তাবলিগ জামাতে সঙ্ঘাতের নেপথ্যে কারা?

Daily Inqilab ইনকিলাব

২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম

অন্তর্বর্তী সরকারের উপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করে মূল লক্ষ্য থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি করে ব্যর্থ হয়ে এবার তারা তাবলিগ জামাতের দ্বিধাবিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে মাঠ গরম করতে চাইছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের দখল নিয়ে মাওলানা জুবায়ের ও ভারতের মওলানা সাদের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, যাতে অন্তত চারজন নিহত এবং অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। দ্বীনের দাওয়াত, আত্মশুদ্ধি এবং ধর্মীয় অনুশাসনের প্রচারকার্যে নিয়োজিত তাবলিগ কর্মীদের এমন সংঘাতে জড়ানো এবং রক্তারক্তি ঘটনা সারাবিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য নিদারুণ কষ্ট ও অনুতাপের বিষয়। তাবলিগ জামাতের শত বছরের ইতিহাসে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের বিগত আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকার সাদপন্থী ও জুবায়ের পন্থীদের মতভেদ দূর করার বদলে আলাদা আলাদাভাবে বিশ্ব ইজতেমা করার সুযোগ দিয়ে বিরোধ জিঁইয়ে রাখতে মদদ দিয়েছিল। বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালে সাদ পন্থীদের অতর্কিত হামলায় জুবায়ের পন্থীদের হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। এ কারণে সে বছর জনরোষের মুখে মাওলানা সাদ কান্দলভি টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে যেতে পারেননি। কাকরাইল মসজিদ থেকেই দিল্লীতে ফেরত যেতে হয়েছিল। সা’দপন্থীদের প্রতি হাসিনা সরকারের পক্ষপাতিত্বের কারণে তাবলিগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেম-ওলামাদের মতামত অগ্রাহ্য করে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা বন্ধ রাখা হয়েছিল।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়, আনসার, রিকশাচালক, গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন এবং ইসকন ও চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের দাবি-দাওয়াসহ নানা ইস্যুকে সামনে রেখে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি ও প্রতিবিপ্লবের যেসব অপতৎপরতা দেখা গেছে, তার সবগুলোর সাথেই নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের মুখোশধারী কর্মীদের অংশগ্রহণ ও যোগসাজশ দেখা গেছে। টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে রক্তাক্ত সংঘাত ও হত্যাকাÐের ঘটনা তাবলিগ জামাতের সাধারণ কর্মীদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাবলিগের সা’দপন্থীদের সাথে মিশে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের এসব অপকর্মে জড়িত হওয়ার অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভিকটিমদের অনেকে। এই সংঘাতের জন্য এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী অনুচরদেরও দায়ী করেছেন কেউ কেউ। তাবলিগ জামাতের বিচ্ছিন্ন গ্রæপ সা’দপন্থীদের মূল নেতা মাওলানা সা’দ কান্দলভি দিল্লীতে থেকে নির্দেশনা দিয়ে তার অনুসারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই সাথে দিল্লীতে থাকা বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচার হাসিনা এবং তার প্রধান সন্ত্রাসী গ্রæপ ছাত্রলীগের নেতারা ভারতে থেকে দেশে সংঘাত-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে বলে সহজেই অনুমেয়। এই সংঘাতের মধ্য দিয়ে ইসলামোফোবিক গোষ্ঠি এক ঢিলে তিন পাখি মারতে চেয়েছে। প্রথমত, তারা বাংলাদেশে মুসলমানদের বৃহত্তম একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশকে বিতর্কিত করতে চাইছে; দ্বিতীয়ত, একটি স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়কে চরম বিভক্তি ও সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাÐ প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে; তৃতীয়ত, এই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশে একটি সামাজিক ও ধর্মীয় বিভক্তি উস্কে দিতে চাইছে। ইজতেমা মাঠে সংঘাতের ঘটনা প্রতিহত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা যথাযথ ছিল কিনা, এমন প্রশ্নও উঠেছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঐক্য থাকলে বাইরের যে কোনো ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ রুখে দেয়া সম্ভব। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সহায়তা ও ষড়যন্ত্রে তাবলিগ জামাতের দু’পক্ষের রক্তাক্ত সংঘাতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনার নেপথ্যের অনেক কিছুই ইতোমধ্যে উন্মোচিত হয়ে গেছে। জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে পালিয়ে যাওয়া পতিত স্বৈরাচার দেশকে অস্থিতিশীল করতে নাশকতামূলক কর্মকাÐে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করবে, এটাই স্বাভাবিক। ইজতেমা ময়দানের দখল নিতে সশস্ত্র হামলায় হতাহতের ঘটনায় সা’দপন্থী নেতারা দুঃখপ্রকাশ করে মাঠ ছেড়ে চলে গেছে বলে গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দু’পক্ষের সাথে আলাদা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। ইজতেমা মাঠের আশপাশের তিন কিলোমিটারের মধ্যে ১৪৪ ধারা জারিসহ সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। এটি কোনো নিছক দুর্ঘটনা ছিল না। মধ্যরাতে হাজার হাজার মানুষের ইজতেমা মাঠে প্রবেশ এবং রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনার উপর কোনো রকম গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রতিকার-প্রতিরোধের ব্যবস্থা ছিল না, এমনটা সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, হামলা ও হত্যাকাÐের সাথে জড়িতদের ছাড় দেয়া হবে না। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখী করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুই দিনেও কাউকে গ্রেফতার বা আটকের তথ্য পাওয়া যায়নি। জুবায়েরপন্থী বলে পরিচিত তাবলিগ জামাতের মূল ধারার সাথে দেওবন্দী আলেম-ওলামা, হেফাজতে ইসলাম এবং দেশের অধিকাংশ ইসলামি সংগঠনের সমর্থন থাকায় বিগত সরকার তাদের বিরোধী পক্ষ ভারতের সা’দপন্থীদের সমর্থন দিয়ে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে তুলতে চেয়েছিল। এবার হাসিনার পতনের পর পলাতক আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অনেকে তাবলিগ জামাতের ছদ্মবেশে আত্মগোপন করে দিল্লীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এহেন বাস্তবতায়, ঘটনার অনুপুক্সক্ষ তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে দেশের একটি স্পর্শকাতর সময়ে দ্বিধাবিভক্ত তাবলিগ জামাতকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দুই পক্ষের সমঝোতা কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের পাতা ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে দেশের আলেম সমাজ, সব রাজনৈতিক দল এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বিহারিরা কেমন আছে
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
ভ্রমণকারীদের সচেতন হতে হবে
নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে নানা কথা
আরও

