ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধ করি
০১ জুন ২০২৩, ০৮:৫৭ পিএম | আপডেট: ০২ জুন ২০২৩, ১২:০৫ এএম
২৮ মে, বিশ্ব ব্লাড ক্যানসার দিবস ২০২৩। বিশ্ব ব্লাড ক্যান্সার দিবস হলো ব্লাড ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে সচেতনতা সৃষ্টির দিবস। ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া মানবেদেহে ঘাতক ব্যাধিগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত, ব্লাড ক্যান্সার বা রক্তের ক্যানসার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত। সময়ের সঙ্গে এ ধরনের রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি পাল্টেছে, অনেক উন্নতিও লাভ করেছে। ক্যান্সার হচ্ছে কর্কটরোগ, যা অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন সংক্রান্ত রোগসমূহের সমষ্টি। এখনও পর্যন্ত এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ সহজে ধরা পড়ে না, ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোন চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হয় না। বাস্তবিক অর্থে এখনও পর্যন্ত ক্যান্সারের চিকিৎসায় পুরোপুরি কার্যকর কোনও ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। ক্যান্সার সারানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এই রোগ সারানোর সম্ভাবনা অনেকাংশ বেড়ে যায়। মানুষের ২০০ প্রকারেরও বেশি ক্যান্সার রয়েছে। প্রত্যেক ক্যান্সারই আলাদা আলাদা এবং এদের চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা। বর্তমানে ক্যান্সার নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে নতুন নতুন অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ক্যান্সার নামটা ভয় সৃষ্টিকারী। বর্তমান সমাজে, বন্ধু বান্ধব আতœীয় স্বজনের মধ্যে এই ভয়ঙ্কর রোগে জীবন দান করেনি এমন লোক পাওয়া যাবে না। গত দুই যুগ ধরে এ রোগে যত রোগী মৃতুবরন করেছে, কোন যুদ্বেও এত লোক জীবনাহুতি দেয়নি। এর একমাত্র কারণ -রোগ ও এই রোগের উৎপত্তির কারণ সস্বন্ধে অজ্ঞতা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধেও অজ্ঞতা। ক্যান্সারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বা মানুষকে রক্ষা করার একমাত্র পথ হল হলো কারণগুলি বিশ্লেষণ করা। মূলত লিউকেমিয়াকে আমরা ব্লাড ক্যান্সার বলে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ১৩ বিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করবে। ২০৩৫ সালের দিকে বাংলাদেশে দুই লাখ ৫০ হাজারের মতো ব্লাড ক্যান্সারের নতুন রোগী শনাক্ত হতে পারে। যতগুলো ক্যান্সার রয়েছে তার মধ্যে ৬.৫ শতাংশ হচ্ছে ব্লাড ক্যান্সার। এই লিউকেমিয়া হলো রক্তকোষের ক্যানসার, বিশেষত শ্বেত রক্তকণিকার ক্যান্সার। ব্লাড ক্যান্সার বা রক্তে ক্যান্সার নামেই এটি বেশি পরিচিত। এটি কোনো বংশগত বা ছোঁয়াচে রোগ নয়। ঠিক কী কারণে রোগটি হয়, তা এখনো বিজ্ঞানীদের স্পষ্ট জানা নেই। তবে রেডিয়েশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল বা কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক, পেস্টিসাইড বা কীটনাশক, ভেজাল খাবার ও খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহার, হেয়ার ডাই ও কিছু প্রসাধনীর ব্যবহার, লুব্রিকেন্টস, বার্নিশ, কেমোথেরাপি ব্যবহারের ইতিহাস ও কিছু জেনেটিক অসুখ থাকলে ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ওপরের যেকোনো কারণে অস্থিমজ্জার ভেতরের স্টিমসেল বা রক্তের অপরিপক্ব সেলের মিউটেশন বা অন্য কোনো পরিবর্তন হলে ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্ট তৈরি হয়, যা অস্থিমজ্জার ভেতরে অতিদ্রুত বৃদ্ধি হয়।
> উৎপত্তি স্থল ভেদে ব্লাড ক্যান্সারের প্রকারভেদ ঃ ব্লাড ক্যান্সার মূলত তিন ধরনের।
১. শ্বেত কণিকা থেকে সৃষ্ট ব্লাড ক্যান্সারকে লিউকোমিয়া ব্লাড ক্যান্সার বলে।
২. লসিকা গ্রন্থি থেকে সৃষ্ট ব্লাড ক্যান্সারকে বলা হয় লিম্ফোমা।
৩. প্লাজমা সেল থেকে সৃষ্ট ব্লাড ক্যান্সারকে মাইয়েলোমা বা প্লাজমা সেল লিউকোমিয়া বলা হয়।
