রক্ত ক্যান্সার বাচ্চাদেরই বেশি হয়
০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩২ এএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩২ এএম
রক্ত ক্যান্সারকে লিউকেমিয়া নামেই ডাকা হয়। বাচ্চাদেরই এই ক্যান্সার বেশী হয়। আর এটাই বাচ্চাদের ক্যান্সারের প্রধান কারন। রক্তকোষ তৈরী হয় হাড়ের মজ্জায়। যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে মজ্জায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক রক্ত কোষ তৈরী হয় আর তা রক্ত এবং রক্তের মাধ্যমে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে তখনই বিপর্যয় দেখা দেয়। এই ক্যান্সার সাধারনত শ্বেত কনিকার বৃদ্ধির কারনেই হয়, তবে অন্য কোষ গুলির কারনেও কিছু কিছু রক্ত ক্যান্সার হতে পারে।
আমাদের শরীরে কি কি ধরনের কোষ থাকে:
লোহিত কনিকা: এই কনিকাই রক্তে বেশী থাকে। এটা কমে গেলে বাচ্চা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বাচ্চা ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে যায়, কারও কারও শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। খুব বেশী কমে গেলে হার্ট ফেইল হতে পারে।
শ্বেত রক্ত কনিকা: এরাই আমাদের শরীরে প্রবেশ করা জীবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এদের সংখ্যা কমে গেলে বাচ্চারা দ্রুতই কোন সংক্রমনে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়লে তখনই বলি লিউকেমিয়া হয়েছে।
অনুচক্রিকা: এটা রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে। এটার অভাবে শরীরে ছোট ছোট রক্তক্ষরনের লাল ঘামাচির মত পেটিকি, একটু বড় ফোটা পারপুরা বা বড় কালো দাগ ব্রুইজ দেখা যায়। কারো কারো মাড়ি, নাক, পায়খানার সাথেও রক্ত আসে। এখন আমাদের দেশে ডেঙ্গু রুগীদের প্রায়ই অনুতচক্রিকা কমে যাওয়া আমরা দেখছি।
বাচ্চাদের কয়েক রকমের রক্ত ক্যান্সার হতে পারে। তবে বেশীর ভাগ রক্ত ক্যান্সার হয় একিউট অর্থাৎ এটা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। যেসব লিউকেমিয়া বাচ্চাদের হয় তা হল:
একিউট লিম্পোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া (এএলএল)- এটাই সবচেয়ে বেশী দেখা যায়।
একিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (এএমএল) - এটা বাচ্চাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লিউকেমিয়া।
হাইব্রিড বা মিক্সড লিনিয়েজ- এটা সচরাচর দেখা যায় না। এটা হচ্ছে উপরের দুইটার মিক্সড, অর্থাৎ এএলএল ও এএমএল একই সাথে থাকে।
ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া ( সিএমএল)- এটাও বাচ্চাদের খুব একটা হয় না।
ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকেমিয়া (সিএলএল)- এটা বাচ্চাদের খুবই রেয়ার বা দেখা যায় না বললেই চলে।
জুভেনাইল মায়েলো মনোসাইটিক লিউকেমিয়া ( জেএমএমএল) - এটাও খুব কম দেখা যায়।
বাচ্চাদের লিউকেমিয়া হওয়ার কারণ: এর কোন সুনির্দিষ্ট কারন নাই। তবে কেউ কেউ বংশ অর্থাৎ বাবা-মা থেকে এটা পেয়ে থাকতে পারে। বেশীর ভাগেরই বাবা-মায়ের কোন ভুমিকাই থাকে না। তবে বিজ্ঞানিরা হাড়ের মজ্জার মিউটেশন দেখেছেন এর কারন হিসাবে। এই পরিবর্তণ জন্মের আগে বা মায়ের গর্ভ থেকেও হতে পারে।
