ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৫ পৌষ ১৪৩১

পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধে নেতিবাচক আঘাত হানছে ভারতীয় সিরিয়াল

Daily Inqilab রিয়েল তন্ময়

১৬ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩৯ পিএম | আপডেট: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম

একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল নাটক। নাটক দেখার জন্য দর্শক মুখিয়ে থাকতেন। আশি ও নব্বই দশকজুড়ে যেসব ধারাবাহিক নাটক প্রচার হয়েছে, সেগুলো দেখার জন্য শুধু বাংলাদেশের দর্শক নয়, কলকাতার দর্শকও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। সময় সকাল-সন্ধ্যা, ভাঙনের শব্দ শুনি, ঢাকায় থাকি, সময় অসময়, শুকতারা, সংশপ্তক, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, রূপনগর, আজ রবিবার, জোনাকী জ্বলে’র মতো ধারাবাহিক নাটকগুলো দর্শকের মনে আজও গেঁথে রয়েছে। সেসব ধারাবাহিকের একেকটি চরিত্র ও সংলাপ দর্শক স্মরণ করে। সময়ের সাথে সাথে নাটক নির্মাণ থেমে না থাকলেও আগের মতো সেই আবেদন এ সময়ের নাটকে খুব কমই পাওয়া যায়। ফলে দেশের চ্যানেলগুলোর ধারাবাহিক নাটক থেকে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বরং তাদের কাছে ভারতীয় বাংলার ধারাবাহিক নাটক ও বিভিন্ন রিয়েলিটি শো বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অনেকে মনে করেন, এদেশে ভারতীয় চ্যানেলের সাংস্কৃতিক উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। নীতিমালা না থাকা, সরকারের নমনীয়তা, পরিকল্পনার অভাব, দেশীয় চ্যানেলগুলোতে মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতা ইত্যাদি নানা কারণে দেশের নাটক ও সংস্কৃতি ক্ষয়ীষ্ণু হওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতি এবং পুরো শিল্প ঝুঁকির মুখে পড়ছে। এ ক্ষতির পাশাপাশি ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়ালের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধে। সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের মধ্যে চলে হিন্দি ভাষায় আলাপচারিতা। ভারতীয় বাংলা নাটকের জনপ্রিয়তা শুধু টিভি পর্দায়ই সীমাবদ্ধ নেই। দীর্ঘ এই সিরিয়ালগুলোর চরিত্রের নামে পোশাক থেকে শুরু করে শিশুদের খাতার মলাটেও স্থান পেয়েছে এসব নাটকের নায়িকার ছবি। এদিকে, মানহীন নাটকের সংখ্যা বেড়ে চলছে দিনকে দিন। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ভালোমানের নাটক সম্প্রচার হলেও লাগামহীন বিজ্ঞাপনের কারণে দর্শক রিমোট হাতে স্থির থাকছে না। চলে যাচ্ছে স্টার প্লাস, জি বাংলা, কালারস, সনি বা স্টার জলসাতে। অন্যদিকে, বিটিভির ওপর থেকে দর্শকরা আকর্ষণ হারিয়েছে অনেক আগেই। ভরসা ছিল স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর। কিন্তু এখন সে চ্যানেলগুলোর বেশিরভাগ নাটকই গল্পহীন-অর্থহীন।

ভারতীয় সিরিয়াল নিয়মিত দেখেন ঢাকার বাসিন্দা গৃহিণী মার্জিয়া মনি। কেন ভারতীয় সিরিয়াল দেখেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবারের সুখ-দুঃখ নিয়ে কাহিনীগুলো হয়, সেটা ভাল লাগে। রোমাঞ্চও থাকে। এছাড়াও ভারতের জামা-কাপড় এবং মেকআপও ভালো হয়। এজন্যই দেখি। তাছাড়া তাদের নাটকে বিজ্ঞাপনের বিরক্তিকর বিষয়টা থাকেনা। একটি নাটক শেষ হওয়ার সাথে সাথে অন্য নাটক শুরু হয়ে যায়। আর ভারতীয় সিরিয়ালের গল্পগুলোতে কেমন যেন একটা আকর্ষণ থাকে, তারপর কি ঘটবে সেটার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকি। এই ব্যাপারটাই নিয়মিত নাটকটা দেখতে বাধ্য করে। এভাবেই তাদের সিরিয়ালের প্রতি একটা ঝোঁক চলে আসছে।
দেশে কি ভালো মানের নাটক তৈরি হচ্ছে না? তাহলে কেন বাংলাদেশে ভারতীয় সিরিয়ালের এত জনপ্রিয়তা? এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রবীণ অভিনেতা এবং নির্মাতা মামুনুর রশিদ বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রচুর নতুন টেলিভিশন চ্যানেল যাত্রা শুরু করেছে এবং নাটকের পরিমাণও বেড়েছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধির সাথে সাথে মান তো বাড়েইনি বরং আরো নেমে গেছে। ভারতীয় নাটকে যারা অভিনয় করে তাদের একটি গ্রুমিং সেন্টার রয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া, যারা ভালো অভিনয় করে, তাদের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। আর বেশি টাকা দিতে হয় বলে ভালো অভিনেতাদেরও নির্মাতারা নিচ্ছে না। নাট্যকার আহসান আলমগীর দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ভারতীয় সিরিয়াল বাংলাদেশে জনপ্রিয়, কথাটি এখন আর সত্য নয়। আমি নিজে কলকাতা সিরিয়ালের শুটিংয়ে গিয়ে দেখে এসেছি, তাদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তাদের কোন নাটকই এখন আর ৩০০ পর্বের বেশি হয় না। অথচ এই সিরিয়ালগুলো একসময় হাজার হাজার পর্ব হতো। তবে একসময় বাংলাদেশে তাদের সিরিয়ালের অনেক জনপ্রিয়তা ছিল। তাদের আজগুবি গল্প এখন আর বাংলাদেশের দর্শক গ্রহণ করে না, বরং চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশের সিরিয়ালের ও জনপ্রিয়তা কমেছে সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বাজেট এবং শিল্পী সংকট। বর্তমানে প্ল্যাটফর্ম বেড়েছে। দর্শক বেশি ঝুঁকেছে অনলাইন মাধ্যমে ইউটিউব, ফেসবুক, ওটিটি-তে। অধিক জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীরা অনলাইন মাধ্যমে বেশি কাজ করছেন বলে টিভি সিরিয়ালের বাজেট কমে গেছে। বাজেট কম হওয়ার কারণে জনপ্রিয় শিল্পীদের কাস্টিং করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী সিরিয়ালগুলো হচ্ছে, ডেইলি সোপ। প্রতিদিন প্রচার হচ্ছে বলে দর্শক গল্পে আটকে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সিরিয়াল উল্টো পথে। এখনো অধিকাংশ চ্যানেল সপ্তাহে দুই পর্ব থেকে ৩ পর্ব নাটক প্রচার করে বলে দর্শক কানেক্ট থাকতে পারেনা। এতে বিদেশি চ্যানেলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, কয়েকটি চ্যানেল সপ্তাহে পাঁচ থেকে ছয় পর্ব করে সিরিয়াল চালাচ্ছে বলে সিরিয়ালগুলো দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে। বাংলাদেশের সব চ্যানেল যদি সিরিয়ালকে প্রতিদিনের ধারাবাহিক হিসেবে প্রচার শুরু করে তাহলে বাংলাদেশী সিরিয়াল আবারো সেই ঐতিহ্যে ফিরে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি ।
নাটক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের নাটকের যে ধারা তৈরি হয়েছিল, যে নিজস্ব ধারায় আমরা ছিলাম, সেখান থেকে অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছি। আমাদের এখন নাটকের নিজস্বতা বলে কিছু নেই। একটা সময় ছিল, যখন পশ্চিমবঙ্গের দর্শক আমাদের নাটকের জন্য মরিয়া হয়ে থাকত। এখন উল্টোটা, বাণিজ্যের তোড়ে আমরা আমাদের নাট্য-সাহিত্যবোধ হারাতে বসেছি। এখন আমাদের দর্শক তাদের নাটক দেখার জন্য অপেক্ষা করে। আমাদের দেশে আগে যেসব নাটক নির্মাণ হতো, সেগুলোতে চরিত্রের উপস্থিতি দর্শকের মনে দাগ কাটতো। পারিবারিক ড্রামা বলতে যা বোঝায়, সেটির সব চরিত্র দর্শক একটি নাটকে দেখতে পেত। এখন এর দারুণ অভাব রয়েছে। একদিকে ফ্যামিলি ড্রামা নির্মাণের সংখ্যা কম, অন্যদিকে যে নাটকগুলো নির্মিত হচ্ছে, তার বেশির ভাগ তথাকথিত নায়ক-নায়িকা নির্ভর। সেখানে গল্পের প্রাধান্য থাকে কম। দর্শক খোঁজে বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য ভারতীয় সিরিয়ালে দর্শক পায় বলেই সেগুলো দেখছে। ভারতীয় সিরিয়ালে আকৃষ্ট হওয়াকে অনেকে আমাদের দেশীয় নাটকের জন্য হুমকিও মনে করছেন। আর এভাবে চলার কারণে দেশীয় টিভি নাটকের প্রতি দর্শক বিমুখতা বেড়েই চলেছে। সেসূত্রে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও হারাচ্ছে দর্শক। দর্শক ধরে রাখার উপায় খুঁজে বের করতে না পারলে আমাদের নাটকের ভবিষ্যত বলে কিছু থাকবে না।