আরও পড়ুন

সালথায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চলছে ডাকাতির নাটক, বিব্রত পুলিশ!

সালথায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চলছে ডাকাতির নাটক, বিব্রত পুলিশ!

শিল্পকলায় শুরু হয়েছে মাসব্যাপী ভাস্কর্য প্রদর্শনী

শিল্পকলায় শুরু হয়েছে মাসব্যাপী ভাস্কর্য প্রদর্শনী

এনআইডির তথ্য বেহাত, কম্পিউটার কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলো ইসি

এনআইডির তথ্য বেহাত, কম্পিউটার কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলো ইসি

সোনারগাঁও বুরুমদী উচ্চ বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী উদযাপন

সোনারগাঁও বুরুমদী উচ্চ বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী উদযাপন

ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভার পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে মামলা- পৌর প্রশাসক ইকবাল হোসাইন

ঈশ্বরগঞ্জ পৌরসভার পাওনা টাকা পরিশোধ না করলে মামলা- পৌর প্রশাসক ইকবাল হোসাইন

সাদপন্থী তাবলীগের মুখপাত্র মুয়াজের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

সাদপন্থী তাবলীগের মুখপাত্র মুয়াজের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

পূর্বাচলে বুয়েট ছাত্রের মৃত্যু : তিন আসামি ২ দিনের রিমান্ডে

পূর্বাচলে বুয়েট ছাত্রের মৃত্যু : তিন আসামি ২ দিনের রিমান্ডে

লক্ষ্মীপুরে সরকারি রাস্তা কেটে যুবলীগ নেতার চাষাবাদ, প্রতিবাদে মানববন্ধন

লক্ষ্মীপুরে সরকারি রাস্তা কেটে যুবলীগ নেতার চাষাবাদ, প্রতিবাদে মানববন্ধন

কলাপাড়ায় গরু চুরি করে পালানোর সময় জনতার হাতে আটক চোর

কলাপাড়ায় গরু চুরি করে পালানোর সময় জনতার হাতে আটক চোর

এবার পানামা খাল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের

এবার পানামা খাল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের

মাগুরায় গ্রামবাসির সংঘর্ষে নিহত যুবদল নেতা শরিফুলের বাড়িতে বিএনপি নেতারা

মাগুরায় গ্রামবাসির সংঘর্ষে নিহত যুবদল নেতা শরিফুলের বাড়িতে বিএনপি নেতারা

সিমকার্ডের আড়ালে সীমান্তে বেড়েছে চোরাচালান

সিমকার্ডের আড়ালে সীমান্তে বেড়েছে চোরাচালান

কিশোরগঞ্জের আব্দুল কাহার আকন্দ কোথায়? কেউ জানে না!

কিশোরগঞ্জের আব্দুল কাহার আকন্দ কোথায়? কেউ জানে না!

হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি

হাসিনাকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি

যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা

রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা

আবারও  ভানুয়াতুতে  দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প

আবারও ভানুয়াতুতে দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প

হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি

হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি

রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'

রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'

‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’

‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’