গ্রীষ্মের গরমেও ভালো থাকুন
১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০ এএম | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০ এএম

বৈশাখের বিরূপ আবহাওয়ার প্রভাব বিরাজ করছে বাংলাদেশে। এসময়ে অতিরিক্ত গরমের ফলে বাড়ছে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা। ঘামাচি, চুলকানি , পানিস্বল্পতা, হিটস্ট্রোক, স্কিন বার্ন, ডায়রিয়া এমনকি বিভিন্ন কিডনিজনিত সমস্যাতেও আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। গ্রীষ্মের গরমে এসব সমস্যা থেকে বাঁচতে আমাদের করনীয়-
পানিশূন্যতা:
এই গরমে ঘামে শরীর থেকে প্রচুর লবণ-পানি বের হয়ে যায় বলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। সাধারণত এর ফলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়, দুর্বল লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে। পানিস্বল্পতা গরমের খুবই সাধারণ সমস্যা হলেও অবহেলা করলে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এ সময়ে শরীরের কোষ সজীব রাখতে প্রচুর পানি পান করেেত হবে। লবণের অভাব পূরণ করতে খাওয়ার স্যালাইনও খাওয়া যেতে পারে। শরীরে পানি কম হলে প্রস্রাব হলুদ ও পরিমাণে কম হবে এবং জ্বালাপোড়া বা প্র¯্রাবের সংক্রমণ হতে পারে। যে পর্যন্ত না প্র¯্রাব স্বাভাবিক রং ফিরে পাবে, সে পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি খেয়ে যেতে হবে। পানির সঙ্গে অন্যান্য তরল যেমন ফলের রস খাওয়া যেতে পারে। ভাজা-পোড়া, অধিক তেল, মসলাজাতীয় খাবার একদমই এড়িয়ে যেতে হবে। সাধারণ খাবার যেমন ভাত, সবজি, মাছ ইত্যাদি খাওয়াই ভালো। খাবার যেন টাটকা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।
ত্বকের সমস্যা-
প্রখর রোদে ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময়ে খোলা আকাশের নিচে হাঁটাচলা বেশি হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ত্বক ভেদ করে কোষের জন্য বিপদ ডেকে আনে। ত্বকে ফোসকা পড়াসহ ত্বক বিবর্ণ হতে পারে। তাই এ সময়ে বাইরে বেরোলে অবশ্যই সানস্ক্রিন ক্রিম ত্বকে মেখে বের হতে হবে। এ সময়ে চোখে সানগ্লাস পরা ভাল। ছাতা ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে। যথাসম্ভব হালকা রঙের কিংবা সাদা রঙের পোশাক পরা গরমের জন্য উত্তম।
ঘামাচি নামক যন্ত্রণাদায়ক সমস্যাটাও হতে পারে। অনেক সময় চুলকাতে থাকে বলে ত্বকে ঘা দেখা দেয়। এ জন্য প্রয়োজন শরীরে যাতে ঘাম ও ধুলোবালি না জমে সেদিকে লক্ষ রাখা। ঘামাচি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কখনো সিনথেটিক পোশাক পরা চলবে না। সব সময় সুতির ঢিলা পোশাক পরতে হবে। শরীরে যাতে ঘাম না জমে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করতে হবে। প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করা যেতে পারে।
ডায়রিয়া-
গরম এলেই ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে, বিশেষ করে বাচ্চাদের। দুই বছরের নিচে শিশুদের ডায়রিয়ার প্রধান কারণ হলো, রোটা ভাইরাসজনিত সংক্রমণ। চারদিকে ভয়াবহ গরমে যখন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, ঠিক এই সময় চোখের সামনে যে ঠান্ডা পানীয় পাক না কেন, তা দিয়ে গলা ভেজানোতেই মন অস্থির হয়ে যায়। দেখার সময় থাকে না, তা বিশুদ্ধ বা দূষিত কি না। এভাবে এই খাদ্য ও পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। রাস্তাঘাটের অধিকাংশ খাবার দূষিত থাকে, তাই গরমে এই দূষিত খাবার খেয়েই অনেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। একটু সচেতন হলে এটি এড়ানো যায়। এই যেমন হাত পরিষ্কার করে খাবার খেলে। বাসি, পচা খাবার না খেলে।
সর্দিজ্বর-
শিশুদের নিয়ে রোদে ঘোরাঘুরি করলে বাইরের তাপ ও শরীরের তাপের মধ্যে সমতা থাকে না বলে জ্বর হতে পারে। এ জন্য কড়া রোদে তাদের চলাফেরা করতে না দেওয়াই ভালো। জ্বর হলে শরীরে সঞ্চিত শর্করা বেশি হারে খরচ হতে থাকে। এ সময় শরীর থেকে প্রচুর পানি, ঘাম ও প্রস্রাব দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ অবস্থায় শিশুকে ফলের রস দিলে খাবারের রুচি বাড়বে এবং স্যুপ খাওয়ালে ক্ষুধা বাড়বে। ফলে শিশুরা খেতে আগ্রহী হবে।
ছত্রাক সংক্রমণ-
গরমে শরীরে ঘাম জমে ছত্রাক সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। ঘাম শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে বিশেষ করে কুঁচকিতে, আঙুলের ফাঁকে ও জননাঙ্গে জমা হয় ফলে সেখানে ছত্রাক সংক্রমণের সম্ভবরা দেখা দেয়। তাই এ সময়ে ছত্রাক সংক্রমণ এড়াতে হলে শরীরের ভাঁজগুলোতে ঘাম জমতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ছত্রাকবিরোধী পাউডার এসব স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
মস্তিস্কের কাজে ব্যাঘাত-
মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী অংশটি শরীরের তাপ ৩৬ থেকে ৩৯-এর মধ্যে রাখার চেষ্টা করে থাকে। যদি দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তৎক্ষণাৎ হাইপোথ্যালামাস সব রক্তনালি, শিরা ও উপশিরার প্রসারণ ঘটায়। ফলে শরীরে রক্ত চলাচল বাড়ে, যা শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সহায়তা করে।
