গুমের বিচার দ্রুতায়িত করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ এএম | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ এএম

পতিত ও বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গুম, খুন, অপহরণ, তুলে নেয়া ইত্যাদি ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। সাড়ে ১৫ বছর কত মানুষকে যে অপহরণ ও তুলে ধরা হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনো হয়নি। স্বৈরাচার হাসিনা গোটা দেশে ভীতি ও আতংকের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সরকারের সমালোচক, ভিন্ন মতালম্বী ও ভারতবিরোধীদেরই টার্গেট করা হতো। তাদের সাধারণত রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে গুম অথবা খুন করা হতো। কারো কারো অকথ্য নির্যাতনের পর রাস্তাঘাটে ছেড়ে দেয়া বা ফেলে দেয়া হতো। তারা ঘরে ফিরে নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। আবার গুমের ভয়ে তারা কিছু বলতেন না। গুমের শিকার ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন সরকারের কাছে লাগাতার আবেদ-নিবেদন জানিয়েও ফল পেতেন না। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পালিয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকার গণদাবি অনুযায়ী গুম সংক্রান্ত কমিশন গঠন করে। ২৭ আগস্ট মইনুল হোসেন চৌধুরীকে প্রধান করে এ কমিশন গঠিত হয়। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত গুমের ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয় কমিশনকে। কমিশন গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন তুলে দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের প্রকাশযোগ্য অংশ গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। প্রতিবেদনের সরবরাহকৃত অংশের ভিত্তিতে পত্রপত্রিকায় যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তা একইসঙ্গে অচিন্তনীয় ও লোমহর্ষক। শেখ হাসিনা কত নিকৃষ্টতম স্বৈরাচার ছিলেন, প্রতিবেদন সূত্রে সেটা জানা গেছে। কমিশন বলেছে, সাড়ে ১৫ বছর ধরে গুমের নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা স্বয়ং। তথ্যমতে, শেখ হাসিনা ছাড়াও গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান, পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। চরম মানবাধিকারবিরোধী গুম-খুনের সঙ্গে সরকার প্রধান, তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, সামরিক বাহিনী ও পুলিশের উচ্চ পদাধিকারীদের সম্পৃক্ততার কথাই প্রতিবেদনে উঠে আসেনি, একইসঙ্গে ভারতীয়দের সংশ্লিষ্টতার কথাও উল্লেখিত হয়েছে। কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় যুক্ত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বয়ানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। স্মরণযোগ্য, গুম হয়ে যাওয়া একাধিক ব্যক্তির ভারতে সন্ধান মিলেছে, যার একজন হলেন বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ। ভারতীয়রা সংযুক্ত না থাকলে এটা কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়। ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য স্বৈরাচারের যাবতীয় অপকর্ম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে ভারতের মোদি সরকারের জড়িত থাকার বিষয় এখন সর্বজন বিদিত।

সাড়ে ১৫ বছরে যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের পক্ষে প্রতিবেদন জমা দেয়া পর্যন্ত কমিশনে জমা পড়েছে ১৬৭৬টি অভিযোগ। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই হয়েছে ৭৫৮টি। দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ ভুক্তভোগী ফিরে এসেছে। বাকী ২৭ শতাংশ (অন্তত ২০৪ জন) নিখোঁজ রয়েছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে গড়ে ওঠা ‘মায়ের ডাক’-এর হিসাবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গুম হওয়া ১৫৫ জনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম প্রমুখ নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন। কমিশনের তথ্যমতে, র‌্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি, সিটিটিসি, সিআইডি, পুলিশ প্রভৃতি সংস্থা গুমের সঙ্গে জড়িত। কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছেন, যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়। বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করেছে। গুমকারীরা গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ওপর কী ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতন করেছেন, তার বিবরণ পড়লে রক্ত হিম হয়ে যায়। অত্যাচার-নির্যাতনের কয়েকটি নজির তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে গিয়ে কোনোরূপ অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই ঠোঁট সেলাই করে দেয়া হয়েছে। এক ব্যক্তির যৌনাঙ্গে ও কানে ইলেট্রনিক শক দেয়া হয়েছে। এক ব্যক্তি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে তাকে উদ্ধার করে হত্যা করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর সিমেন্টের বস্তার সঙ্গে বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। কখনো লাশ ফেলা হয়েছে চলন্ত ট্রেনের নিচে, কখনো জীবিতকে ফেলা হয়েছে চলন্ত গাড়ির নিচে। এমন নৃশংসতা, এমন বর্বরতা অকল্পনীয়। সেই রাজা-বাদশাহদের আমলে কোনো কোনো রাজা বা বাদশাহর বিভিন্ন নিষ্ঠুরতার বিবরণ পাওয়া যায়। শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতা সেই নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি নিজেকে রাজা-বাদশাহই মনে করতেন। তার কথাই ছিল আইন। এমনও শোনা যায়, হত্যা-নির্যাতনে তিনি উল্লসিত হতেন, অনন্দ লাভ করতেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তিনি গণহত্যা চালিয়েছেন। আরো হত্যাকা-ে নির্দেশ দিয়েছেন। ক্ষমতা টিকেয়ে রাখা ও তা প্রলম্বিত করার জন্য তিনি এমন অপকর্ম-অপরাধ নেই, যা করেননি।

