রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে বিশ্ব সংস্থা
২৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০৫ পিএম | আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০৫ পিএম
- অর্থ যোগান দিতে রোহিঙ্গারা জড়াচ্ছে অপরাধে
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে-প্রধানমন্ত্রী
এখন রোহিঙ্গাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সময়
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) অনুদানের অর্থ সংকট দেখিয়ে কক্সবাজারে ৩৩ টি ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। বরাদ্দ কমায় ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে আর্থসামাজিক অস্থিরতা। অর্থের জোগান দিতে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এতে উদ্বিগ্ন স্থানীয় বাসিন্দারাও। সচেতন মহলের মতে সরকারের মানবিক সহায়তায় আশ্রিত ১২ লক্ষাধীক বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থ সঙ্কট দেখা দিলে ঘটতে পারে মহা বিপর্যয়। তাদের মতে এর একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি
বলেছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সসম্মানে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনই এ সংকটের টেকসই সমাধান। আশা করি, মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। গত ১১ জুলাই মঙ্গলবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে 'ন্যাশনাল কনফারেন্স অন পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি' শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সদস্য দেশসমূহের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
রোহিঙ্গা সংকটে ২০১৮ সাল থেকে সহায়তা করছে দাতা সংস্থাগুলো। কিন্তু এখন দাতা সংস্থা থেকে চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা মিলছে না বলে জানা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডব্লিউএফপি খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ায় আরও জমাট বাঁধছে রোহিঙ্গা সংকট। গত বুধবার ডব্লিউএফপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, চলতি বছর দু'দফা কমানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের রেশন বরাদ্দ। প্রথম দফায় পহেলা মার্চ রেশন বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে করা হয় ১০ ডলার। দ্বিতীয় দফায় পহেলা জুন থেকে আরো ২ ডলার কমিয়ে এখন ৮ ডলারে নামিয়ে আনা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, রেশন কমানোই তাদের শেষ অবলম্বন। অনেক দাতারা তহবিল নিয়ে এগিয়ে এসেছেন কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা মানবিক সংকট পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ৮৭৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু মাত্র এক চতুর্থাংশ অর্থায়ন পাওয়া গেছে।
এদিকে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ার চিন্তিত রোহিঙ্গারা। উখিয়ার ক্যাম্প-১ এর জামালিকা (২৫) বলেন, আমি গর্ভবতী নারী। এখন আমার বেশি বেশি খাওয়া উচিত। কিন্তু এখন খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করতে পারছি না। কারণ খাদ্য কমে গেছে, কোন ধরণের পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছি না। পেটের বাচ্চা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তা রয়েছি। আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হোসন (৫৫) বলেন, ৮৪০ টাকার মধ্যে চাল পেয়েছি ১৩ কেজি, তেল পেয়েছি ১টি আর ১টি লবণের প্যাকেট পেয়েছি মাত্র। এখন কি কবর কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা খালেদা বেগম (৪৮) বলেন, এই রেশন দিয়ে সংসার চলে না। এতে আমার স্বামী ও ছেলেরা ক্যাম্পের বাইরে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়। ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে মাসে ১০-১৫ দিন মজুরি দেয় তারা। ওই অর্থ দিয়ে সংসার চলে। যারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না, তাদের সংসার চলছে কষ্টে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমেছে অর্থ বরাদ্দ। রোহিঙ্গারা আগে যে পরিমাণ রেশন পেতেন, এখন তা পাচ্ছেন না। এতে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্যাম্পে নানা ধরনের অপরাধের পাশাপাশি অস্থিরতা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, নানা জটিলতায় ছয় বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি।
