আওয়ামী লীগ নিজেই রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৮ এএম
চোখ বুজলে মনে হয়, সেদিনের কথা। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের পরিবেশ-পারিপার্শি¦কতা আমার মোটামুটি জানা। মানুষের মনোবল ছিল অটুট; প্রায় সব দল দেশের কল্যাণ ও স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতো। তাই তারা একজোট হয়ে যুদ্ধে নেমেছিল। এটা ছিল সামষ্টিক প্রচেষ্টা। শেখ মুজিব ইচ্ছাকৃতভাবে পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। শেখ মুজিব দেশে ফেরার পর যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ত্যাগ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন; সেজন্য যে স্বাতন্ত্র্য, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যাশা নিয়ে জনসাধারণ স্বাধীনতা অর্জনে প্রাণপণ যুদ্ধে নেমেছিল, জনগোষ্ঠী যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল ও জীবন দিয়েছিল, তিনি দিনে দিনে সব স্বপ্নাবিষ্ট আশা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতি ও বহুত্ববাদী মূল্যবোধ দেশের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতে সাধারণ মানুষের মনেও এ ধারণা পরিষ্কার হয়েছিল যে, স্বাধীনতার নামে ভারত সরকার পাকিস্তানকে নিজস্বার্থে দুভাগ করে দিল। বাংলাদেশ পেল নামমাত্র স্বাধীনতা ও একটা নতুন পতাকা। একটা আশ্রিত রাজ্যের মতো আমরা সবকিছুতে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেলাম। এতে বাংলাদেশ শাসন ভারতের জন্য সহজ হয়ে গেল। ‘বাঘের ভয়ে উঠলাম গাছে, ভূত বলে, পেলাম কাছে’। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে লুটপাট, স¦জনপ্রীতি, সংবিধানের মূল নীতির পরিবর্তন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে দেশকে পরিবর্তন, শিল্পকলকারখানা জাতীয়করণ, একদলীয় বাকশালী শাসন, রক্ষীবাহিনী ও মুজিববাহিনীর প্রকাশ্য অত্যাচারে বিচারবহির্ভূত নির্যাতন, হত্যা ও গুম মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে সুখ-শান্তির আশা ধূলিসাৎ করে দিল। (সে সত্য ইতিহাস লিখে বর্তমান প্রজন্মকে বাস্তবতা অবহিত করার সময় এখন এসেছে)। অবশেষে দেশের অবস্থা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছলে কিছু মধ্যম-পর্যায়ের বিদ্রোহী সামরিক কর্মকর্তার, যারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, হাতে ’৭৫-এ শেখ মুজিবের শাসনের পতন হলো। কারণ, সরকার ভারতের পরামর্শে রক্ষীবাহিনীর সুযোগ-সুবিধা বেশি দিয়ে তাদেরকে বুকে টেনে নিয়েছিল, আর মুক্তিযোদ্ধা সামরিক বাহিনী অবহেলার পাত্র হয়ে ক্রমশ ভেঙে যাবার আতঙ্কে ভুগছিল। অনেক সামরিক অফিসার ও সাধারণ মানুষ শেখ মুজিবের সকল বিষয়ে দেশ পরিচালনায় খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত, অরাজকতা ও ভারতের কাছে নতজানু নীতি মেনে নিতে পারছিলেন না। দেশের মানুষকে ভারতের কাছে জিম্মি করে ফেলেছিলেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিব দেশ পরিচালনায় প্রশাসনিক ব্যর্থতার স¦াক্ষর প্রতিটা পদে পদে রাখছিলেন।
’৭৫ এর অভ্যুত্থানে দেশে বিদ্যমান বাম দলের সমর্থন ছিল। ৭ নভেম্বর পর্যন্ত অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের সময়ে বাম দল প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঘাড়ে চেপে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে সামরিক আইন ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল গঠন করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশকে ইসলামি ধারায় উন্নয়নের পথে পরিচালনা করেন। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য যে, মুজিববাদী কুচক্রীমহল ও তাদের সম্প্রসারণবাদী প্রভূর যোগসাজশে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে জীবন দিতে হয়। এর মধ্যে বিশ্বব্যবস্থা থেকে মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ ও মুজিববাদ ব্যর্থ হয়ে কালের অতলে তলিয়ে যায়। এদেশের বাম ঘরাণার কমরেডদের মধ্যে অনেক বিভাজন ও দলভাগাভাগি হতে আমরা অনেকবার দেখেছি। মুজিববাদের উত্থান ও পতনও শেখ মুজিবের ঘাড়ে বাম কমরেডদের ভূত চেপে বসার কারণেই হয়েছিল। বর্তমানে এদেশ এবং বিশ্বব্যবস্থা থেকে এ মতবাদ বিলীনপ্রায়। এরও যথেষ্ট কারণ আছে; তবুও এদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে এদের একটা জোট এখনও সক্রিয়। কিন্তু কমরেডরা হিউম্যান-সাইকোলজিতে দুর্বল হওয়ায় আজও বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে তাদের বিতাড়িত হবার কারণ, পৃথিবীতে মানুষসৃষ্টির বিজ্ঞানসম্মত বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির নিয়ম বুঝতে অপারগ। তারা মানুষকে ভোগবাদী নিছক একটা বুদ্ধিমান প্রাণি হিসেবেই গণ্য করে। কালের ¯্রােত সদা সামনে প্রবহমান। প্রতিটা প্রাণি ও অস্তিত্ব সময়ের এ ¯্রােতে সন্তরণশীল।
’৯৬ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার দেশ চালনা বুঝে উঠতেই সময় পার হয়ে যায়। তারপর অনেক কৌশলে ভারতের সহযোগিতায় দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। আবার সেই ছদ্ম-একদলীয় শাসন শুরু। দেশের পুরো অর্থনীতি ধ্বংস; নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগকে নিয়ে নিখাদ দলবাজি, গণহত্যা, ভারতীয় বাহিনী দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে দেশচালনা প্রভৃতি পুরোপুরি চলতে থাকে। দুর্নীতি, বিচারহীনতা, নির্যাতন, খুন-গুম, কোষাগার ও ব্যাংক লুটপাট, নিজের ছেলেমেয়ে-আত্মীয়স্বজনসহ দলীয় লোকজনকে অবাধে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থসম্পদ তৈরির সুবিধা করে দেওয়া ও বিদেশে পাচার করতে দেওয়া; প্রভূর দেশের হিন্দুত্ববাদী শাসনের আদলে প্রভূর প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগিতায় এদেশেও অনুরূপ শাসন ও রামরাজত্ব কায়েম, তাদের গোপন বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপে বাংলাদেশি জনগণকে ভোটের অধিকারহীন শাসন দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্রমবর্ধিষ্ণু গতিতে দুর্দ- প্রতাপে চলতে থাকলো। এতে প্রভূও খুব খুশি। শেখ মুজিবের অসমাপ্ত স্বপ্ন শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের হাত দিয়েই প্রভূর মনবাঞ্চা প্রায় পূরণ হবার উপক্রম হলো। শেখ হাসিনা জনসাধারণকে বাদ দিয়ে প্রভূ তোষণে মরিয়া হয়ে উঠলেন। এদেশে গণতন্ত্র থাক বা না-থাক, শিক্ষার মান অধঃপাতে যাক বা অর্থনীতি ধ্বংস হোক, তাতে প্রভূর কোনো যায়-আসে না। সহ্যসীমার বাঁধ যখন ভেঙে পড়ল, প্রকৃতির প্রতিশোধ শুরু হয়ে গেল। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শেখ হাসিনার তক্ত কয়েকদিনের ব্যবধানে ভেসে চলে গেল। শেখ হাসিনা গং অবশেষে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো। এ বিপ্লবে সাথে থেকে সাহায্য করেছে দীর্ঘ বছর ধরে সংগ্রামে লিপ্ত ও অত্যাচারিত-নিষ্পেষিত বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা। শেখ হাসিনা প্রভূর কাছে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। পিছনে ফেলে রেখে গেলেন কমপক্ষে ১৫০০ ছাত্র-জনতার লাশের পাহাড় ও হাজার হাজার মৃতপ্রায় ছাত্র-জনতার আহাজারি।
আওয়ামী লীগের উগ্রবাদী কর্ম ও চিন্তা-চেতনা দেখলে একে কোনো রাজনৈতিক দল বলা যায় না; লুটপাট-সন্ত্রাসী কার্যক্রম, প্রভূর কাছে দেশ লিজ দেওয়া ছাড়া এর মধ্যে রাজনৈতিক কোনো আদর্শ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিশাল ঋণের টাকাসহ সর্বস্ব লুট করে ভিক্ষার ঝুলি এদেশের মানুষের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়েছে। দায় এসে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার ও সাধারণ মানুষের ওপর। যদি কেউ এদেশের মঙ্গল চায়, আওয়ামী লীগ নামে যে এদেশে কোনো দল ছিল, ভুলে যাওয়াই সমীচীন। স্বাধীনতা রক্ষার বিজ্ঞাপনের ধুয়োজারি গেয়ে দেশ লুটপাট ও প্রভূর রামরাজত্ব কায়েম আর কোনোদিনই সম্ভব হবে না।
