সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পতন
১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পতন ঘটেছে। তিনি পালিয়ে রাশিয়ায় চলে গেছেন। রাশিয়া তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। দীর্ঘ ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের আপাত অবসান ঘটেছে বিদ্রোহীদের ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল শাম (এইচটিএস)। এইচটিএসের প্রধান নেতা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি। তিনি খোলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) এর বংশধর বলে জানা গেছে। এও জানা গেছে, দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর এই বড় রকমের বিজয় ঘটলো সুন্নিদের। সিরিয়ায় টানা ৫৪ বছর স্বৈরাশাসন চলেছে। একটি পরিবারই মূলত সিরিয়া শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই জালিমশাহীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাফিজ আল আসাদ। তিনি ছিলেন বাম ধারার বাথ পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা। বাথ পার্টি ১৯৬১ সালে সিরিয়ার ক্ষমতায় আসে। দলটির মধ্যে অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৭০ সালে। আর ১৯৭১ সালে ক্ষমতায় আসেন হাফিজ আল আসাদ। আমৃত্যু তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০০ সালে মৃত্যু হলে তার পুত্র বাশার আল আসাদ প্রেসিডেন্ট হন। গত দু’যুগ ধরে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তার পিতার মতই ঘাতক, নির্যাতক, মানবতাবৈরী, একনায়ক ও জালেম হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন। তার পতন ও পলায়নের মধ্য দিয়ে ৫৪ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটলো। বিজয়ী বিদ্রোহীদের মতে, সিরিয়ায় অন্ধকার যুগের ইতি ঘটেছে, নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এইচটিএস ৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে জালিমশাহীর পতনের ঘোষণা দিয়ে বলেছে, জালিমশাসক বাশার আল আসাদ দেশ থেকে পালিয়েছেন। সিরিয়া এখন মুক্ত। এর মধ্য দিয়ে একটি অন্ধকার যুগের সমাপ্তি হলো। আর সূচনা হলো একটি নতুন যুগের। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, স্বৈরাচারের বিদায়ে দামেস্কসহ সিরিয়ার সর্বত্র জনগণ রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করেছে। ‘স্বাধীনতা’ ‘স্বাধীনতা’ বলে স্লোগান দিয়েছে। বিদ্রোহীরা বাশার আল আসাদের বাসভবনে ঢুকে ভাংচুর করেছে। বিভিন্ন জায়গায় হাফিজ আল আসাদের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলেছে। বাশার আল আসাদের দুঃশাসনে নিপীড়িত, অত্যাচারিত, পলাতক লোকদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানিয়েছে বিদ্রোহীরা। এই সঙ্গে দামেস্কের সবচেয়ে বড় কারাগার সেদনায়া থেকে কয়েদিদের মুক্ত করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ও সিরিয়ার স্বৈরাচারের বিদায়ের চিত্র ও চরিত্র অনেকক্ষেত্রেই অভিন্ন। বাংলাদেশের স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে একটি বিশেষ বিমানে করে পালিয়ে যান ভারতে। এর ফলে তার সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনের সমাপ্তি ঘটে। বাশার আল আসাদও একটি বিমানে করে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। এতে তার ২৪ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের নায়ক ছাত্র-জনতা শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে প্রবেশ ও ভাংচুর করে। আর একই সঙ্গে শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। বাশার আল আসাদের বাসভবন ও তার পিতা হাফিজ আল আসাদের ভাস্কর্যেরও একই দশা হয়। স্বৈরাচার সব দেশেই গণশত্রু। স্বৈরাচার কবলিত দেশে মানুষের সংগত অধিকার, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, নিরাপত্তাÑ কোনো কিছুই থাকে না। স্বৈরাচার তার ক্ষমতার স্বার্থে খুন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড জেল-জুলুম ইত্যাদি করতে এতটুকু দ্বিধা করে না। সবদেশে সবকালে স্বৈরাচারের একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে স্বৈরশাসনামলে কত মানুষ নিহত হয়েছে, গুম হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। শেষের ২০ দিনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। সিরিয়ায় হাফিজ আল আসাদ ও বাশার আল আসাদের সময়ও সেখানে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জেল-জুলুম ইত্যাদি হয়েছে অবলীলায়। ২০১১ সাল থেকে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে সিরিয়া কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এর অর্থনীতি, অবকাঠামো সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে। অধিকাংশ পরিবার বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। যুদ্ধের আগের ২ কোটি ২০ লাখ অধিবাসীর অর্ধেক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অনেকই পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে, ইউরোপের নানা দেশে আশ্রয় নিয়েছে। একটি সমৃদ্ধ দেশ ও অগ্রসর জাতি এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছে, যা থেকে উত্তরণ ও প্রতিষ্ঠা মোটেই সহজ হবে না। দুঃখের বিষয়, স্বৈরশাসকরা মনে করেন, অনন্তকাল তারা ও তাদের উত্তবাধিকারীরা ক্ষমতায় থাকবেন। সে জন্য তারা সর্ববিধ আয়োজন করেন। কিন্তু সে আয়োজন এক সময় কোনোই কাজে আসে না। মহান আল্লাহর অপছন্দে স্বৈরশাসকদের পতন অনিবার্য। ৪ আগস্ট বাংলাদেশের কেউ জানতো না ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিদায় নেবেন এবং পালিয়ে যাবেন। কিন্তু ৫ আগষ্ট সেই অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটলো, যখন তাকে পালিয়ে যেতে হলো। বাশার আল আসাদও বুঝতে পারেননি, এত তাড়াতাড়ি তাকে পালাতে হবে। সম্মান, ক্ষমতা ও মর্যাদা আল্লাহর অনুগ্রহ, তিনি যাকে ইচ্ছা দিতে পারেন। আবার তিনিই সে সব কেড়ে নিতে পারেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, আল্লাহ যাকে হেয় করেন, কেউ তাকে সম্মানিত করতে পারে না। স্বৈরাচারের পতন অপমান ও অনিশ্চয়তা আল্লাহর এই ঘোষণাই প্রমাণ করে। তার পরও স্বৈরাচাররা কী সাবধান হবে না?
