মদ পান থেকে ক্যান্সার
২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১১ এএম
ক্যান্সার বলতে আমরা বুঝি অনেকগুলো সমস্যার সমষ্ঠিকে। এ রোগের কটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে এবং তা হল এটা শুরু হয় শরীরের মূল ভিত্তি কোষ থেকে। কোন কোষ যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তখন ওই কোষ ক্রমাগত বিভাজিত হতে থাকে। এ অতিরিক্ত কোষগুলো টিউমারের সৃষ্টি করে। সুস্থ কোষও বিভাজিত হয়। সব টিউমার কিন্তু এ রকম হয় না। যে সব টিউমার একটা নির্দিষ্ট স্থানে থাকে এবং ছড়িয়ে পড়ে না সেসব টিউমারকে ক্যান্সার বলা হয় না এবং এগুলোর চিকিৎসাও সহজ। যেমনÑ শল্য চিকিৎসা দ্বারা টিউমারটি কেটে বাদ দিলেই হয়। কিন্তু অন্য টিউমারের ক্ষেত্রে কাহিনী সম্পূর্ণ ভিন্ন। এগুলো লসিকাতন্ত্র ও রক্ত সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরের অন্যান্য দূরবর্তী স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তুত এ দ্বিতীয় পর্যায়ের টিউমার নিয়েই সব সমস্যা। এগুলো ক্যান্সার বা কর্কট রোগ। ক্যান্সার ছোঁয়াচে রোগ নয়। বয়স ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারের সৃষ্টি হয় এবং বেড়ে উঠে। কারণ সমূহের মধ্যেÑ পরিবেশ, জীবনধারা, পারিবারিক বা বংশগতধারা, খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ বিশেষ কিছু মৌলের প্রভাব ইত্যাদি অন্তর্গত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণ ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। এ জন্যই এমন ক্যান্সার অনেকের হতে পারে যাদের ক্ষেত্রে প্রবণতা বৃদ্ধিকারী কারণও খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু তবুও ক্যান্সার প্রতিরোধে এ প্রবণতা বৃদ্ধিকারী কারণগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এগুলোর অনেকগুলোই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তামাক, ধূমপান, জর্দা, খৈনি ইত্যাদি ক্যান্সার সৃষ্টির প্রধান কারণ। পরিসংখ্যানগতভাবে সম্ভবত এক-তৃতীয়াংশ দায়ী। ধূমপানের ফলে ফুসফুস, স্বরযন্ত্র, খাদ্যনালী, জরায়ু, মুখগহ্বরে ক্যান্সার হয়। এ প্রবণতা ধূমপানের মাত্রার ওপর ও স্থায়ীত্বের ওপর নির্ভর করে। তামাক সেবনের ফলে খাদ্যনালী, খাদ্যথলি, মূত্রথলি এমনকি প্রষ্টেট ক্যান্সারের প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। জর্দা, খৈনি বা নস্যি নাক ও মুখগহ্বরের গলার ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ায়।
এছাড়া রয়েছে পরিবেশেগত ধূমপান। এটির কারণ হচ্ছে, ধূমপায়ীদের জন্য অধূমপায়ীরা ধোঁয়া নিতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেকে এজন্য এটিকে সেকেন্ডহ্যান্ড ধূমপানও বলে থাকেন। অধূমপায়ীর ফুসফুসের ক্যান্সারের বৃদ্ধিতে এ জাতীয় ধূমপানের অবদানও যথেষ্ট। ধূমপানের মতো মদ্যপানেও ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণত যারা মদ্যপান করে তারা ধূমপানও করেন। তাই দুটি কারণ এসব ক্ষেত্রে যৌথভাবে ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। সাধারণত মুখ, গলা, স্বরযন্ত্র, খাদ্যনালী ও যকৃতের ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগের প্রভাব। এরমধ্যে এসবেস্টস, নিকেল, তেজষ্ক্রিয় বস্তু ইউরেনিয়াম, ক্যাডমিয়াম, বেঞ্জিন, কীটনাশক দ্রব্য ইত্যাদি। তাই যেসব শিল্পে এসব যৌগের ব্যবহার আছে সেসব ক্ষেত্রে কর্মচারীদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করা হয়েছে। অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাদ্য বৃহদান্ত্র, জরায়ু বা প্রষ্টেট ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। অতিরিক্ত মোটা মহিলাদের স্তন, জরায়ু, ডিম্বাশয় বা অগ্নাশ্বয়ের ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। অতি বেগুনি রশ্মি ত্বকের বয়স বাড়িয়ে দেয়।
ক্যান্সারের অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছেÑ তেজষ্ক্রিয়তা। সাধারণভাবে তেজষ্ক্রিয় বলতে বুঝায় তেজষ্ক্রিয় বস্তু থেকে নির্গত বিকিরণ। এ বিকিরণ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন উৎস থেকেও আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়Ñ সৌরম-লের বিকিরণ যা বায়ুম-লের বাইরে থেকে পৃথিবীতে প্রবেশ করে। এছাড়া পারমাণবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা আণবিকম বোমা বিস্ফোরণের ফলে মানুষের ওপর বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিকিরণের সাধারণ একটি উৎস হচ্ছে এক্স-রে। বিকিরণের প্রভাব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেও যখন দেখলেন জাপানে আণবিক বোমার আক্রমণের পরেও যারা বেঁচেছিলেন তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকই লিউকোমিয়া, স্তন, থাইরয়েড ইত্যাদির ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসায় যে এক্স-রে ব্যবহার করা হয় তাও বিকিরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক্স-রে তখনই কর হয় যখন তা অবশ্য দরকারী। তবুও এর ব্যবহারও সীমিত রাখা বাঞ্ছনীয়। অতীতে টনসিলের রোগ, ত্বকের ছত্রাকের রোগ বা থাইমাসের রোগ ইত্যাদিতে এক্স-রে বিকিরণ করা হতো। পরবর্তীকালে দেখা যায় অনেকেরই থাইরয়েড ক্যান্সার হয়েছে। এর দ্বারা বিজ্ঞানীরা এক্স-রের কুফল সম্পর্কে অবগত হলেন, ক্যান্সারের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলোÑ রেডিওথেরাপি বা রে বা বিকিরণ চিকিৎসা। এটি ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ বিকিরণ ক্যান্সার রোগাক্রান্ত কোষের পাশাপাশি স্বাভাবিক কোষের কিছু ক্ষতি করে। এক্স-রে বা কোবাল্ট মেসিনের গামা রশ্মি হুবহু এক। অবশ্য এ বিকিরণের ফলে উৎপন্ন ক্যান্সার দীর্ঘদিন পরে হয় এবং এছাড়া এটি নির্ভর করে কোন অঙ্গে রশ্মি দেয়া হচ্ছে অথবা রোগীর তখনকার বয়সের ওপর। এভাবে সৃষ্ট ক্যান্সার চিকিৎসা করা কঠিন। এজন্য বর্তমানে ক্যান্সার ছাড়া অন্যান্য রোগে বিকিরণ চিকিৎসা ভেবে-চিন্তে এবং অত্যন্ত জরুরি হলে ব্যবহার করা উচিত বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে হরমোনের ব্যবহার। যেমন এক ধরনের কৃত্রিম ইস্ট্রোজেন মহিলাদের গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন সমস্যার জন্য অতীতে ব্যবহার হতো। পরে দেখা গেল, যে সব মায়েরা গর্ভাবস্থায় এ হরমোন ব্যবহার করছেন তাদের কন্যা সন্তানদের পরবর্তীকালে এক বিশেষ ধরনের জননেন্দ্রিয়ের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও এদের মধ্যে অন্যান্য অঙ্গের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। পুত্র সন্তানদের মধ্যে অ-কোষে বিভিন্ন বিকৃতি দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা শাস্ত্রে বর্তমানে আরও অনেক ক্ষেত্রে হরমোন ব্যবহার করা হয়, যা ক্যান্সার প্রবণতা বৃদ্ধি করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এইচআরটি। মহিলাদের ঋতু¯্রাব বন্ধ হয়ে গেলে এ জাতীয় হরমোন ব্যবহার করা হয়। এগুলো ¯্রাব বন্ধের ফলে সৃষ্ট নানা সমস্যার সমাধান করে। কিন্তু এগুলো ব্যবহারের ফলে জরায়ুর বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্তনের ক্যান্সার বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়।
অনেক ক্ষেত্রে জিনগত ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। জিনগত ত্রুটি বংশানুক্রমিক হতে পারে এবং এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রতিরোধ্য কারণ।
ক্যান্সার প্রতিরোধের কথা ভাবতে গেলে আমাদের সামনে আসে ক্যান্সারের প্রবণতা বৃদ্ধিকারী কারণসমূহ। যদিও এ তালিকাটি এখনও সম্পূর্ণ নয় তবু এর মধ্যে অনেকগুলো কারণ আছে যা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এগুলো নিয়ন্ত্রণের ফলে ক্যান্সার নির্মূল হয়ত সম্ভব নয় কিন্তু রোগের হার কমানো সম্ভব। প্রবণতা বৃদ্ধিকারী কারণসমূহের মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রবণতা কম করার উপায়গুলো। বর্তমানে তাই বলা হয় সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অতি উত্তম। আমাদের খাদ্যে থাকা চাইÑ যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন, কম ¯েœহজাতীয় পদার্থ, প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ এবং তন্তুজাতীয় পদার্থ। তাজা শাক-সব্জি ও ফল খাদ্য তালিকায় থাকা চাই। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেখানে প্রতিরোধ-অযোগ্য প্রবণতা বৃদ্ধিকারী কারণ দেখা দেয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এতে ক্যান্সারের অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরে কোন উপসর্গের আবির্ভাবের পূর্বেই নিরূপণ করা প্রায় সম্ভব হয় এবং চিকিৎসার সাফল্যের হারও বাড়ানো সম্ভব হয়।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক ও কলামনিস্ট।
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত
আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: যুক্তরাষ্ট্র জাগপা