কি কি ঝুঁকির কারনে লিউকেমিয়া হয়:
অনেক রেডিয়েশন এক্সপোজার হলে।
কিছু কিছু সিন্ড্রম থাকলে-যেমন, ডাউন সিন্ড্রম, লি-ফ্রাউনি সিন্ড্রম ইত্যাদি।
কোন অসুখের কারনে ইমিউন সিস্টেম দূর্বল হয়ে পড়লে।
নিজের কোন ভাই বা বোন আক্রান্ত থাকলে।
লিউকেমিয়ায় কি কি লক্ষণ থাকতে পারে: লক্ষন কার কেমন হবে তা অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এই লিউকেমিক কোষ কোথায় পর্যন্ত আক্রমন করেছে তার উপর লক্ষণ নির্ভর করে। এই কোষ থাকতে পারে হাড়ের মজ্জায়, রক্তে, যকৃতে, প্লিহায়, ব্রেইন, স্পাইনাল কর্ড, থাইমাস, দাঁতের মাড়ি বা চামড়ায়। তাই সব বাচ্চার লক্ষন একই রকম হয় না। তবে সাধারনত যা যা হতে পারে তা হল:
ফ্যাকাসে চেহারা,
বাচ্চা দেখতে ক্লান্ত, দুর্বল, শরীর ঠান্ডা বা জ্বর আক্রান্ত,
মাথা ঘুরা, মাথা ধরা,
শ্বাস নিতে কষ্ট, ছোট ছোট শ্বাস
হাড়ে গিঁটে ব্যথা
ক্ষুধামন্দা
ওজন কমে যাওয়া
পেট ফুলে যাওয়া,
শরীরের লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া
এগুলোর সবই অন্য অনেক অষুখের সাথে মিলে যেতে পারে, তাই নিজে বিভ্রান্ত না হয়ে চিকিৎসক দিয়ে নিশ্চিত হন।
লিউকেমিয়া ডায়গনোসিস করবেন কিভাবে?
চিকিৎসক বাচ্চার রোগের কিছু ইতিহাস জেনে নিবেন, শারীরিক পরীক্ষা করবেন এবং অনেক কিছু মিল পেলে প্রথমেই একটি রক্ত পরীক্ষা করাবেন। রক্ত পরীক্ষার ফলাফল লিউকেমিয়ার মত মনে হলে তা নিশ্চিত হতে ও এর বিস্তার ও চিকিৎসা পরিকল্পনার জন্য এবার অনেকগুলি পরীক্ষার দরকার হবে।
হাড়ের মজ্জা পরীক্ষা: সাধারনত মাজার হাড় বা হিপ বোন থেকে মজ্জা রস বা হাড়ের অংশ নিয়ে এই পরীক্ষা করে দেখা হয় লিউকেমিয়ার অনিয়ন্ত্রিত কোষ ওখানে কি পরিমানে এবং কোন ধরনের তৈরী হচ্ছে।
রক্ত এবং হাড়ের মজ্জার ল্যাব টেষ্ট: এখানে ফ্লোসাইট্রোমেট্রি ও ইমিউনোসাইটো কেমিষ্ট্রি করে লিউকেমিয়ার সঠিক ধরন বের করা হয়। প্রয়োজনে ডিএনএও পরীক্ষা করা হয়। এটা করলে চিকিৎসার ধরন ও প্রোগনোসিস বুঝতে সুবিধা হয়।
বুকের এক্সরে করে এটার বিস্তার আছে কি না দেখা যায়।
আল্ট্রাসনোগ্রাম করেও পেটের ভিতরের লিম্পনোড ও লিউকেমিয়ার বিস্তার দেখা হয় কারও কারও।
লিম্ফনোড বায়োপসি: এটা করেও রোগের ধরন ও বিস্তার দেখা যায়।
লাম্বার পাংচার: পিঠের পিছনের রস নিয়ে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে এর বিস্তার দেখা হয় যাতে চিকিৎসা পরিকল্পনা নিখুঁত হয়।
এত কিছু করার পর লিউকেমিয়ার ধরন ও চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা হয়। অন্য অনেক ক্যান্সারের মত এখানে কোন স্টেজিং করা হয় না। এখানে গ্রুপ ও সাব টাইপ বের করে চিকিৎসা প্রটোকল ঠিক করা হয়। একিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়াকে ২ গ্রুপে ভাগ করা হয় যার ৮০% বি সেল টাইপ আর ২০% টি সেল টাইপ।
অন্যদিকে একিউট মায়েলয়েড লিউকেমিয়া বা এএমএলকে আবার অনেক গুলি ভাগে ভাগ করা হয়। তাই বলা যায় এই লিউকেমিয়ার ভাগ গুলি করা খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার পরই ঠিক হয় চিকিৎসা প্রটোকল এবং এদের ভবিষ্যত কেমন হবে তা। সঠিক প্রটোকল অনুসরন করার পরও চিকিৎসা ফেইল করতে পারে।
বাচ্চার লিউকেমিয়া কিভাবে চিকিৎসা করা হয়?
চিকিৎসা নির্ভর করে লিউকেমিয়ার ধরন ও আরও কিছু আলাদা আলাদা বিষয়ের উপর। তবে রক্ত কমে যাওয়া, রক্তক্ষরণ ও ইনফেকশন থেকে বাঁচতে হলে প্রায় সবারই প্রয়োজন হয়-
প্রথমেই রক্ত সঞ্চালন করতে হয়।
রক্তক্ষরণের জন্য দিতে হয় প্লাটেলেট।
ইনফেকশনের জন্য দরকার হয় ভাল ব্রডস্পেক্ট্রাম এন্টিবায়োটিক।
আর লিউকেমিয়া থেকে সুস্থ হতে যা প্রয়োজন হয় তা হল:Ñ
কেমোথেরাপি: বেশীর ভাগ বাচ্চারই কেমোথেরাপিতে লিউকেমিয়া ভাল হয়। শিরায়, পিঠের স্পাইনাল স্পেসে, মাংশে বা মুখে এই কেমো প্রয়োগ করা হয়। এতে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ফলে ক্যান্সার কোষ মারা যায়। তবে এটা নিয়ম মেনে কয়েক সাইকেল দিতে হয়। এটা শেষ করতে মাস, বছরও লেগে যায়। সাইকেলের ফাকে ফাকে বিশ্রাম পর্যায় থাকে।
রেডিয়েশন থেরাপি: কাউকে কাউকে এই থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। এটা এক ধরনের উচ্চ ক্ষমতার এক্সরে।
হাইডোজ কেমো আর স্টেম সেল থেরাপি: বাচ্চার নিজের শরীর থেকে বা সুস্থ কারো কাছ থেকে স্টেম সেল যোগাড় করার পর উচ্চ ডোজের কেমো দিয়ে হাড়ের মজ্জা খালী করা হয়। তারপর আবার সংরক্ষিত স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপি: কোন কোন সময় কেমো থেরাপি কাজ না করলে এটা দেয়া হয়। সিএমএল এর বাচ্চাদের এটা দেয়া হয়। এটার জটিলতা কম।
ইমিউনো থেরাপি: এখানে রুগীর নিজের ইমিউন সিস্টেম ক্যান্সার কোষকে আক্রমন করে।
সাপোর্টিভ কেয়ার: রোগ, ওষুধ বা অন্য কারনে এসময় জ্বর, ব্যথা, সংক্রমণ, বমি, ক্ষুধামন্দা হয়। তখন রুগীকে সাহায্য করতে হয়।
চিকিৎসায় কি সবাই ভালো হয়: এটা অনেক গুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
কে কত তাড়াতাড়ি সঠিক চিকিৎসা শুরু করতে পারল।
চিকিৎসা চলাকালিন আর পরবর্তীতে ডাক্তারের ফলোআপ নিয়মিত হতে হবে।
নতুন ভাল প্রটোকল ব্যাবহারে ফলাফল ভাল পাওয়া যায় আর জটিলতাও কম হয়।
চিকিৎসার পরও কি কি জটিলতা হতে পারে: রোগ ও চিকিৎসার কিছু জটিলতা আছে। হতে পারে এটা অল্প সময়ের জন্য বা অনেক পরে অনেক দিনের জন্য। কিছু ওষুধে ভাল হয় আবার কিছু আছে যা চিকিৎসায় কাজ না হলে বা দেরি হলে মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
জটিল সংক্রমন
রক্তক্ষরন
রক্ত ঘন হয়ে যায় অতিরিক্ত ক্যান্সার কোষের কারনে ফলে সরু নালীতে তা আটকে গিয়ে বিপর্যয় ডেকে আনে।
আর পরবর্তি খারাপ জটিলতা হল:
আবার ক্যান্সার ফিরে আসা।
শরীরে নতুন অন্য কোন ক্যান্সার হতে পারে
হার্ট বা ফুসফুসের সমস্যা
বাচ্চার বাড়ন্ত কমে যাওয়া
বাচ্চার শিক্ষার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
হাড় নরম হয়ে যাওয়া
ভবিষ্যতে রুগীর কোন বাচ্চা না হওয়া
লিউকেমিয়ার বাচ্চাকে আপনি কিভাবে সাহায্য করবেন: এই বাচ্চাদের চিকিৎসা চলাকালীন ও যতদিন চিকিৎক বলবেন ততদিন তাদের তত্বাবধানে রাখতে হবে। প্রয়োজনে কোন সন্দেহ জনক লক্ষন দেখা দিলে আবার রক্ত পরীক্ষা বা ইমেজিং পরীক্ষা করে চিকিৎসক তার করণীয় ঠিক করবেন।
যদি খেতে সমস্যা হয় তবে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিতে হবে।
বাচ্চা ক্লান্ত মনমরা থাকলে তাকে কিছু সুপরামর্শের জন্য আলাদা কাউন্সিলরের সাহায্য নিতে পারেন। বাইরে গিয়ে কিছু ব্যায়াম করাতে পারেন, পছন্দনিয় স্থানে ঘুরে আসতে পারেন।
অবশ্যই যথাসময়ে ফলোআপে যেতে হবে ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
ডা. জহুরুল হক সাগর
নবজাতক-শিশু-কিশোর মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
রূপসী বাংলা হাসপাতাল,
জিয়া সরনী, শনির আখরা, কদমতলি, ঢাকা।
ফোন: ০১৭৮৭ ৭৪০ ৭৪০: ০১৭২৮ ৫৫৮ ৯৯৯।
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারলে নোবেল পাওয়া উচিৎ : মাত্তেও সালভিন
গাজায় বর্বর হামলা অব্যাহত, নিহত আরও ৪৪ ফিলিস্তিনি নিহত
আজ থেকে রাজধানীর ১৩ স্থানে সুলভমূল্যে মিলবে ডিম
আজ শহীদ নূর হোসেন দিবস
অসুস্থ পলক ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি
যশোর আর্মি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী দম্পতিকে জিম্মি করে চাঁদা আদায়, আটক ১
কাউন্সিলর কাশেম মোল্লা ৯ বছরে শতকোটি টাকার মালিক
শেখ হাসিনার কথিত অডিও ক্লিপের নির্দেশনা বাস্তবায়নকারী গ্রেপ্তার
রাজধানীর আ. লীগ কার্যালয় থেকে আটক ১
রাজধানীর জিরো পয়েন্টে ছাত্রদলের মিছিল
যশোরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় এক নারীসহ দু’জন নিহত
মধ্যরাতে হানিফ ফ্লাইওভারে চলন্ত ট্রাকে আগুন
যশোর জেনারেল হাসপাতালে টেন্ডার নিয়ে তত্বাবধায়ক লাঞ্ছিত, ২ নেতা বহিষ্কার
সল্টের বিধ্বংসী শতকে উড়ে গেল উইন্ডিজ
নুনেজ-সালাহ নৈপুণ্যে জিতে পয়েন্ট ব্যবধান বাড়াল লিভারপুল
ছন্দ হারানো সিটি হারল ব্রাইটনের কাছেও
হাঁটুর চোটে মৌসুম শেষ মিলিতাওয়ের
ভিনির হ্যাটট্রিক,বেলিংহ্যামের গোলে ফেরার রাতে রিয়ালের জয়
রোমাঞ্চকর লড়াইয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে এগিয়ে গেল শ্রীলঙ্কা
শারজাহতে ৩৪ বছরের অপেক্ষা ঘোচালেন শান্ত