পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও পতন হয়নি ফ্যাসিজমের। দীর্ঘ ১৭ বছরের দুঃশাসনের আমলে সংগঠনটি টার্গেট করে নিজেদের লোক ঠুকিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আওয়ামী ফ্যাসিজম ছড়িয়ে দেয়নি। যার ভোগান্তি যেমন দেশের জনগণকে ভোগ করতে হচ্ছে তেমনি প্রবাসীদের জীবনকেও বিষিয়ে তুলেছে। কেবল দেশেই নয় দেশের বাইরেও দলটির নেতা কর্মীরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়ে দেদারসে করছে অপকর্ম।

দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রবাসীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের পাশাপাশি করা হচ্ছে অমানবিক আচরণ। অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, নারী সহকর্মীদের সাথে যৌন নিপীড়নমূলক আচরণ, ইমিগ্রেশনে দুর্নীতি, এমনকি প্রবাসীদের লাশ হস্তান্তরেও টাকা দাবিসহ অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের প্রথম সচিব আওয়ামী দালাল মোহাম্মদ মহসিন মিয়ার বিরুদ্ধে।

আওয়ামী দোসর মহসিনের এহেন আচরণের প্রতিবাদে তাকে অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে ঢাকায় এক বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে রোমানিয়ার ভিসা প্রত্যাশীরা। রবিবার (৫ জানুয়ারি) সকাল ১১ টায় রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভ শেষে বিক্ষুব্ধ ভিসা প্রত্যাশীরা প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। দীর্ঘ সেই স্মারকলিপিতে ৯ দফা দাবি তুলে ধরেছেন বিক্ষোভরত প্রবাসীরা।

দাবিগুলো পাঠকদের সুবিধার্থে তুলে ধরা হলোঃ
১। জনাব মহসিন মিয়া রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, মলদোভা ও নর্থ মেসিডোনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন করে তার ক্যান্ডিডেটদের ভিসা প্রদানের জন্য তদবির করেন, যা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং উল্লেখিত দেশসমূহ এতে বিরক্ত। বিষয়টি দিল্লিতে অবস্থিত উক্ত দেশসমূহের দুতাবাসগুলো অবলীলায় এ বিষয়ে আমাদের প্রার্থীদের প্রশ্ন করছে ও ভিসা রিজেক্ট করছে। ফলে এত লাখ লাখ টাকা-পয়সা খরচ করেও ভিসা পাচ্ছে না আমাদের জনগণ।

২। মহসিন মিয়া রোমানিয়ান সহকর্মীদের সাথে যৌন নিপীড়নমূলক আচরণ করেছেন (এরকম আচরণ তিনি বাংলাদেশে থাকতেও করেছেন বলে আমাদের কাছে অভিযোগ আছে)। ইউরোপের দেশগুলোতে এই ধরণের বিষয় অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেয়া হয়। কূটনীতিক হবার কারণে তারা মহসিন মিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি অ্যাকশন না নিতে পারলেও, প্রভাব পড়ছে পুরো দেশের উপর।

৩। মহসিন মিয়া রোমানিয়ার ইমিগ্রেশন, শ্রম মন্ত্রণালয় ও রোমানিয়ার কোম্পানিগুলোর সাথে অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ করেছেন আমাদের রোমানিয়া-বুলগেরিয়া-মলদোভা-নর্থ মেসিডোনিয়া প্রবাসী ভাইয়েরা। ফলে বাংলাদেশিদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করা কমে গিয়েছে এবং অনেক বাংলাদেশিদের চাকরি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

৪। জনাব মহসিন বাংলাদেশ কমিউনিটির সদস্যদের "তুমি" করে ডাকেন এবং তাদের "স্যার” ডাকতে বাধ্য করেন। অনেক সিনিয়র- সম্মানিত প্রবাসীদের তিনি "স্যার" ডাকতে বাধ্য করেছেন। এছাড়া তিনি কথায় কথায় নিজেকে "ক্যাডেট কলেজ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র", "লেবার উইং-এর ফার্স্ট বয়” ইত্যাদি পরিচয় দিয়ে আত্ম-অহমিকায় ভুগে নিজেকে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করে প্রবাসীদের সাথে তার বিভাজন বাড়িয়েই চলছেন।

৫। ২০২৩ সালে শ্রম উইং খোলার পর জনাব মহসিন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী (হাসিনা) কার্যালয়ের সাবেক "সহকারী প্রেস সচিব", আওয়ামী ফ্যাসিস্ট নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া'র "ভাতিজা" পরিচয় দিতেন। পতিত স্বৈরাচারের আমলে তিনি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ডঃ ইউনুস স্যার ও মাননীয় প্রবাসী উপদেষ্টা ডঃ আসিফ নজরুল স্যার সম্পর্কে জনসম্মুক্ষে বিষেদাগার করতেন। পতিত ফ্যাসিস্টের এই দোসরকে দ্রুত সরিয়ে নেয়া এখন সময়ের দাবি।

৬। সম্প্রতি রোমানিয়ান নাগরিককে জনাব মহসিন 'নিকৃষ্ট খ্রিস্টান শূকর' বলে গালি দিয়েছেন। উক্ত রোমানিয়ান নাগরিক মহসিনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে রোমানিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন, আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন, মামলা করার প্রস্তুতি ও বুখারেস্ট প্রেস ক্লাবে প্রেস কনফারেন্স ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশ সরকার জনাব মহসিনের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ না নিলে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে নেমে যেতে পারে।

৭। ২০২০, ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে রোমানিয়ায় প্রবেশকারী বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে "বাংলাদেশ" শীর্ষস্থানে ছিল। কিন্তু রোমানিয়ায় শ্রম উইং-এর প্রতিষ্ঠাতা দাবিকারী মহসিন মিয়ার যোগদানের পর সব পরিবর্তিত হতে থাকে। বাংলাদেশ এখন প্রথম ৩ দেশের মধ্যেও নেই। কারণ, ডিমান্ড লেটার সত্যায়নের ক্ষেত্রে জনাব মহসিন এত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করেছেন যে, কোন রোমানিয়ান কোম্পানি ভয়ে আর তার কাছে যান না। বরং তারা এখন নেপাল, শ্রী লংকা, ফিলিপাইন ও ভারতমুখী। তারপরেও, কোন কোম্পানি তার কাছে ডিমান্ড লেটার সত্যায়ন করতে আসলে তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে ৫০% পর্যন্ত তার নিজস্ব কোটা চেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক রোমানিয়ান ব্যবসায়ী। এছাড়া মহসিনের প্রেস্ক্রিপশনে BMET Card ইস্যুকরণ করতে BMET অনেক "লাল ফিতার দৌরাত্ম্য" দেখাচ্ছে। ফলে রোমানিয়া- বুলগেরিয়া গামী অনেক ব্যক্তির ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে রেখেছেন।

০৮। মহসিন সাহেব দেশে প্রবাসীদের লাশ পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের কাছে সরাসরি অর্থ চেয়ে প্রবাসীদের মনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে চাইছেন। আমরা জানি যে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় না পারলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ফান্ড থেকেও অর্থ প্রদান করতে পারে। এক্ষেত্রে জনাব মহসিন কার এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ।

০৯। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহসিন মিয়া রোমানিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটির নামে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে "মানবপাচারকারি" আখ্যা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তারা এটি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন এবং মহসিন মিয়ার নামে মানহানির মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

এসময় রোমানিয়া প্রবাসী ফয়জুল বলেন, 'আমি ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছি। মহসিন মিয়া এম্বাসিতে কোন কাজ করেন না, শুধু গল্প দেন আমি এই করছি, সেই করছি। কিন্তু তিনি প্রবাসীদের সাথে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করেন। কোন অসহায় শ্রমিক লিগ্যাল হেল্প চাইলে তার কাছে টাকা চান।'

মনসুর নামে আরেক প্রবাসী বলেন, 'মহসিন সাহেবের কার্যক্রমের যে ফিরিস্তি দেখছি তাতে রোমানিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে যেন যেতে না হয়, সেই চেষ্টা করবো। উনি রোমানিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিকে থ্রেট দেওয়ায় অনেক বাংলাদেশির চাকরি চলে গেছে।'

এসময় বক্তারা এত এত অভিযোগ থাকার পরেও মহসিন মিয়ার বিরুদ্ধে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কেন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ না নিয়ে পতিত সরকারের ঘনিষ্ঠজনকে সাদরে লালন-পালন করছে, সে বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন।

এমনকি তার শাস্তির দাবিতে আগামী সাত দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রয়োজনীয় শাস্তি ও অপসারণ নিশ্চিত না করলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে যাবে রোমানিয়া ভিসা- প্রত্যাশী বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, গত ২৮ ডিসেম্বর একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকে প্রথম সচিব মোহাম্মদ মহসিন মিয়া’র নামে একাধিক অভিযোগ সম্বলিত একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এরপর থেকেই দূর্নীতি, অপেশাদার আচরণ, কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ সহ বিভিন্ন কর্মকান্ডের ঘটনায় আলোচনায় আসেন দালাল মহসিন।