ঢাকা   শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৬ পৌষ ১৪৩১

আধিপত্যবাদের সাথে আপস নয়

Daily Inqilab ইনকিলাব

১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম

গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে যে ধারার রাজনৈতিক চর্চা চলছিল, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর তা অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে। পুরো জাতির কাছে একটি ম্যাসেজ অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখল, দুঃশাসন ও লুণ্ঠনের মূল পৃষ্ঠপোষক ও শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভারতের শাসকরা। সেখানে যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আধিপত্যবাদী নীতি অনুসরণ করেই তারা সবকিছু করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতের কিছু মিডিয়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো বানোয়াট ইস্যু সৃষ্টি করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু মতভিন্নতা দেখা গেলেও বিজেপি সরকারের অবস্থানের সাথে সে দেশের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেসের কোনো মতবিরোধ নেই। তারা বাংলাদেশ প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদিকেই সমর্থন করছে। কিন্তু বাংলাদেশে ১৬ বছর ধরে আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই সংগ্রাম করা প্রধান রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র-জনতার অবস্থানের মধ্যে এক ধরনের মতভিন্নতা এবং অস্বচ্ছতা লক্ষ করা যাচ্ছে। হাসিনার স্বৈরতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের নেতাকর্মীরা। সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষ, সীমান্ত নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সেই অপূরণীয় ক্ষতি কাটিয়ে দেশকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে হলে ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও আধিপত্যবাদী নীতি মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের জনগণের মধ্যে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠলেও বিএনপি-জামায়াতের কার্যক্রমে তার যথেষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চরম উত্তেজনাকর এক জটিল সময়ে সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির বাংলাদেশ সফর এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া থেকে মনে হয়েছিল, তারা উস্কানিমূলক অবস্থান পরিহার করে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক অনুসরণ করতে চায়। আদতে বাস্তব ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। দিল্লিতে কথিত বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান, সীমান্তে হত্যাকা-, বাংলাদেশের পানিসীমায় ভারতীয় আগ্রাসন সর্বোপরি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যার্পণের বদলে তার ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ভারত তার পুরনো অবস্থানেরই জানান দিয়েছে। শেখ হাসিনাসহ তার মাফিয়াতন্ত্রের সহযোগীদের আশ্রয় দিয়ে, অপপ্রচার ও উস্কানিমূলক অপতৎপরতার সুযোগ অবারিত রেখে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি, অর্থনৈতিক উত্তরণ, বিচার প্রক্রিয়া এবং স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির এজেন্ডা বাস্তবায়নেই তারা তৎপর রয়েছে। গত ১৬ বছর দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী শেখ হাসিনার নতজানু ভারত নীতি অনুসরণ করেছে। তারা একদিকে ‘বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতা’র কথা বলেছে, অন্যদিকে সীমান্তে যখন তখন গুলি চালিয়ে নারী, শিশুসহ সাধারণ বাংলাদেশিদের হত্যা করেছে। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানির লাশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও সীমান্ত বাস্তবতার প্রতীক। অন্তর্বর্তী সরকার বিজিবিকে আর পিঠ না দেখানোর নির্দেশনা জারি করেছে। নওগাঁ সীমান্তে অবৈধভাবে বিএসএফ’র কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজে বিজিবি বাধা দিয়ে ভন্ডুল করে দিয়েছে। তবে গত কয়েক দিনে বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক হতাহত হয়েছে। এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে বিজয়ের সম্ভাব্য দাবিদার হিসেবে বিএনপির কতিপয় নেতার ভূমিকা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নীরবতায় জনমনে কিছুটা সংশয় দেখা দিয়েছে। ভারতের দাদাগিরি জনগণ ও ছাত্র-জনতা আর মেনে নিতে রাজি নয়। এসব বিষয়ে বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল। বিএনপিসহ বড় দলগুলোর সমর্থনেই অভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছে। সকলের সমর্থন ও সহযোগিতাই এই সরকারের শক্তি ও ভিত্তি। চব্বিশের অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট হচ্ছে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে মৌলিক সংস্কার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা। সেখানে যে বা যারাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে, তারাই রাজনৈতিকভাবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ভারতের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী বয়ান ভেঙ্গে দিয়ে নিজেদের বাস্তবতা ও প্রত্যাশাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বিগত সময়ের প্রতিটি গুম-খুন, গণহত্যা ও মেগা দুর্নীতির স্কামগুলোর স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র আপসের কোনো সুযোগ নেই। চৌদ্দ বছর আগে কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে নিহত ফেলানির পরিবার সন্তান হারানোর বিচার পায়নি। শেখ হাসিনার সরকার ফেলানির পরিবারকে কোনো ক্ষতিপূরণ বা সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। গত ৫ মাসে কোনো বিএনপি-জামায়াত নেতাও ফেলানির পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ রংপুরের সেই ফেলানির পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে পুরো জাতির প্রশংসা অর্জন করেছেন। নানা বিষয় ও ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাইরে অন্য উপদেষ্টারাও ভারতের আধিপত্যবাদের প্রশ্নে তেমন কোনো কথা বলছেন না। আসিফ, নাহিদ, সারজিস ও হাসনাত আব্দুল্লাহ্রা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব না করলেও পুরো জাতি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত ভারতীয় আধিপত্য ও দাদাগিরির প্রশ্নে তাদের অবস্থানকে যে দল অগ্রাহ্য করে ভারতের সাথে আপস করে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করবে, তারা নিশ্চিতভাবেই জনসমর্থন হারাবে। হেজিমনি এজেন্ডার কারণে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপসহ কোনো প্রতিবেশীর সাথেই ভারত স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছে না। এসব দেশের চেয়ে বাংলাদেশে অনেক বেশি আগ্রাসন চালিয়েও শুধুমাত্র বশংবদ সৈ¦রতন্ত্রের কারণে একটি কৃত্রিম, আত্মঘাতী বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। চব্বিশের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া নতুন বাংলাদেশে ভারতের দাদাগিরি চলবে না। সেই সাথে বল্গাহীন দুর্নীতি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস-দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিও আর চলবে না। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের বিচার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং ভারতের সাথে সমতাভিত্তিক সম্পর্কের বাইরে ছাত্র-জনতা ভিন্ন কিছু মেনে নেবে না।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সাতক্ষীরায় ইজিবাইকের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে কিশোরী নিহত

সাতক্ষীরায় ইজিবাইকের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে কিশোরী নিহত

সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী জনগণ, রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকা নেই

সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী জনগণ, রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকা নেই

চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মৃদু শৈত্য প্রবাহের কবলে গোট জেলা

চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মৃদু শৈত্য প্রবাহের কবলে গোট জেলা

খলনায়ক এআই, একধাক্কায় বেকার হতে চলেছেন ২ লাখ কর্মী

খলনায়ক এআই, একধাক্কায় বেকার হতে চলেছেন ২ লাখ কর্মী

মক্কায় বন্যার পানিতে ভেসে গেল গাড়ি, ৪ জনের মৃত্যু

মক্কায় বন্যার পানিতে ভেসে গেল গাড়ি, ৪ জনের মৃত্যু

পাকিস্তানে অস্ত্রের মুখে ১৭ সরকারি কর্মীকে অপহরণ

পাকিস্তানে অস্ত্রের মুখে ১৭ সরকারি কর্মীকে অপহরণ

যুক্তরাষ্ট্রে দাবানল নেভানোর কাজে এবার নামানো হলো কারাবন্দিদের

যুক্তরাষ্ট্রে দাবানল নেভানোর কাজে এবার নামানো হলো কারাবন্দিদের

পোল্যান্ড সীমান্তে বেলারুশের সেনা উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা

পোল্যান্ড সীমান্তে বেলারুশের সেনা উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশে ১৩ কিলোমিটার যানজট

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া অংশে ১৩ কিলোমিটার যানজট

আগুনে পুড়ে ছাই হলিউড তারকাদের বাড়ি-ঘর

আগুনে পুড়ে ছাই হলিউড তারকাদের বাড়ি-ঘর

লস অ্যাঞ্জেলেসের ভয়াবহ দাবানলে কমপক্ষে ১০ জন নিহত, সতর্কবার্তা জারি

লস অ্যাঞ্জেলেসের ভয়াবহ দাবানলে কমপক্ষে ১০ জন নিহত, সতর্কবার্তা জারি

লাকসামে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা, মোটরসাইকেলের ২ আরোহী নিহত

লাকসামে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা, মোটরসাইকেলের ২ আরোহী নিহত

মালালা ইউসুফজাই পাকিস্তানে মেয়েদের শিক্ষার সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন

মালালা ইউসুফজাই পাকিস্তানে মেয়েদের শিক্ষার সম্মেলনে বক্তব্য দেবেন

হলুদ রঙে সেজেছে ক্ষেত

হলুদ রঙে সেজেছে ক্ষেত

গোপালগঞ্জে মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুই স্কুল ছাত্র নিহত

গোপালগঞ্জে মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুই স্কুল ছাত্র নিহত

অধিনায়কত্ব উপভোগ করছেন সোহান

অধিনায়কত্ব উপভোগ করছেন সোহান

ইসরায়েলের দখলকৃত সিরিয়ায় সাংবাদিক ও আইনজীবী নির্যাতনের অভিযোগ

ইসরায়েলের দখলকৃত সিরিয়ায় সাংবাদিক ও আইনজীবী নির্যাতনের অভিযোগ

উত্তরা ‌থানা থেকে পালানো সাবেক ওসিকে ধরতে চলছে যৌথ অভিযান

উত্তরা ‌থানা থেকে পালানো সাবেক ওসিকে ধরতে চলছে যৌথ অভিযান

মাস্কের সঙ্গে জার্মান ফার-রাইট নেত্রীর ৭৪ মিনিটের লাইভ চ্যাটে সাক্ষাৎকার

মাস্কের সঙ্গে জার্মান ফার-রাইট নেত্রীর ৭৪ মিনিটের লাইভ চ্যাটে সাক্ষাৎকার

তারাকান্দায় হ্যান্ডট্রলী, সিএনজি ও অটোরিক্সার ত্রিমুখী সংঘর্ষে আহত-৫

তারাকান্দায় হ্যান্ডট্রলী, সিএনজি ও অটোরিক্সার ত্রিমুখী সংঘর্ষে আহত-৫