গুম-খুনের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার এবং এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো বিকল্প নেই। গুম সংক্রান্ত কমিশন গুম-খুনের একটা বস্তনিষ্ট প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিশনের প্রধান জানিয়েছেন, আগামী বছর মার্চে আরো একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবে কমিশন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে আরো এক বছর লাগবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। আশা করা যায়, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গুমবিষয়ক সব কিছু অর্থাৎ কারা নির্দেশদাতা, কারা নির্দেশ বাস্তবায়নকারী এবং ভারত কীভাবে ও কতটা জড়িত বিশদভাবে জানা যাবে। আয়নাঘরের বিষয়টাও গুমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আয়নাঘর কোথায় কোথায় ছিল, তার সব জানা যায়নি। জনশ্রুতি এই যে, আয়নাঘর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছিল। যার সব বের করা সম্ভব হয়নি। কমিশনকে সব খুঁজে বের করতে হবে। এখনো আয়নাঘরে কেউ আছেন কিনা দেখতে হবে। গুম-খুনের বিচারের প্রক্রিয়াও দ্রুত শুরু করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গুমের বিচার করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এটা অবশ্যই সুখবর। সবাই আশা করছেন, আইসিটির বিচার হবে স্বচ্ছ ও পক্ষপাতহীন। আন্তর্জাতিক দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে এ বিচারের প্রতি। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের যারা জীবিত আছেন, অবর্ণনীয় নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন তারা এবং যারা নিহত ও নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের আত্মীয়-স্বজনরা যাতে ন্যায়বিচার পান তা নিশ্চিত করতে হবে যেকোনো মূল্যে এবং দ্রুততম সময়ে।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ হোক
জিয়া : স্বাধীনতার ঘোষক
আমাদের পথ
পাহাড়িদের নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে
স্মার্টফোনের দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায়
আরও

আরও পড়ুন

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর হাতে উপহার ও সনদ তুলে দিলেন অতিথিরা

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর হাতে উপহার ও সনদ তুলে দিলেন অতিথিরা

মেহেরপুরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী পালন

মেহেরপুরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী পালন

ঝিকরগাছায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী পালিত

ঝিকরগাছায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী পালিত

শহীদ জিয়াউর রহমানের ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‍্যালি

শহীদ জিয়াউর রহমানের ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‍্যালি

চার দিনের সফরে সোমবার সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

চার দিনের সফরে সোমবার সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

ভারতে ৫ বছর সাজাভোগ করে দেশে ফিরলেন স্বামী-স্ত্রী

ভারতে ৫ বছর সাজাভোগ করে দেশে ফিরলেন স্বামী-স্ত্রী

নরসিংদীতে নিখোঁজের ৫ দিন পর নদীতে পাওয়া গেল স্কুল ছাত্রের লাশ

নরসিংদীতে নিখোঁজের ৫ দিন পর নদীতে পাওয়া গেল স্কুল ছাত্রের লাশ

কয়েক মিনিটে বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারে ভারত: শুভেন্দু অধিকারী

কয়েক মিনিটে বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারে ভারত: শুভেন্দু অধিকারী

নামাজের প্রথম কাতারে জামাত পড়াবস্থায় অজু ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে।

নামাজের প্রথম কাতারে জামাত পড়াবস্থায় অজু ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে।

শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে আ.লীগ : মির্জা ফখরুল

শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে আ.লীগ : মির্জা ফখরুল

বিয়ের ওপর কর বাতিলের দাবি

বিয়ের ওপর কর বাতিলের দাবি

এসএমই ফাউন্ডেশনের নতুন চেয়ারপার্সন মো. মুশফিকুর রহমান

এসএমই ফাউন্ডেশনের নতুন চেয়ারপার্সন মো. মুশফিকুর রহমান

জবিতে ছাত্রলীগ নেত্রী আটক, মুক্তির পর হুমকি

জবিতে ছাত্রলীগ নেত্রী আটক, মুক্তির পর হুমকি

বিতর্ক যেন ছাড়ছেই না উর্বশীকে,আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল

বিতর্ক যেন ছাড়ছেই না উর্বশীকে,আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল

বিনোদনের সংজ্ঞা পাল্টে দিচ্ছে হালের নিও কিউএলইডি টেলিভিশন

বিনোদনের সংজ্ঞা পাল্টে দিচ্ছে হালের নিও কিউএলইডি টেলিভিশন

কিশোরগঞ্জে পুলিশ সদস্যের বাড়ীতে বিয়ের দাবিতে কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীর অবস্থান

কিশোরগঞ্জে পুলিশ সদস্যের বাড়ীতে বিয়ের দাবিতে কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীর অবস্থান

এবার যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আবদুস সোবহান গোলাপের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ

এবার যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আবদুস সোবহান গোলাপের সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ

সিলেটে রিসোর্ট থেকে আপত্তিকর অবস্থায় ১৬ কিশোর-কিশোরী আটক, পরিবার ডেকে বিয়ে দিলো স্থানীয়রা

সিলেটে রিসোর্ট থেকে আপত্তিকর অবস্থায় ১৬ কিশোর-কিশোরী আটক, পরিবার ডেকে বিয়ে দিলো স্থানীয়রা

পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ সবচেয়ে সহজ বিকাশ-এ

পল্লী বিদ্যুতের বিল পরিশোধ সবচেয়ে সহজ বিকাশ-এ

জনগণের পাশে থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

জনগণের পাশে থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান