। তবে তাকে দাঁড়াতে হয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রায় ১৬ বছরে গড়ে তোলা রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত্তির উপর, যা এক নিমিষে যেকোনো সরকারকে ফেলে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত শক্তিশালী সরকারকেও দুর্বল মনে হওয়া স্বাভাবিক। দানবের ঘরে অতি সাহসী মানুষকেও যেমন অসহায় মনে হয়, তেমন। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো সাহসী মানুষকেই হাসিনার গড়ে তোলা দানব প্রশাসনে ঢুকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এই দানবীয় প্রশাসন স্বল্প সময়ে নির্মূল করা কঠিন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, অন্তর্বর্তী সরকার বিপ্লবী হয়ে উঠতে পারেনি। যারা এটা মনে করেন, তাদেরকে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নেয়া উচিৎ। এটা বিবেচনায় নিতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারকে বাঘের পিঠে চড়ে বসতে হয়েছে, তাকে পোষ মানানোর কাজটি সহজ নয়। পোষ মানাতে সময় লাগে। অন্তর্বর্তী সরকার তার তিন মাসে এই পোষ মানানোর কাজ করেছে। পুরোপুরি করতে পেরেছে, তা বলা যায় না। আরও সময় লাগবে। কারণ, প্রশাসনসহ সর্বত্র ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার প্রেতাত্মারা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তারা হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার অপচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তারা আশাবাদী হাসিনাকে তারা ফিরিয়ে আনতে পারবে। শেখ হাসিনা যে বলেছেন, যেকোনো সময় চট করে ঢুকে পড়বেন, কিংবা ডিসেম্বরের মধ্যে এ সরকারের অবস্থা কী হয়, দেখবা বলে তার নেতাকর্মীদের ফোনে বলেন, তা বলার সাহস পান ঘাপটি মেরে থাকা তার দোসরদের কারণে। কারণ, সে কোনো শান্ত-শিষ্ট দানব নয়, ভয়ংকর দানব। তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে যে ২২৭ জন হত্যা মামলা করেছেন, তাদের একজনকে হত্যা করার শাস্তি যা, ২২৭ জনকেও হত্যা করার শাস্তি তা। ফলে দেশের সর্বত্র ঘাপটি মেরে থাকা এই ভয়ংকর দানবের চেলা-চামু-ারা যে সক্রিয়, তাতে সন্দেহ নেই। তিন মাসে দানবের এই আস্তানা গুঁড়িয়ে দানবমুক্ত করা সহজ কাজ নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশকে এই দানবমুক্ত করার কাজ করছেন। এতে আরও সময় লাগবে। এজন্য, সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র-জনতার সহায়তা প্রয়োজন। তাকে আগলে রাখতে হবে, যতক্ষণ না হাসিনা শাসনের চিহ্ন উচ্ছেদ না হয়। মনে রাখা দরকার, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে দেশ ও জনগণ আবার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদেরও গণবিপ্লব কেন ও কি কারণে হয়েছে, তা অনুধাবন করে বিপ্লবের চেতনা ধারন করতে হবে। তাদের এটা মনে করার কারণ নেই, ছাত্র-জনতা তাদেরকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের মতো ক্ষমতায় বসিয়ে আরাম-আয়েশে ক্ষমতা উপভোগ ও শাসন করতে দিয়েছে। তাদেরকে ছাত্র-জনতার মূল অনুরণন ধারন করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো এমন একজন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যিনি একাই একশ’ হয়ে আছেন। অন্যদিকে, ছাত্র-জনতার অন্যতম প্রধান নেতৃত্বদানকারি হিসেবে রয়েছেন, তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মাহফুজ আলম। তারা গণবিপ্লবের প্রতীক হিসেবে সরকারে আছেন। তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে, উপদেষ্টা পরিষদকে বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত করা।
তিন.