> উপসর্গঃ দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, বুক ধড়ফড়, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, ঘন ঘন ইনফেকশন বা জ্বর, গায়ে কালো কালো দাগ ও রক্তক্ষরণ, গায়ে ব্যথা, লিম্ফ গ্ল্যান্ড ফুলে যাওয়া, প্লীহা ও লিভার বড় হওয়া ইত্যাদি ব্লাড ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ। ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্টের সংখ্যা এ সময় এত বেশি বেড়ে যায় যে অস্থিমজ্জার ভেতরে স্বাভাবিক সেল যেমন-লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা ও অণুচক্রিকা তৈরি এবং তা পরিপক্ব হওয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা পায় না। ফলে ক্যান্সার সেল ছাড়া অন্য সুস্থ সেলগুলো পরিমাণমতো তৈরিই হতে পারে না। অস্থিমজ্জার ভেতরে লোহিত রক্তকণিকার ঘাটতিতে রক্তস্বল্পতা, পরিপক্ব শ্বেত রক্তকণিকার ঘাটতিতে ইনফেকশন বা জ্বর ও অস্বাভাবিক অণুচক্রিকার কারণে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে থাকে। একসময় অস্থিমজ্জার ভেতরে ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্ট অনেক বেশি বেড়ে যায়, যা অস্থিমজ্জার ধারণক্ষমতার বাইরে। একপর্যায়ে ক্যান্সার সেল বা ব্লাস্ট অস্থিমজ্জা থেকে বের হয়ে হাড়ের পেরিওস্টিয়ামে আসে তখন ব্যথা হয়, আবার রক্তনালি হয়ে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে।
> সব লিউকেমিয়া এক নয়ঃ-
ব্লাড ক্যান্সার বা লিউকেমিয়া বংশবিস্তারের ধরনের উপর মূলত দুই ধরনের। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া ও ক্রনিক লিউকেমিয়া। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া খুবই মারাত্মক হয়। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে রোগী বেশি দিন বাঁচতে পারে না। অ্যাকিউট লিউকেমিয়া আবার দুই ধরনের, অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএলএল এবং অ্যাকিউট মায়েলোব্লাাস্টিক লিউকেমিয়া বা এএমএল। ক্রনিক লিউকেমিয়া সাধারণত মারাত্মক হয় না। যথাসময়ে চিকিৎসা নিলে রোগী অনেক ক্ষেত্রেই সুস্থ হতে পারে।
রক্ত কণিকাগুলো সঠিক মাত্রায় উৎপন্ন না হলে রক্তশূন্যতা, রক্তক্ষরণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে রোগীর মৃত্যু ঘনিয়ে আসে।
>রক্ত শূন্যতাজনিত লক্ষণঃ- যেমন-অবসাদ ও দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় ইত্যাদি।
* শরীরের ইনফেকশনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে লাগাতার জ্বর থাকতে পারে।
* রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, নাক, দাঁতের মাড়ি, চোখ ও ত্বকে রক্তক্ষরণ এবং মাসিকের সময় বেশি রক্ত যাওয়া প্রভৃতি হতে পারে।
* শরীর বা হাড়ে ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা।
* লিভার ও স্পিøন বড় হয়ে যাওয়া।
* গিলায়, বগলে বা অন্যত্র লিম্ফনোড বড় হওয়া।
> ব্লাড ক্যান্সারের কারণঃ-
যেসব ফ্যাক্টর ব্লাড ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ায় তা হলো-জেনেটিক, পরিবেশ ও পেশাগত ফ্যাক্টর।
* তেজস্ক্রিয়তা : এটমিক বোমা বিস্ফোরিত হওয়া।
* রাসায়নিক পদার্থ : বেনজিন, পেট্রোল ও প্লাস্টিক কারখানার ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ।
* জেনেটিক ডিজঅর্ডার : ফানকোনি এনিমিয়া, ডাউন সিনড্রোম। মূলত অনকোজিনের আধিক্য অথবা টিউমার সাপ্রেসর জিনের অক্ষমতায় রক্ত কণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে ব্লাড ক্যান্সার হয়ে থাকে।
> প্রতিরোধের উপায়ঃ-
* যেসব রোগীকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি একসঙ্গে দেয়া হয় তাদের মধ্যে ব্লাড ক্যান্সারের প্রবণতা প্রায় ২০ গুণ বেড়ে যায়।
* তেজস্ক্রিয়তা পরিহার করতে হবে।
* রাসায়নিক দ্রব্যাদির সংস্পর্শ পরিহার করতে হবে।
* এক্স-রে বিভাগে ও নিউক্লিয়ার বিভাগে কাজ করার সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
* ধূমপান ও তামাক জর্দা পরিহার করতে হবে।
> ব্লাড ক্যান্সারের ঝুঁকিঃ-
* কৃষি কাজে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহার করা।
* কলকারখানায় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা।
* পরিবেশ দূষণ।
* মাছ, ফল ও অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যে ফরমালিন ব্যবহার করা।
> ব্লাড ক্যান্সার নির্ণয়ঃ-
* সিবিসি ও ব্লাড ফিল্ম পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে ব্লাড ক্যান্সার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
* বোনম্যারো ও ট্রিফাইন বায়োপসি পরীক্ষা : কোমরের হাড় থেকে অস্থিমজ্জা সংগ্রহ করে পরীক্ষা।
* লিম্ফনোড এফএনএসি ও বায়োপসি পরীক্ষা : লসিকা গ্রন্থি থেকে টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা।
> ব্লাড ক্যান্সারের রোগী কি আগের জীবনে ফিরে আসতে পারে?