বিভাগ : বিনোদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

টানা তৃতীয়বারের মতো সুপার কাপের ফাইনালে বার্সালোনা

টানা তৃতীয়বারের মতো সুপার কাপের ফাইনালে বার্সালোনা

ইন্দোনেশিয়ার নতুন কোচ ক্লাইভার্ট

ইন্দোনেশিয়ার নতুন কোচ ক্লাইভার্ট

কোপ দেলরের শেষ ষোলোতে কে কার মুখোমুখি

কোপ দেলরের শেষ ষোলোতে কে কার মুখোমুখি

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন গাপটিল

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন গাপটিল

পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি লাখো মানুষের

পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি লাখো মানুষের

ভোগান্তিতে সেবা নিতে আসা জনসাধারণ

ভোগান্তিতে সেবা নিতে আসা জনসাধারণ

আদমদীঘিতে ফসলি জমিতে ফের কোল্ড স্টোর নির্মাণ

আদমদীঘিতে ফসলি জমিতে ফের কোল্ড স্টোর নির্মাণ

পদ্মার চরে শিকারিদের কবলে অতিথি পাখি

পদ্মার চরে শিকারিদের কবলে অতিথি পাখি

বাগেরহাটে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ৮ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, আহত ২০

বাগেরহাটে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ৮ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, আহত ২০

গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটির নতুন কমিটি গঠন

গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটির নতুন কমিটি গঠন

বিপন্ন প্রজাতির হনুমান পাচারকালে ২ জনের কারাদ-

বিপন্ন প্রজাতির হনুমান পাচারকালে ২ জনের কারাদ-

মিরপুরে তুরাগ নদী এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান

মিরপুরে তুরাগ নদী এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান

৪৮ ঘণ্টা পরও লাশ ফেরত দেয়নি বিএসএফ

৪৮ ঘণ্টা পরও লাশ ফেরত দেয়নি বিএসএফ

ঢাকা বিমানবন্দরে পাখির আঘাতের হার বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি

ঢাকা বিমানবন্দরে পাখির আঘাতের হার বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি

ভারত আইনের শাসন মানে না : রিজভী

ভারত আইনের শাসন মানে না : রিজভী

ভয়াবহ দাবানলে ছাড়খাড় লস অ্যাঞ্জেলেস

ভয়াবহ দাবানলে ছাড়খাড় লস অ্যাঞ্জেলেস

সরকারের সঙ্গে আলোচনার নির্দেশনা ইমরান খানের

সরকারের সঙ্গে আলোচনার নির্দেশনা ইমরান খানের

‘উন্নয়ন চাইলেও গণতন্ত্র দরকার সংস্কার চাইলেও গণতন্ত্র দরকার’ : বিএনপি শীর্ষ নেতা নজরুল ইসলাম খান

‘উন্নয়ন চাইলেও গণতন্ত্র দরকার সংস্কার চাইলেও গণতন্ত্র দরকার’ : বিএনপি শীর্ষ নেতা নজরুল ইসলাম খান

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত

সচিবালয়ের সামনে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া

সচিবালয়ের সামনে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া