সম্ভবত ’৯১ অথবা ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরে যাবার পর ক্ষোভের সাথে শেখ হাসিনা প্রকাশ্য বলেছিলেন, ‘এক দিনও সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেবো না’। বর্তমান অবস্থাও তাই। এদেশের যত লক্ষ কোটি টাকা নিজে এবং নিজের লোক দিয়ে আত্মসাৎ করেছে, তার একটা অংশ অন্তর্বর্তী সরকার ও পরবর্তীতে কোনো রাজনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গ্রুপ দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন এবং বিদেশে সরকারের নামে অপপ্রচার চালানোর কাজে লবিস্টদের নিয়োগে নিশ্চিতভাবেই ব্যয় হবে; হিন্দুত্ববাদী ভারতও এদেশ জঙ্গিদের অভয়ারণ্য ও সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচারের মিথ্যা বুলি বিদেশে অপপ্রচার করতে কোনো ত্রুটি করবে না। এতে মুসলিমবিদ্ধেষী মুরব্বিদের সমর্থনও নিশ্চয়ই পাবে। কারণ, ভারত মুসলমানদের বহিরাগত শত্রু বলে আদিকাল থেকে গণ্য করে। তাদের পরীক্ষিত দাস ছাড়া কাউকেই তারা বিশ্বাস করবে না। নামে মুসলমান, বামপন্থী ইসলাম-বিদ্বেষী শক্তিও তাদের সেবাদাস। যে ‘মুসলমান কোপাও’ অভিযানে যোগ দিতে পারে না, সেই জঙ্গি। আমাদের মুসলমান হয়ে জন্ম নেওয়াটাই তাদের চোখে একটা অপরাধ। এসব কঠিন বাস্তবতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও আসন্ন রাজনৈতিক সরকার কতটুকু সজাগ? এতকিছু করার পরও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে বিএনপি-জামায়াত ও অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের স্বপ্নে বিভোর। এটা দেশের জন্য আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতি মানেই নৈরাজ্য-বিভীষিকা-লুটপাট, দেশবিক্রি-গণহত্যা ও মিথ্যাচার; সে অভিজ্ঞতা স্বাধীনতার পরই এদেশপ্রিয় মানুষের অনেক হয়েছে। আবার সাড়ে ১৫ বছর ধরেও প্রমাণিত হলো। সবাইকে মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ নিজেই এদেশে রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে।
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ; প্রেসিডেন্ট, জাতীয় শিক্ষা-সেবা পরিষদ।
web: pathorekhahasnan.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গজারিয়ায় বিএনপি নেতার শীত বস্ত্র বিতরণ
টাঙ্গাইলে মহাসড়কে আন্তঃজেলা ডাকাত দলের ৪ সদস্য গ্রেপ্তার
ভোটার তালিকা হালনাগাদে ইসির প্রস্তুতি
গফরগাঁওয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশু নিহত
দোয়ারাবাজারে স্ত্রীর যৌতুক মামলায় যুবক গ্রেপ্তার
সচিবালয়ে আগুন পরিকল্পিত: প্রকৌশলী ইকরামুল খান
সেন্ট মার্টিন থেকে ফেরার পথে আটকা পড়েছেন ৭১ পর্যটক
জকিগঞ্জে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় এক যুবকের মৃত্যু
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতির লক্ষে ইসিফোরজে’র প্রি-ওয়ার্কশপ
উচ্চ পর্যায়ের নতুন কমিটি গঠন, ৩ কর্মদিবসে প্রাথমিক প্রতিবেদন
ব্রাহ্মণপাড়ায় ছুরিকাঘাতে এক যুবককে হত্যা
কালীগঞ্জে পুকুর থেকে ২ শিশুর লাশ উদ্ধার
নিবন্ধন চূড়ান্ত: হজযাত্রী ৮৩ হাজার ২৪২ জন
হল্যান্ডের পেনাল্টি মিস,বিবর্ণ সিটি ফের হারাল পয়েন্ট
শরীফ থেকে শরীফার গল্প বাতিল করতে হবে: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
বিসিএ নির্বাচন সম্পন্ন: মিজান সভাপতি, মতিন সম্পাদক
ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৫৩
বিএনপি মুক্ত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী: শাহজাহান চৌধুরী
সচিবালয়ে আগুন: গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাকে দায়ী করলো এবি পার্টি
পরকীয়া প্রেমের ঘটনায় গৌরনদীতে উপ-সহকারী ২ কৃষি কর্মকর্তা এলাকাবাসীর হাতে আটক