অন্তর্বর্তী সরকারকে তার তিন মাস মেয়াদে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার প্রভু মোদির ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলার পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের কাজ শুরু করেছে। জনপ্রশাসন, পুলিশ, আদালত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সংবিধানকে হাসিনা যেভাবে ফ্যাসিবাদে পরিণত করেছিল তা সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশন কাজ করছে এবং দ্রুতই তারা তা শেষ করে প্রস্তাব পেশ করবে। রাষ্ট্র কাঠামোর এই মৌলিক সংস্কার সবার আগে জরুরি। তা নাহলে, ফ্যাসিজমের বীজ থেকে যাবে এবং পুনরায় জন্ম লাভ করবে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি অবশ্যই অন্যতম জনপ্রত্যাশা ও বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়নের একটি দিক। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার না হলে, গণবিপ্লব ব্যর্থ হিসেবে পরিগণিত হবে। অন্যদিকে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিশ্বজুড়ে তার খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, জার্মানি, চীন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো ফোকলা হয়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনে যেভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে এগিয়ে এসেছে, তাতে আশার সঞ্চার হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে, শুধুমাত্র ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারণে। তবে এই বিপুল অর্থ যেভাবে দ্রুত আসার কথা, সেভাবে আসছে না। এজন্য উপদেষ্টা পরিষদকে নিজ উদ্যোগে তা আনার তাকিদ ও সবধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তা নাহলে, খুঁড়িয়ে চলা অর্থনীতি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এই সরকার যদি মনে করে, সে আরও সময় নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজ করবে, তাহলে তাকে সবার আগে অর্থনীতিকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গণের প্রতিশ্রুত অর্থ আনার ব্যবস্থাসহ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এতে চাকরির বাজার চাঙা হবে। মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর হাসিনার লুটপাটে ধ্বংস হওয়া ব্যাংক খাত সংস্কার করে সুশৃঙ্খল অবস্থায় আনতে পেরেছেন। অন্যদিকে, ভারত হাসিনাকে দিয়ে যেভাবে বাংলাদেশকে তার করদরাজ্যে পরিণত করেছিল, সে অবস্থা থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে বের করে আনতে পেরেছে। এটা এ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য। অন্যান্য দেশের সাথে সম্মানজনক অবস্থানের মাধ্যমে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অসামান্য গ্রহণযোগ্যতার কারণে। অবশ্য এই তিন মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে আইন, বিচার, সংসদ বিষয়ক এবং জনপ্রশাসন উপদেষ্টার কিছু কর্মকা-ে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। জনপ্রশাসন ও আদালতকে তারা হাসিনার দোসরমুক্ত করার কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেনি বলে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে তাদের ঢিমেতালে কাজ সচেতন মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কাজটি কঠিন হলেও যে গতিতে করা উচিৎ ছিল, তা তারা করতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের এমন শৈথিল্য বিপ্লবের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তিন মাসে তাদের কাজের হিসাব করলে বলা যায়, এ কাজ এখনো গতি লাভ করেনি। দানবে পরিণত করা পুলিশ বাহিনীও ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ট্রমা কাটিয়ে পুরোপুরি সক্রিয় হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের ভূমিকায় গতি লাভ করেনি। যদিও এ খাতে সংস্কার চলছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এবং দ্রুতই দায়িত্ব পালনে পুর্নোদ্যমে ফিরবে। বলা বাহুল্য, হাসিনার দীর্ঘদিনের ফ্যাসিজমে জনপ্রশাসন, পুলিশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যেভাবে ফ্যাসিস্টের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল, তা রাতারাতি গড়ে তোলা কঠিন। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানে থেকে যাওয়া হাসিনার দোসররা এখন কৌশল বদলে বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে পরিচিত হওয়া শুরু করেছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফ্যাসিজমমুক্তকরণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
চার.