অতিরিক্ত দাবদাহে আমাদের মস্তিষ্ক ও রক্তনালির মধ্যকার ঝিল্লি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ফলে এমাইনো এসিড ও ক্ষতিকারক আয়ন জমে মস্তিষ্কে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। গরমে আমাদের মেজাজ তিরিক্ষি, অস্থিরতা, মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়া, দুশ্চিন্তা, সিজোফ্রেনিয়া, নিদ্রাহীনতা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, দাবদাহের সময় আত্মহত্যার পরিমাণও বেড়ে যায়।
ফুসফুসের রোগব্যাধি-
অত্যধিক তাপে বাতাসের দূষিত পদার্থগুলোর চলাচল মন্থর হয়ে পড়ে। এসব দূষিত পদার্থ, যেমন-ওজোন, যানবাহন নিঃসৃত কেমিক্যাল, কলকারখানার ক্ষতিকারক গ্যাস ইত্যাদি সূর্যতাপের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটায় এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতায় ক্ষতিসাধন করে। ফলে শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্তদের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা যায়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্বে প্রায় ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে থাকে।
হৃদরোগের ঝুঁকি-
অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এই তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য শরীরের রক্তনালিগুলো প্রসারিত হয়ে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে। ফলে রক্তচাপ কমে যায়। এ ছাড়া শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে হার্টকে দ্রুত সংকোচন-প্রসারণ ঘটিয়ে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি ঘটাতে হয়। কিন্তু কম রক্তচাপে হার্ট দ্রুত ও বেশি রক্ত সঞ্চালন করতে গিয়ে এক পর্যায়ে হার্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও দাবদাহের ফলে বেশির ভাগের মৃত্যু ঘটে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট জটিলতার কারণে।
মাংস পেশিতে দুর্বলতা -
তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ওপরে গেলেই মাংস পেশিগুলোর কার্যক্রম হ্রাস হয়ে শরীরে অবসাদগ্রস্ততার উদ্ভব ঘটে। এ অবস্থাকে ‘তাপ শ্রান্তি’ বলা হয়ে থাকে। তাপশ্রান্তির প্রধান উপসর্গ হচ্ছে মাথা ঘোরানো, চোখে ঝাপসা দেখা, তৃষ্ণা পাওয়া, বমি ভাব কিংবা বমি হওয়া, বুক ধড়ফড় করা, দুর্বল লাগা, চলনশক্তিহীনতা ইত্যাদি। এর পরও যদি তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং তা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায় তখন চামড়া শুকিয়ে তাপ সঞ্চালনের ব্যাঘাত ঘটে। এ অবস্থাকে হিট স্ট্রোক বলা হয়। যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা না করলে আক্রান্ত ব্যক্তি মূর্ছা যেতে পারে, অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
গরমে সুস্থ থাকতে করণীয়-
গরমের দিনে সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান, প্রচুর পরিমান তরল পান করুন।
যথাসম্ভব ইনডোর বা শীতল স্থানে খেলাধুলার ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা করুন।
বাসস্থানে যথাসম্ভব আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
এ সময় দূরপাল্লার ভ্রমণ কিংবা আউটডোর কর্মকান্ড সীমিত রাখুন।
চাই স্বাস্থ্যকর খাবার-
সাধ্যমতো ফল, যেমন-তরমুজ, আনারস, শসা, বাঙ্গি, মাল্টা ইত্যাদি খাবেন।
খাদ্যতালিকায় চিড়া, দই ও কলা রাখতে পারেন। এগুলো শরীরকে ঠান্ডা রাখবে এবং পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করবে।
লাউ, পটোল, শসা, চিচিঙ্গা, গাজর, পেঁপে, পালংশাক পানিশূন্যতা দূর করতে দারুণ সহায়ক।
ভাত, ডাল, শাক-সবজি, মাছ, সালাদ প্রভৃতি খাবারই এ সময় উপাদেয় ও স্বাস্থ্যকর।
বর্জনীয় অভ্যাস ও খাবারদাবার-
দিনের স্বাভাবিক মেন্যুতে অতিরিক্ত তেল, মসলাদার খাবার রাখবেন না। ভাজাপোড়া খাবার যেমন-পুরি, শিঙাড়া, সমুচা, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার যেমন-গরু বা খাসির মাংস, ডিম, ঘি, মাখন, কোমল পানীয়, চকোলেট, মিষ্টি খাওয়া সীমিত করুন।
গরমের সময় খোলা জায়গায় বিক্রি করা খাবার, পানি, শরবত, আখের রস ইত্যাদিতে দ্রুত রোগ-জীবাণু ছড়ায়। এসব পরিহার করতে হবে।
তীব্র গরমে অতিরিক্ত হাঁটা, ব্যায়াম, পরিশ্রম এবং অধিক পরিমাণে খাদ্যগ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তা পরিহার করুন।
এপ্রিল বাংলাদেশের উষ্ণতম মাস। এ মাসে গরমের পাশাপাশি কালবৈশাখীর দাপটও থাকে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, এ মাসে দুই থেকে চারটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ এবং এক থেকে দুটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অতি তীব্র তাপপ্রবাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠতে পারে। এ সময়ে সতর্ক হয়ে না চললে যেকোনো সময়ই আপনি অসুস্থ হতে পারেন। তাই এই গরমে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে জীবনযাপন করুন। সুস্থ থাকুন-ভালো থাকুন।
হ মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ন্যাশনাল হোমিও রিসার্চ সেন্টার
অলংকার শপিং কমপ্লেক্স চট্টগ্রাম।
ইমেইল: drmazed96@gmail.com
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

দুদকের মামলা : আমানউল্লাহ আমান ও তার স্ত্রীর দন্ডাদেশ বাতিল

অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে অর্থনীতি আরো সঙ্কটে পড়েছে : রিজভী

বাংলাদেশ-মিয়ানমার একমত হলে করিডোর চালু করতে পারে জাতিসংঘ

কলকাতায় হোটেলে আগুন নিহত ১৪

ইউক্রেন খুব শিগগিরই ‘ধ্বংস’ হবে: ট্রাম্প

টঙ্গীতে বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়কে অবরোধ

প্রশ্ন : ঈদের বাজারে জীনদের বাজার করা প্রসঙ্গে।

ভ্যান চালক হত্যাচেষ্টা: অভিনেতা সিদ্দিকের ৭ দিনের রিমান্ডে

রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা ছাড়া রাখাইনে মানবিক করিডোর দেয়া থেকে বিরত থাকুন

প্রোটন বাজারে আনল দেশীয় অ্যাসেম্বল এক্স৭০ এসইউভি গাড়ি

হজযাত্রীদের জন্য বাংলাদেশি টাকায় রবির রোমিং প্যাকেজ

উত্তরপ্রদেশে মুসলিম ছাত্রের উপর অমানবিক অত্যাচার

দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি: কাজী শিপন

ফেনীতে প্রধান উপদেষ্টার আবাসন পেল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১০০ পরিবার

বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের কাছে পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া কেউ নেতা হওয়ার সুযোগ নাই: আবুল কালাম

বিরামপুর হাসপাতালে দুদকের অভিযান, পেয়েছে নানা অনিয়ম

মাছ রক্ত,স্মৃতি ও দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়

এই গরমে ত্বকের রোগ

ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে চাই সচেতনতা

পান সুপারি ক্ষতিকর