চিকিৎসার পরও অনেক সময় ব্লাড ক্যান্সার ফিরে আসতে পারে বা পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তবে এগুলো নির্ভর করে ব্লাড ক্যান্সারের ধরন, পর্যায়, চিকিৎসার কার্যকারিতা এবং রোগীর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন কারণের ওপর। ক্যান্সার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না সে লক্ষণ শনাক্ত করার জন্য নিয়মিত ফলোআপসহ সতর্ক থাকতে হয়
> চিকিৎসা পদ্ধতিঃ-* কেমোথেরাপি
* বোনম্যারো ট্রান্সপ্লানটেশন ( অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন)
* টার্গেটেড থেরাপি
* ইমিউনো বা বায়োলজিক্যাল থেরাপি।
পরিশেষে বলতে চাই, ব্লাড ক্যান্সার মানেই মরণব্যাধি নয়। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। ক্যানসারের নানা চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। ফলে এখন এই অসুখটি সারানো সম্ভব। সঠিক সময়ে নির্ভুল রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা নিলে অনেক ব্লাড ক্যান্সার ভালো হয় ও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই ভয় না পেয়ে আসুন ক্যান্সারের মোকাবেলা করি। সঠিক সময়ে নির্ণয়, সঠিক চিকিৎসা এবং পর্যাপ্ত সচেতনতার মাধ্যমে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। ক্যান্সার রোগী, ক্যান্সার রোগীর আত্মীয়স্বজন যারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, এবং চিকিৎসকগনদের অনুরোধ করবো জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির সাথে যুক্ত হয়ে আমাদের সহায়তা করুন। বাংলাদেশে ক্যান্সার সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে একসাথে কাজ করুন।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: [email protected]
মোবাইল: ০১৮২২৮৬৯৩৮৯।
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এডিস মশার ভয়াবহ রূপ : একদিনে ডেঙ্গুতে আরো ৯ জনের মৃত্যু
ব্যবসায়ীরা হতাশ : বাংলাদেশিদের ভিসা না দিয়ে উল্টো বিপাকে ভারত!
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ -এ পদার্পণ : শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় ২৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা
ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় ২৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা
ফসলের মাঠে দোল খাচ্ছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন ধানের শীষ
গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর কাছে বাজার জিম্মি থাকবে না : চট্টগ্রামে বাণিজ্য উপদেষ্টা
থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে গ্রেফতার, শাহজাহান ওমর কারাগারে
প্রাথমিকের জন্য ৫ কোটি ৩২ লাখ বইয়ের অনুমোদন
ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলা : নড়াইলে আ.লীগ সভাপতি সুবাস চন্দ্র কারাগারে
রাসিকের মাস্টারোলে নিয়োজিত ১৬১ কর্মীকে অব্যাহতি : ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শোকজ
লক্ষীপুরে গণঅভ্যুত্থানে হামলাকারীদের বিচার ও আহতদের সুচিকিৎসার দাবিতে বিক্ষোভ
মা-মেয়েসহ সড়কে নিহত ৭
ভারতে সাজাভোগ শেষে ফিরল পাচার হওয়া ২৪ নারী-পুরুষ
নায্যদামে বিক্রি করতে পেরে লাভবান কৃষক
বানরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ
হ্যামস্টার পালানোয় বিমান গ্রাউন্ডেড
২৪ ক্যারেটের গাড়ি
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত