শব্দ : এক নিঃশব্দ ঘাতক
১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম
শব্দ। শব্দ। শব্দ। মোটর গাড়ির হর্ণ হোটেল- রেস্তোরাঁ-সিডি-ক্যাসেটের দোকানে উচ্চঃস্বরে গান-বাজনা, হইচই, চিৎকার, হোটেল-রোস্তোরায় বাসন-কোসন বাজিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ, পাঁচ-সাতটা মাইক লাগিয়ে সভা-সমিতি ওয়াজ মাহফিল মসজিদ-মাজারের জন্য খয়রাতি সাহায্যের করুণ আর্তনাদ, ব্যান্ড সঙ্গীতের আসর, জন-সমাগমের স্থানে মাইক লাগিয়ে মজমা, ভ্যানের ওপর বসে মাইক বাজিয়ে কবিরাজি এবং কী করলে কী হয় শীর্ষক কু-সংস্কারজনিত বই বিক্রি আরও কত কিছুর অত্যাচারে অতিষ্ট নগরজীবন। দেশে সব শহর-বন্দর-নগর এখন পরিণত হয়েছে শব্দ দূষণের কেন্দ্রে। চলছে নগরবাসীর উপর শব্দ দূষণের নির্বিচার অত্যাচার। মাত্রাতিরিক্ত এ শব্দ দূষণের কারণে সর্বস্তরের মানুষ অতিষ্ঠ। কিন্তু কারও দৃষ্টি নেই এ দিকে। পরিবেশবাদীরা মাঝে মধ্যে একটু-আধটু প্রতিবাদ করলেও তাও হারিয়ে যাচ্ছে শব্দের মাঝেই। শব্দ দূষণের কারণে হৃদরোগসহ অন্যান্যা রোগ-ব্যাধি জ্বরায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দিন দিন বধির হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে নগরবাসী। এতসব পরেও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
রাস্তা-ঘাট, বাস-ট্রাকের হর্ণের প্রচন্ড শব্দ অনেকেরই কানে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। অথচ কেউ কাউকে কিছু বলেন না। বাস-ট্রাকের হর্নের প্রচন্ড শব্দে পথচারীর শ্রবণেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে যন্ত্রনাময়। কিন্তু চালকের ভাবগতি দেখে মনে হয় যে, এতে দোষের কিছু নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। রোড পারমিশন আছে, পাবলিক রিকশা-ভ্যান-ঠেলা রাস্তায় ভিড় জমিয়ে রাখবে, রাস্তা ছাড়বে না, জোরে জোরে হর্ন বাজাবেন না তো করবে কী! তবে প্রশ্ন-ড্রাইভার সাহেবের সে অধিকার আছে কি?
আমরা প্রয়োজনে কথা বলি। অপ্রয়োজনেও বলি। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনে বেশি শব্দ ব্যবহার করি। সময়, সময়ের মূল্য, পরিমিতবোধ, ব্যক্তিত্ব, কাজ- এ সব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান স্বল্প এবং সীমিত। তাই অনর্থক তর্ক জুড়ে দিই, এক মিনিটের কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দশ মিনিটে বলি। অল্পেই উত্তেজিত হয়ে যাই, অযথা চিৎকার করি। ফলে অতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি হয়, পরিবেশ দূষিত হয়, ক্ষতি হয় নিজের। শব্দদূষণ যে একটা অত্যাচারের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, সে ব্যাপারে জনগনকে সচেতন করতে না পারলে বা কারোর উপরে আইনের প্রয়োগ না হলে শব্দদূষণের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাব না। রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র ও সরকারী-বেসরকারী চ্যানেলে প্রচারের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে সমস্যাটি।
অনেকেই শব্দদূষণ বিষয়ে অবগত নন। ফলে প্রতিদিন শব্দদূষণ ঘটছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের আশপাশে। নির্দ্বিধায় তা সকলের ক্ষতি করে চলেছে। এক মিটার দূরত্বের মধ্যে দু‘জন মানুষ একটু উচ্চঃস্বরে কথা বললে শব্দ উৎপন্ন হয় ৬০ ডেসিবেল। মোটর গাড়ির হর্ণের শব্দ ১০০ ডেসিবেল। নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্ণ আরও বেশি ক্ষতিকারক শব্দ সৃষ্টি করে। বাস-ট্রাক চলার সময় ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ সৃষ্টি করে। অথচ মানব শরীরের শব্দ ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৭০ ডেসিবেল। আমাদের দেশে শব্দ দূষণের পরিমাণ ৮০ থেকে ১২৫ ডেসিবেল। বাসায় আমরা অনেকেই রেডিও, টিভি,টেপ,ক্যাসেট প্লেয়ার, সিডি, ডিভিডি উচ্চ:স্বরে বাজাই। কিন্তু এতেও শব্দ দূষণের মাত্রা থাকে ৮০-১০০ ডেসিবেল, যা স্বাভাবিক মাত্রা ৭০ ডেসিবেল-এর চেয়ে ১০ থেকে ৩০ ভাগ বেশি।
শব্দ দূষণ চোখ ও মাথার ক্ষতি করে। হর্ণের শব্দ ধমণীকে সংকুচিত করে হৃৎপিন্ডে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। একজন চিকিৎসকের মতে- শব্দ দূষণে অনেকে হৃদরোগ এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন। একজন বিশেষজ্ঞদের মতে-কেউ ক্রমাগত আট ঘন্টা ৯০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে বসবাস করলে ২৫ বছরে তাঁর বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বড় শহর ও নগরে শব্দ দূষণ এখন অত্যাচারের পর্যায়ে। শব্দ দূষণ প্রতিরোধে দেশে আইন থাকলেও তা প্রয়োগ হচ্ছে না।
অভ্যাসগত কারণে আমরা অপরের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করি না। সন্ধ্যায় ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার সময় অনেক মা-বাবা উচ্চ শব্দে টিভি ছেড়ে বসে যান। ক্ষতি হয় নিজের সন্তান ছাড়াও পাশের বাড়ির ছেলে মেয়েদের। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, আবাসিক এলাকার ভেতরে উচ্চঃস্বরে বাজে ব্যান্ডের গান। আশাপাশের কোনও ছেলেমেয়ে নির্বিঘেœ পড়াশোনা করতে পারে না। অসুস্থ মানুষেরা ঘুমোতে পারেন না। অনেক সময় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে ৫/৭ টা মাইক লাগিয়ে সারা রাত ধরে চলে প্রার্থনা ও ওয়াজ। ফলে আশপাশের অনেকেই ঘুমোতে পারেন না। রোগীর অসুবিধা হয়। কারও নজর থাকে না সেদিকে। হাট-বাজারে শব্দের অহেতুক অত্যাচার এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আমি আমার ইচ্ছা মত হইচই করবো, নাচবো-গাইবো। তাতে অপরের ক্ষতি হলে আমার কিছু আসে যায় না। এ রকম মনোভাব প্রায় সর্বত্রই। শব্দ দূষণের সঙ্গে পরিবেশ দূষণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ জন্য পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি শব্দ দূষণের প্রতিও দৃষ্টি দিতে হবে। শব্দ দূষণের ভয়াবহতা সস্পর্কে মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
অন্য এক গবেষণায় জানা গেছে-মাথা ধরা, বিরক্তি, মেজাজ, ঘুমের ব্যাঘাত, কানে কম শোনা ও মনোসংযোগের অসুবিধাসহ অন্যান্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় অতি মাত্রায় শব্দ দূষণের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য, ইউনিসেফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কের একাধিক গবেষণা ও সমীক্ষায় জানা যায়, দেশের ত্রিশটি কঠিন রোগের প্রধান বারো ধরনের পরিবেশ দূষণ। শব্দদূষণ এর অন্যতম। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষে দেশে কাজ করছে বেশকিছু সংগঠন। সরকারী ভাবে একটি খসড়া আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে সরকারী নীতি-নির্ধারকদের অবহেলা ও জনসাধারণের অসচেতনতার কারণে দীর্ঘ সময়েও তা বাস্তবায়নের কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা-অদূর ভবিষ্যতে একটি শব্দদূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশ গড়ে উঠবে, যেখানে সুস্থ-সাবলীল ভাবে বেড়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত
আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: যুক্তরাষ্ট্র জাগপা