স্বৈরাচারের পতন ও বিদায়ের পর নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রচেষ্টা যেমন চলছে, একইভাবে নতুন সিরিয়া গঠনের কাজও বিজয়ী বিদ্রোহীদেরও করতে হবে। ইতোমধ্যে সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ গাজী আল জালালি বিদ্রোহীদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা প্রস্তুত। সিরিয়ায় বিভিন্ন দল ও পক্ষ রয়েছে। তাদের ঐক্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। কেননা, স্বৈরাচার বশার আল আসাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের অপচেষ্টা হতে পারে। ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হতে পারে নতুন করে ক্ষমতায় বসবে যারা তাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের বিতাড়িত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে যড়যন্ত্র করছেন। তাকে সহযোগিতা করছে দিল্লির মোদি সরকার। রাশিয়া বাশার আল আসাদকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। তার মনোভাব, ভূমিকা ও অবস্থান কী হতে পারে, তা স্পষ্ট হয়নি। বাশার আল আসাদের দুটি খুঁটির একটি রাশিয়া ও অন্যটি ইরান। ইরান নানা জটিলতায় জড়িয়ে গেছে। রাশিয়াও তাই। তারা বাশার আল আসাদকে পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে উদ্যোগী হবে, এটা মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এ বিষয়ক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, রাশিয়া বাশার আল আসাদকে রক্ষায় আগ্রহী না হওয়ায় তার পতন হয়েছে। তারপরও সিরিয়ার নতুন সরকারকে এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ইসলামপন্থি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যেহেতু বিজয়ী হয়েছে, সুতরাং আশা করা যায়, ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান অবলম্বন হবে। গণবান্ধব শাসন, সাম্য, সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হোক সিরিয়ায়, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। এই সঙ্গে উন্নত, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল সিরিয়া আমাদের কাম্য।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ হতে হবে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি - খেলাফত মজলিস
পাহাড় কাটা মনিটরিংয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার : রিজওয়ানা হাসান
মেট্রোরেলের শুক্রবারের সময়সূচি পরিবর্তন
লৌহজংয়ে বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় দোয়া ও শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ
নবাব সলিমুল্লাহ অসংখ্য নেতা তৈরির মৌলিকক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন : বাংলাদেশ মুসলিম লীগ
আগামী সপ্তাহে সুইজারল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
নালিতাবাড়ীতে মোবাইল কোর্টে ৭ ব্যক্তির কারাদন্ড
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে সে জমি খাস হিসেবে রূপান্তর করা হবে : ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন
গণঅভ্যুত্থানের শুধু ঘোষণাপত্র নয়, ১৬ বছরের আন্দোলনের স্বীকৃতি চায় ১২ দলীয় জোট
কর না কমালে সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট দেয়া সম্ভব হবে না : মন্তব্য খাত সংশ্লিষ্টদের
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করলে সে জমি খাস হিসেবে রূপান্তর করা হবে : ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসন
মার্কিন নাগরিক হারুন আসাদ মির্জা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের হোতা
কলাপাড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওয়েল্ডিং ফোরম্যানের রহস্যজনক মৃত্যু
শিক্ষার্থীদের হৈচৈ নিষেধ করায় আটঘরিয়া কলেজ শিক্ষককে মারপিটের অভিযোগ
বগুড়ায় সড়কে কিশোর বাইক চালকের মৃত্যু
যত্রতত্র অনার্স-মাস্টার্স আর খোলা হবে না : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি
সবার মতামতের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র করতে চাই : প্রধান উপদেষ্টা
এখানে কেউ ছোট-বড় নই, সবাই আমরা সমান :-ডা.একেএম মাহবুবুর রহমান
মৌলভীবাজাররে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে করণীয় শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত
টঙ্গীতে কারখানার ঝুট নিয়ে দুই পক্ষে উত্তেজনা পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ মোতায়েন