সুস্বাস্থ্য রক্ষায় টেনশনমুক্ত থাকুন

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

‘হেলথ ইজ ওয়েলথ’। অর্থাৎ স্বাস্থ্যই সম্পদ। মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁর ইবাদত করার জন্য। তাই যথাযথভাবে ইবাদত করার জন্য দরকার শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতা। একজন মুমিনের জন্য মহান রবের দেয়া এই সুস্বাস্থ্য অন্যতম একটি আমানত। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল সাঃ বলেন- দু’টি নেয়ামতের বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ অসতর্ক ও প্রতারিত। সুস্থতা ও অবসর। (বুখারি শরিফ ৫/২৩৫৭)। ‘কিয়ামতের দিন বান্দাকে নেয়ামত সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো তার সুস্থতা প্রসঙ্গে। তাকে বলা হবে আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দেইনি?’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৩৩৫৮)। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার চেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম।’ আধুনিক যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞান ইসলামের সেই থিওরি স্বীকার করে ঘোষণা করে, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’। অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়।

রোগাক্রান্ত হলে অবিলম্বে চিকিৎসা নেয়া ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে জরুরি। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: নিজে অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতেন এবং তার অনুসারীদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা নাও, কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে যার কোনো প্রতিষেধক নেই, তাহলো বার্ধক্য।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৩৮৫৭)।

রাসূল সা: অসুস্থ ব্যক্তিকে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করাতে বলেছেন এবং এ ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিতেন। তিনি হালাল-হারাম প্রসঙ্গে হারাম বস্তু ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যেমন রোগ দিয়েছেন তেমনি রোগের প্রতিষেধকও সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক রোগেরই চিকিৎসা রয়েছে। সুতরাং তোমরা সুস্থতার জন্য চিকিৎসা গ্রহণ করো। তবে হারাম বস্তুকে চিকিৎসায় ব্যবহার কোরো না।’

আমাদের জীবনে চলার পথে টেনশন করতে না চাইলেও তা এমনিতেই চলে আসে। টেনশনের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ঘুম। আপনি কোনো কারণে চিন্তা বা টেনশনে থাকলে কোনোভাবেই রাতে ঘুম আসবে না। ঘুমের ওষুধ খেলেও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে টেনশনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টেনশনের প্রধান কারণ হলো শঙ্কা। এ শঙ্কাই হচ্ছে মানবিক ক্রিয়া। অতীতের বেদনাবিধুর কোনো ঘটনা এবং ভবিষ্যতে কী হবে-এ কাল্পনিক চিন্তা থেকে অযথা শঙ্কিত হয়ে বা ভয় পেয়ে মানুষ অকারণে টেনশনে ভুগতে থাকেন এবং মানবিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এ সমস্যার প্রধান উৎস ‘মন’ আর এ মনই হচ্ছে টেনশনের প্রধান উৎপত্তিস্থল। অনেক সময় টেনশন বা দুশ্চিন্তা থেকে নানা রোগ হয়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত অনেকে মৃত্যুবরণও করেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোগব্যাধি বা শারীরিক অসুস্থতার অধিকাংশের পেছনে থাকে টেনশন, দুশ্চিন্তা, ভয় ইত্যাদি। তাই মনকে শান্ত, প্রফুল্ল এবং টেনশনমুক্ত রাখাই হলো রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার একটি বড় উপায়।

দুশ্চিন্তা বা টেনশন থেকে মুক্ত থাকতে মনোবিজ্ঞানী বা মহাপুরুষরা বলেন, নীরবতা সুস্থভাবে জীবনযাপনের অন্যতম পথ। মনে রাখা প্রয়োজন, কঠোর পরিশ্রমে যেটুকু শক্তি ক্ষয় হয়, তার থেকে বেশি ক্ষতি হয় রাগ, ক্ষোভ, উম্মাদনা ও উত্তেজনায়। টেনশনমুক্ত থাকতে হলে ঘুমের ওষুধ নয়, মেডিটেশনই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো উপায়। আমাদের সবার জানা দরকার যে, চিন্তা রোগের কোনো ওষুধ নেই। এ রোগ আগুনের মতো মনকে প্রতিনিয়ত কেবল দহন করতে থাকে। কাজেই টেনশনকে পরিহার করা অনেকটাই সম্ভব, যদি আমাদের চিন্তাকে সৎপথে ব্যবহার করা যায়। জীবনের সব পরিস্থিতিতেই শান্ত, ধীর-স্থিরভাবে থাকাটা একান্ত জরুরি। সারা দিনের কাজের একটা সুনিয়ন্ত্রিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা থাকলে এবং সেই অনুসারে সব কাজকর্ম সাবলীল গতিতে চললে নিশ্চিন্ত, চাপমুক্ত ও উদ্বেগশূন্য থাকা সম্ভব। ভয় টেনশন, দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে বিশেষ করে মৃত্যুভয় থেকে মুক্ত থাকতে হলে প্রাণখোলা হাসি উল্লাসে পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী বা সর্বক্ষেত্রে সবাইকে নিয়ে যেতে থাকতে হবে।

বলে রাখা ভালো, টেনশনমুক্ত থাকার উপায় অবশ্যই আছে। এক্ষেত্রে চাহিদা কমাতে হবে, সাধ্যের বাইরে কোনো বস্তু পাওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। লোভ-লালসা, হিংসাবিদ্বেষ, অহংকার, অহমিকা, রাগ, ক্ষোভ, পরনিন্দা ইত্যাদি প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। টেনশনকে দূরে সরিয়ে রাখার অন্যতম উপায় ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। চট করে অধৈর্য এবং উত্তেজিত হয়ে পড়লে দেহ ও মন উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সব সময় আনন্দ-ফুর্তিতে থাকলে টেনশন কখনোই কাছে আসবে না। যারা হাসি আনন্দে জীবন কাটান, তারা সাধারণত দীর্ঘজীবী হয়ে থাকেন। তারা কখনোই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকেন না। সামাজিক জীবনে অভ্যস্ত হলে, যেমন যে কোনো সেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িত রাখতে পারলে মন উদার ও আনন্দে থাকে। মনকে টেনশনমুক্ত রাখতে হলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। সব সময় নিজেকে যে কোনো ধরনের অপরাধ থেকে বিরত রাখা উত্তম। অপরাধ বোধ মনকে কুরে কুরে খেয়ে থাকে। এতে টেনশন বেড়ে যায়।

অনেকে মানসিক শান্তির জন্য মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে থাকেন, এটা ভালো। এক্ষেত্রে জীবনের যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে থাকলেও মানসিক শান্তি কখনোই বিঘিœত হবে না। স্বার্থান্বেষী না হলেই ভালো। কেননা যে যত বেশি স্বার্থান্বেষী হবে, তার মানসিক অশান্তির মাত্রা ততই বেড়ে যাবে। জীবনের শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন কিছুটা সময় একান্তে নীরবে বসে, সব সাংসারিক চিন্তাভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে, মনকে সুস্থির করার নামই ধ্যান। কোনো একটি বিষয়ে মনকে স্থাপন করে সব লৌকিক চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে মনকে নিবিষ্ট করতে পারলে ক্রমে মন সংযত হতে বাধ্য। ধ্যানের অভ্যাসে মনে এক উচ্চতর আনন্দাভূতি আসে, যা আমাদের অন্তরে ও সংসারে সুখ-শান্তি বজায় রাখতে সহায়তা করে। এতে আত্মশক্তি বৃদ্ধি পায়, মনের সব সংকীর্ণতা দূর হয়, টেনশন ও মানসিক অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করে, ক্রোধকে সংবরণ করা যায়। এছাড়া ধ্যান অভ্যাসে অন্তরে ও বাইরে সমন্বয় তৈরি হয়, যা ব্যক্তিকে শান্তি ও আনন্দপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য বিশেষ সহায়তা করে থাকে।
মূল্যবান কথা হচ্ছে জীবনকে সুস্থ, সুন্দর-আনন্দময় রাখতে হলে টেনশনমুক্ত জীবন নিজেকেই গড়ে তুলতে হবে। বাস্তব সত্য এই যে, আধুনিককালে ব্যক্তিজীবনে টেনশনের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ নানাভাবে রোগগ্রস্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, স্নায়ুুরোগ, ক্যানসার ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। তাই যে কোনো মানসিক ও টেনশনমুক্ত জীবনযাপনের জন্য ধ্যান বা মেডিটেশনের কোনো বিকল্প নেই। তাই পরিমিত ও নিয়মিত আহার, শারীরিক ব্যায়াম, বিশ্রাম, নিদ্রা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত। সবশেষে এ সত্যটি মনে রাখুন- নিজের যতœ না নিলে নিজে, অন্যের ওপর ভরসা মিছে।

মো: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবাইল-০১৭১৬-২৭০১২০।


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে ঢাকায়, জনজীবনে স্বস্তি

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে ঢাকায়, জনজীবনে স্বস্তি

৮০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস, ২ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত

৮০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস, ২ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত

হিজবুল্লাহর হামলায় ‘ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি’ কথা স্বীকার করল ইসরাইল

হিজবুল্লাহর হামলায় ‘ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি’ কথা স্বীকার করল ইসরাইল

জাপানের পরমাণু দূষিত পানি সমুদ্রে ফেলা প্রতিবেশী দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ

জাপানের পরমাণু দূষিত পানি সমুদ্রে ফেলা প্রতিবেশী দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ

পার্লামেন্টে তুমুল মারামারিতে জড়ালেন তাইওয়ানের আইনপ্রণেতারা

পার্লামেন্টে তুমুল মারামারিতে জড়ালেন তাইওয়ানের আইনপ্রণেতারা

পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিশ্বকাপ ক্রিকেট দল

পাকিস্তানের সম্ভাব্য বিশ্বকাপ ক্রিকেট দল

হামাসের পাল্টা হামলায় নাস্তানাবুদ ইসরায়েলি সেনারা

হামাসের পাল্টা হামলায় নাস্তানাবুদ ইসরায়েলি সেনারা

দুবাই ফেরত যাত্রীর কাছে মিলল সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ!

দুবাই ফেরত যাত্রীর কাছে মিলল সাড়ে চার কোটি টাকার স্বর্ণ!

অসহায় শিশুর জীবন বাঁচাতে যা করলেন সোনু সোদ

অসহায় শিশুর জীবন বাঁচাতে যা করলেন সোনু সোদ

সউদীতে প্রথম বাংলাদেশি হজযাত্রীর মৃত্যু

সউদীতে প্রথম বাংলাদেশি হজযাত্রীর মৃত্যু

অবসর ভাতা পাচ্ছেন না সৈয়দপুর রেলওয়ের কারখানার ৩ হাজার ৮৭৩ অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী

অবসর ভাতা পাচ্ছেন না সৈয়দপুর রেলওয়ের কারখানার ৩ হাজার ৮৭৩ অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না-করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না-করা

কেএনএফের নারী শাখার প্রধান সমন্বয়ক আকিম বম

কেএনএফের নারী শাখার প্রধান সমন্বয়ক আকিম বম

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫১ কোটির ড্রোন ভূপাতিত করল হুথিরা

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫১ কোটির ড্রোন ভূপাতিত করল হুথিরা

নির্বাচনী মিছিলে প্রতিপক্ষের হামলা, মুন্সীগঞ্জে আহত ১০

নির্বাচনী মিছিলে প্রতিপক্ষের হামলা, মুন্সীগঞ্জে আহত ১০

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

গাজায় তিন জিম্মির মরদেহ উদ্ধার ইসরায়েলের

গাজায় তিন জিম্মির মরদেহ উদ্ধার ইসরায়েলের

গাঁজা খেলে আর জেল নয়, আনা হচ্ছে বড় আইন

গাঁজা খেলে আর জেল নয়, আনা হচ্ছে বড় আইন

অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকে শিক্ষক পেটানো ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার

অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকে শিক্ষক পেটানো ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কার

নির্বাচনী প্রচারণার মাঠের পাশে ককটেল বিস্ফোরণ, আটক ৫

নির্বাচনী প্রচারণার মাঠের পাশে ককটেল বিস্ফোরণ, আটক ৫