তিন মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের যেমন ব্যর্থতা রয়েছে, তেমনি সাফল্যও আছে। তবে যে ব্যর্থতা অমার্জনীয় হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে, নিত্যপণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে না পারা। হাসিনার আমলে মানুষের জীবনযাপন যে কষ্টের মধ্যে ছিল, এখনও সেই অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে। স্বস্তির মধ্যে থেকে দুবেলা খাওয়ার মতো সুবিধা করে দিতে পারেনি সরকার। যদিও সরকার আমদানি করা খাদ্যপণ্যের উপর থেকে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার, টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করেছে, তারপরও নিত্যপণ্যের দাম কমেনি। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির জন্য দায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে নির্মূলের কথা বললেও কাজ হচ্ছে না। জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, ভয়াবহ বন্যা, ঝড়-বৃষ্টির কারণে কৃষিপণ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এটিও অন্যতম কারণ। তবে কারণ যাই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে এবং যেভাবেই হোক তা নিয়ন্ত্রণ করবে। এ কাজটি সরকার করতে পারেনি। ফলে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও অসন্তোষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বের যেকোনো দেশের সরকারের সাফল্য নির্ভর করে ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার উপর। আর আমাদের দেশে সরকারের মূল সাফল্যের মাপকাঠি হচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম তাদের সাধ্যের মধ্যে রাখা। তারা দুবেলা পেটভরে খেতে পারলেই সরকারের উপর সন্তুষ্ট ও সমর্থন অব্যহত রাখে। এখানে উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণ করতে জো বাইডেনের নিজ উদ্যোগের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যুদ্ধের কারণে দেশিটিতে জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে তিন ডলার থেকে পাঁচ ডলারে উঠে যায়। এতে চরম জনঅসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়। জো বাইডেন সব কাজ ফেলে সউদী আরবের সাথে শীতল সম্পর্ক উপেক্ষা করে সফর করে প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের সাথে দেখা করেন। সে সময় তার সফর করতে দেরি, দেশে তেলের দাম কমতে দেরি হয়নি। সউদী আরবের মাটিতে পা রাখার আগেই তেলের দাম পাঁচ ডলার থেকে কমে চার ডলারে নেমে আসে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে আগের দামে চলে আসে। এই উদাহরণ দেয়ার কারণ হচ্ছে, সরকার প্রধান হিসেবে জো বাইডেন সবার আগে জনগণের অসন্তুষ্টি দূর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। জনগণের স্বার্থে এবং স্বাচ্ছন্দ জীবন নিশ্চিত করতে সরকার প্রধানকে এমনই হতে হয়। আমাদের দেশে ঘটে উল্টো ঘটনা। জিনিসপত্রের দাম কমানোর যত ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার, তা না নিয়ে জনগণের সামনে নানা অজুহাত তুলে ধরে। অন্তর্বর্তী সরকার এ ধরনের কোনো অজুহাত না দেখালেও জিনিসপত্রের দাম কমাতে যত ধরনের উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল, তা নিতে পারেনি। এটা সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়ে রয়েছে। সরকারকে তার বিপুল জনসমর্থন ধরে রাখতে অবিলম্বে যেকোনো উপায়ে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের স্বস্তির মধ্যে রাখতে হবে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, তার আচার-আচরণ যেমনই হোক, সে গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে। কাজেই, এই বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাকে ধারন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মেরিটাইম সেক্টরে বিদেশীদের বিনিয়োগের আহবান উপদেষ্টার
সাঁতারে আক্ষেপের নাম ‘ইলেক্ট্রোনিক্স স্কোরবোর্ড’!
সাবিনাদের জন্য শনিবার পুরস্কার ঘোষণা করবে বাফুফে
ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-২ আহত-৩
সর্বনি¤œ হজ প্যাকেজ ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা ঘোষণা
যশোরে মাদক ব্যবসায়ীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
৭ নভেম্বরের চেতনাকে যারা ধারণ করে না, তারা গণতন্ত্রের শত্রু - ডা.মাজহার
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার ২ সেকেন্ডের মধ্যেই কার চাকরি খাবেন ট্রাম্প?
ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস; চব্বিশের প্রেরণা
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে জাগপার আলোচনা সভা
মানুষের মতোই কথা বলবে, আচরণ করবে এআই!
আখাউড়া প্রেসক্লাবের নতুন কমিটি গঠন
পরিবহনব্যবস্থা
রমজানের নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকে লাগবে না নগদ অর্থ: গভর্নর
ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন
৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন
জাইকার সহযোগিতায় রাজউকের তৃতীয় ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট সেমিনার অনুষ্ঠিত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলতত্ত্ব ও আমাদের সাহিত্য সমাজ
সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