ইতোমধ্যে দাতা সংস্থাগুলো অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। গত ১ মার্চ থেকে রোহিঙ্গাদের জনপ্রতি রেশন ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়েছিল। জুন মাসে আরও কমিয়ে জনপ্রতি মাসে আট ডলার অর্থাৎ ৮৪০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। হিসাবে দৈনিক রেশন কমেছে ৩৩ শতাংশ।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দাসহ জনপ্রতিনিধিদের শঙ্কা এমন খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে আরো বেড়ে যাবে অপরাধ প্রবণতা। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ছয় বছর পার হলেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়েছে। কারণ কাজের সন্ধানে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শ্রমিকের কাজ করছেন। আবার কেউ কেউ নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন। এতে আমরা শঙ্কিত।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমানোর ফলে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসহ জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাড়বে অপরাধও। তবে সমাধান হচ্ছে যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা। মো. মিজানুর রহমান বলেন, এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার জানিয়েছে, ২০১৮ সালে মিয়ানমারকে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে মাত্র ৭০ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই করেছে মিয়ানমার। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে মাদক, অস্ত্র চোরাচালান, অপহরণ ও মুক্তিপণ বাণিজ্য এবং প্রত্যাবাসনের পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন গ্রুপে সঙ্ঘাত লেগেই আছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অন্তত দেড় শতাধিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে।
গত ৬ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জেরে ১৬০ এর অধিক লোক খুন হয়েছে। এসব ঘটনার জের ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে দুই শতাধিক দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এপর্যন্ত ২ হাজার আট শতাধিক মামলায় আসামি হয়েছে ৬ হাজার ২২৬ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ১১৫টি হত্যা, ১৮৫টি অস্ত্র, ১ হাজার ৬৩৬টি মাদক, ৮৮টি ধর্ষণ ও ৩৯টি অপহরণ মামলা।
সর্বশেষ গত (৭-জুলাই) আরএসও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে খুন হন অন্য সন্ত্রাসী আরসার পাঁচ সদস্য। ৮ জুলাই খুন হন আরো একজন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো প্রত্যাবাসন ঠেকাতেই এভাবে খুনোখুনি করে পরিস্থিতি ঘুলাটে করছে এবং সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে ভীতি সঞ্চার করে প্রত্যাবাসন বিমুখ করছে।
এই প্রেক্ষাপটি সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। তিনি উখিয়ায় বালুখালী ও আশপাশের তিনটি আশ্রয়শিবির এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার শরণার্থী সেবা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
আশ্রয় শিবির পরিদর্শনের সময় অন্তত ২৫ জন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের কাছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাঁদের ওপর চালানো গণহত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বর্ণনা শুনেন তিনি। পাশাপাশি নিরাপদ, টেকসই ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন রোহিঙ্গারা। জবাবে উজরা জেয়া রোহিঙ্গাদের বলেন, আইসিসির বিচার ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম চলমান প্রক্রিয়া। সবকিছু তাঁদের পর্যবেক্ষণে আছে। এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা নেতাদের ধৈর্য ধরতে বলেন তিনি।
এখন রোহিঙ্গাদেরও বিষয়টি বুজতে হবে সার্বিক পরিস্থিতি ভালোনা। যেই বাংলাদেশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল তারা আর রোহিঙ্গা বুঝা বহণ করতে পারছেনা। এখন রোহিঙ্গাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সময়।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
জুলাই হতাহতের বিচার আদৌ হবে কিনা সংশয় স্বজনের মধ্যে
হরিণাকুন্ডুতে যুবদল সভাপতির উপর গুলি অল্পের জন্য রক্ষা
সচিবালয়ে আগুন, টঙ্গী হত্যাকাণ্ড ও ইসকনের আস্ফালন একই সূত্রে গাঁথা : যুব সমাবেশে মাওলানা মামুনুল হক
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে :পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সেই সুখরঞ্জন বালির ভারতে গুমের লোমহর্ষক কাহিনী
খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন শাস্তি হলে হাসিনার সুযোগ নেই :অ্যাটর্নি জেনারেল
থার্টি ফাস্ট নাইট নিষিদ্ধ করতে হবে আইন করে :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান
হাসিনা-জয়ের ৩০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের প্রমাণ পেয়েছে এফবিআই
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন
সংস্কারের সঙ্গেই নির্বাচন প্রস্তুতি
‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বিকল্প সোলার সিস্টেম চালু করুন’
আসিফ মাহমুদের হেলিকপ্টারে ছয় দিনে ২৮ বার সফর বিতর্ক
বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরে পণ্য খালাস কার্যক্রম
ডেঙ্গুতে মৃত্যুহীন ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৫৩
নববর্ষ উদযাপনে ৭ বছরে শব্দদূষণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ
হাসিনা পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরুর পরই সচিবালয়ে আগুন : রিজভী
হাসিনার ফ্যাসিজম নিয়ে সস্তা কথা টিকবে না : শফিকুল আলম
চাঁদপুর মেঘনায় ড্রেজারসহ ২৮ জন আটক
ব্যাট হাতেও উজ্জ্বল অভিষিক্ত বশ,চালকের আসনে দক্ষিণ আফ্রিকা
১৬ বছরের অভিনেতার অকাল প্রয়াণে হলিউডে শোকের ছায়া